ফিলিস্তিনের গাজা অভিমুখী ত্রাণবাহী নৌবহর ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার’ নৌযানগুলো থেকে ধরে নেওয়া অধিকারকর্মীদের ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে খাবার ও চিকিৎসাসেবা দেয়নি বলে জানিয়েছে ইসরায়েলে আরব সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংস্থা ‘আদালাহ’। এ নিয়ে বার্তা আদান-প্রদানের প্ল্যাটফর্ম হোয়াটসঅ্যাপে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে তারা।
বিবৃতিতে বলা হয়, আশদোদ বন্দরে প্রবেশের সুযোগ দিতে আদালাহের আহ্বান বারবার খারিজ করে দিয়েছিল ইসরায়েলি পুলিশ। তবে শেষ পর্যন্ত বন্দরটিতে প্রবেশ করতে সক্ষম হন সংস্থাটির সদস্যরা। সেখানে ইসরায়েলের হাতে আটক থাকা ৩৩১ জন অধিকারকর্মীকে পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। অনেক অধিকারকর্মীকে হয়রানি ও হুমকি দেওয়া হয়েছে। এমনকি ঘুমের মধ্যে সহিংস আচরণ করে ঘুম থেকে তোলা হয়েছে।
এ ছাড়া বুধবার প্যারিসের সায়েন্সেস পো ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইনবিশেষজ্ঞ ওমের শাৎজ যে শঙ্কা করেছিলেন, তা সত্যি হয়েছে। আদালাহ জানিয়েছে, আটক অধিকারকর্মীদের ইসরায়েলের নেগেভ অঞ্চলে কেতজিওত কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আগে থেকে তাঁদের আইনজীবীদের জানানো হয়নি। অমানবিক পরিবেশের জন্য এই কারাগারের কুখ্যাতি রয়েছে।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার ৪২টি নৌযানের মধ্যে ৪১টিই গত বুধ ও বৃহস্পতিবার আটক করে ইসরায়েলি বাহিনী। বহরের সর্বশেষ নৌযানটিও শুক্রবার আটক করা হয়। এসব নৌযান থেকে ৪৬১ জন অধিকারকর্মীকে আটক করেছে ইসরায়েল। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সুইডিশ অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গও (২২)।
৩১ আগস্ট স্পেন থেকে গাজার দিকে রওনা দিয়েছিল গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা। বহরের নৌযানগুলোয় ৪৪টি দেশের প্রায় ৫০০ আরোহী ছিলেন। বহরটি গাজা উপকূলের ১২৯ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছালে বুধবার রাতে আক্রমণ শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। তখন থেকে বৃহস্পতিবার দিন ও রাতভর বহরটির ৪২টি নৌযানের মধ্যে ৪১টিই আটকে দেয় ইসরায়েল।
বাকি ছিল শুধু ম্যারিনেট নামের একটি নৌযান। গাজার ৭৯ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছালে স্থানীয় সময় শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সেটিতে হানা দেয় ইসরায়েলি সেনারা। ছোট একটি নৌযানে করে এসে ম্যারিনেটে ওঠে পড়ে তারা। নৌযানটিতে থাকা ছয় অধিকারকর্মীকে আটক করা হয়। তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় ইসরায়েলের আশদোদ বন্দরে।
এর আগে আটক ৪১টি নৌযানে থাকা অধিকারকর্মীদেরও আশদোদ বন্দরে ধরে নিয়ে যায় ইসরায়েল। গতকাল এক্সে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে ৪৬১ জনকে আটক করেছে তারা। এর মধ্যে ইতালির চার নাগরিককে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাঁরা ইতালির পার্লামেন্ট সদস্য বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজিনি।
আটক অধিকারকর্মীরা গাজাবাসীর জন্য খাদ্য, ওষুধসহ জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দেওয়ার জন্য এগিয়ে এলেও তাঁদের সন্ত্রাসী তকমা দিয়েছেন ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘তারা আসলে সাহায্য করতে আসেনি। তারা গাজায় এসেছে সন্ত্রাসীদের জন্য। তারাই সন্ত্রাসী।’
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় বিভিন্ন দেশ এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচিত প্রতিনিধি, আইনজীবী, অধিকারকর্মী ও চিকিৎসকের পাশাপাশি সাংবাদিকেরাও ছিলেন। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) জানিয়েছে, নৌবহরে হামলা চালিয়ে ২০ জনের বেশি বিদেশি সাংবাদিককে আটক করেছে ইসরায়েল।
বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠনটির কর্মকর্তা মার্টিন রোক্স এক বিবৃতিতে বলেন, আটক সাংবাদিকদের মধ্যে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা, স্পেনের সংবাদমাধ্যম এল পাইস ও ইতালির সম্প্রচারমাধ্যম আরএআইয়ের প্রতিবেদকেরা রয়েছেন। বুধবার দিবাগত রাতে বহরটিতে হামলার শুরু থেকেই একে একে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
ইসরায়েলের এই ধরপাকড়ের নিন্দা জানিয়ে মার্টিন রোক্স বলেন, তথ্য জানা এবং অপরকে জানানোর যে অধিকার রয়েছে, সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা হলে এবং তাঁদের কাজ থেকে বিরত রাখা হলে তা মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হয়। এই সাংবাদিকদের অবৈধভাবে গ্রেপ্তার করার নিন্দা জানায় আরএসএফ।
প্রায় দুই বছর ধরে গাজায় চলমান ইসরায়েলের আগ্রাসনের বড় ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। এ সময় উপত্যকাটিতে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। নির্দিষ্ট কয়েকটি গণমাধ্যমকে ইসরায়েলি সেনা পাহারায় সংবাদ সংগ্রহের সুযোগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া গত দুই বছরে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন ২১০ জনের বেশি সাংবাদিক।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এতে এখন পর্যন্ত সেখানে ৬৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গতকাল হামলায় নিহত হয়েছেন ৭২ জন। আর ইসরায়েলি সেনারা গাজা অবরোধ করে রাখায় সেখানে খাবার, পানি ও চিকিৎসা সরঞ্জামের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
ইসরায়েলি বাহিনীর অবরোধ ভেঙে সমুদ্রপথে গাজায় পৌঁছানোর চেষ্টা থেমে নেই। উপত্যকাটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আরও ৯টি নৌযানের এক বহর। এই নৌবহর আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি) ও থাউজেন্ড ম্যাডলিনস টু গাজার (টিএমটিজি)। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার (জিএসএফ) চারটি আয়োজকের একটি হলো এফএফসি।
নয়টি নৌযানের এই বহর বাংলাদেশ সময় শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে ভূমধ্যসাগরে গ্রিসের ক্রিট দ্বীপ অতিক্রম করে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। বহরের নয়টি নৌযান হলো আবদ এলকরিম ইদ, আলা আল-নাজ্জার, আনাস আল শরিফ, কনশানস, গাজা সানবার্ড, লেইলা খালেদ, মিলাদ, সৌল অব মাই সৌল ও উম সাদ। এর বাইরে বহরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে আল-আওদা ও গাসান কানাফানি নামের দুটি নৌযান।
এফএফসির তথ্য অনুযায়ী, গত বুধবার ইতালি থেকে কনশানস গাজার উদ্দেশে রওনা দেয়। এতে চিকিৎসাকর্মী, সাংবাদিকসহ প্রায় ১০০ জন অধিকারকর্মী রয়েছেন। এই জাহাজে আছেন দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। জাহাজটি ভূমধ্যসাগরে থাউজেন্ড ম্যাডলিনস টু গাজা নামের আরেকটি উদ্যোগের ৮টি নৌযানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এতে এই বহরে এখন মোট নৌযানের সংখ্যা ৯।
গাজামুখী নতুন বহরের কথা উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ও ইনস্টাগ্রামে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা বলেছে, একতাবদ্ধ হয়ে যে বৈশ্বিক আন্দোলন চলছে, তা অবশ্যই জারি থাকবে। প্রতিটি বন্দরে, প্রতিটি সড়কে, প্রতিটি চত্বরে এই আন্দোলন চলতে থাকবে। জাতিগত নিধন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তারা থামবে না। ফিলিস্তিন মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা থামবে না।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় ইসরায়েলের আক্রমণের প্রতিবাদে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হয়েছে ইতালিতে। শুক্রবার দেশটিতে ধর্মঘট পালন করে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। এর মধ্যে সিজিআইএল নামের একটি শ্রমিক সংগঠন ইতালির শতাধিক শহরে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়। এসব বিক্ষোভে হাজার হাজার মানুষ যোগ দেন। তাঁদের অনেকের হাতে ছিল ফিলিস্তিনের পতাকা।
ধর্মঘটের ফলে ইতালিতে ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। অনেক ট্রেনযাত্রা বাতিল করা হয়। রাজধানী রোমে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন মারিও মাসকেটি নামের এক ব্যক্তি। রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘ফ্লোটিলার সঙ্গে যা হয়েছে, তা দেখার পর আর চুপ থাকা যাবে না। এ ধরনের বিক্ষোভ সমাবেশে এই প্রথম আমি অংশ নিয়েছি।’
আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ছিলেন মরিয়াম ম্যাকনালি। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে আটক অধিকারকর্মীদের মধ্যে তাঁর মেয়েও আছেন। মরিয়াম বলেন, ‘মেয়ের জন্য আমার খুবই ভয় লাগছে। তবে সে ও তার সঙ্গীরা যা করছে, আমি খুবই গর্বিত। বড় বিপদের মধ্যেও সে মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছে।’
নৌবহরে ইসরায়েলের আক্রমণের প্রতিবাদে স্পেনের বার্সেলোনায় বিক্ষোভে যোগ দেন প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। এ সময় তাঁদের ‘গাজা তুমি একা নও’, ‘বয়কট ইসরায়েল’, ‘ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চাই’ স্লোগান দিতে শোনা যায়। এ সময় বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে এগিয়ে আসে দাঙ্গা পুলিশ। আর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়েছে পুলিশ।
এর বাইরে গতকাল জার্মানি, ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা, পাকিস্তান, ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, লিবিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, তিউনিসিয়া, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায় বিক্ষোভ হয়েছে। এসব বিক্ষোভ প্রসঙ্গে এক্সে গাজার জনসংযোগ কার্যালয়ের প্রধান ইসমাইল আল-থাওয়াতা বলেন, ইসরায়েলিরা ফ্লোটিলায় বাধা দেওয়ার পরও অধিকারকর্মীদের বার্তা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গেছে।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় ইসরায়েলের হামলার বিষয়ে ফিলিস্তিনি মানবাধিকার আইনজীবী ডিয়ানা বুট্টু আল-জাজিরাকে বলেন, ফ্লোটিলা থেকে ইসরায়েল অধিকারকর্মীদের অপহরণ করেছে। তাঁদের জোর করে ইসরায়েলে নিয়ে গেছে। এরপর উল্টো ইসরায়েলে অনুপ্রবেশের অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁদের ওপর। এটি আন্তর্জাতিক জলদস্যুতা।