অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে ইসরায়েলে যেতে নিবন্ধনের অপেক্ষায় ভারতীয়রা। গত ২৫ জানুয়ারি দেশটির উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌতে
অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে ইসরায়েলে যেতে নিবন্ধনের অপেক্ষায় ভারতীয়রা। গত ২৫ জানুয়ারি দেশটির উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌতে

সীমান্তে কৃষিকাজে কেন বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ দেয় ইসরায়েল

লেবানন থেকে ছোড়া ট্যাংক–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রে ৪ মার্চ একজন ভারতীয় নিহত এবং আরও কয়েকজন অভিবাসী শ্রমিক গুরুতর আহত হন। ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় শহর মারগালিয়তে একটি বাগানে তখন তাঁরা কৃষিকাজ করছিলেন।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, নিহত ওই ব্যক্তির নাম পাটনিবিন ম্যাক্সওয়েল। মাত্র দুই মাস আগে তিনি দেশটির কেরালা রাজ্য থেকে ইসরায়েলে এসেছিলেন। এর পর থেকে ইসরায়েলে অবস্থানরত ভারতীয়দের নিরাপদ এলাকায় সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে নয়াদিল্লি।

চলমান এ সংঘাতে অভিবাসী কৃষিশ্রমিক নিহত হওয়ার এটাই প্রথম ঘটনা নয়। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের হামলার সময় ৩২ থাই কৃষক নিহত হন আর ২৩ জনকে বন্দী করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়।

কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, অক্টোবর থেকে বিপুলসংখ্যক থাই শ্রমিক ইসরায়েল ছেড়ে গেছেন। পাশাপাশি ফিলিস্তিনি কৃষিশ্রমিকদের সঙ্গে চুক্তি স্থগিত করলে ইসরায়েলের কৃষি খাতে এ যাবৎকালের সবচেয়ে মারাত্মক সংকট দেখা দেয়। এ ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে ভারতের মতো অন্যান্য দেশে থেকে নতুন শ্রমিক আনা হচ্ছে।

ইসরায়েলে অবস্থানরত অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞরা মিডল ইস্ট আইকে বলেছেন, রকেট হামলার আওতার মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন এসব শ্রমিক। কাজের ও থাকার বাজে পরিবেশের মধ্যেই শ্রমিকদের কাজ করতে হচ্ছে।

সীমান্তবর্তী এলাকায় চাষাবাদের ইতিহাস

লেবানন, জর্ডান, দখলকৃত গোলান মালভূমি, গাজা উপত্যকাসহ সীমান্তবর্তী কয়েকটি এলাকায় কৃষিশ্রমিক দিয়ে কাজ করানোর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে ইসরায়েলের।
লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির প্রভাষক মাতান কামিনের মিডল ইস্ট আইকে বলেন, সীমান্তের কাছে এভাবে শ্রমিক দিয়ে কাজ করানোর ধরনটি নতুন কিছু নয়। জায়নবাদ ও ইসরায়েলি রাষ্ট্রের দীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে এটি যুক্ত।

কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির এই শিক্ষক বলেন, ভূমি দখল এবং সীমান্তবর্তী ভূখণ্ড বাড়ানোর কৌশল হিসেবে কৃষিকে ব্যবহার করে আসছে ইসরায়েল। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে এসব কৃষিকাজের বেশির ভাগই করতেন ইহুদি শ্রমিকেরা।

পরবর্তী দশকগুলোতে এবং বিশেষ করে ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের পর (এই যুদ্ধে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর, সিরিয়ার গোলান মালভূমি, গাজা ও মিসরের সিনাই অঞ্চল দখল করে নেয়) ইসরায়েলের কৃষি শ্রমশক্তির বেশির ভাগ ছিলেন ফিলিস্তিনিরা।

এর কারণ, ফিলিস্তিনিদের কম টাকায় খাটানো যায় এবং অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক তাঁরা কঠিন এ কাজ বেশি করতে চান। কামিনের বলেন, কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলিরা এসব কাজ স্পর্শ করছেন না। কারণ, এটি কম মজুরির কঠিন কাজ।
কিন্তু প্রথম ইন্তিফাদা বা অভ্যুত্থানের পর ১৯৯০–এর দশকের শুরুর দিকে কৃষিতে ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের ওপর নির্ভরতা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় ইসরায়েল। ফিলিস্তিনিদের জায়গায় থাই কৃষিশ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে দেশটি থাইল্যান্ডের সঙ্গে একটি চুক্তি করে।

গাজা সীমান্তবর্তী এলাকার একটি জমিতে বসে আছেন এক ইসরায়েলি সেনা

কামিনের বলেন, ইসরায়েলের জনমিতির হারে ভারসাম্য ধরে রাখতে দেশটি নিশ্চিত করে, থাই শ্রমিক নিয়োগের চুক্তি হবে সাময়িক। তাঁরা অনেকটা ‘অতিথি শ্রমিক’ হিসেবে কাজ করবেন।

এসব শ্রমিকদের অনেকে বৈষম্য ও বাজে কর্মপরিবেশের মুখোমুখি হয়ে আসছেন। এর মধ্যে রয়েছে ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম বেতন পাওয়া, ভঙ্গুর স্বাস্থ্য, নিরাপত্তাবিধি লঙ্ঘন এবং যৌন হয়রানির শিকার হওয়া।

শ্রমিকেরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। বিশেষ করে সংঘাতের সময়ে। জর্ডানের কাছে নেগেভ মরুভূমির আরাবাহ অঞ্চলের মতো সীমান্তবর্তী কৃষি এলাকা তুলনামূলক শান্ত। তবে নিয়মিত বিরতিতে রকেট হামলার কারণে গাজা সীমান্ত কিছু কিছু সময়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

যুদ্ধে ঠেলে দেওয়া হয় থাই শ্রমিকদের

গাজা সীমান্তবর্তী কৃষিজমিতে আগের সব যুদ্ধের সময়ও রকেট হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালের মে মাসের যুদ্ধে রকেট হামলায় দুই থাই শ্রমিক নিহত হন।
গত অক্টোবরে হামাসের হামলার সময় থাই শ্রমিক নিহত ও অপহরণের ঘটনার পর দেশটির সরকার সাড়ে আট হাজার শ্রমিককে দেশে ফিরিয়ে নেয়। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাতে বন্দী ২৩ থাই শ্রমিকের পাঁচজন এখনো গাজায় আটক রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কামিনের বলেন, অভিবাসী শ্রমিকদের যুদ্ধে নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষ হিসেবে দেখে আসছিল ইসরায়েল। তবে এখন সে অবস্থা আর নেই। ৭ অক্টোবর যখন থাই অভিবাসীদের ওপরও হামাস হামলা চালায়, তখন থেকেই তারা যুদ্ধের একটি পক্ষে পরিণত হয়েছে।

ইসরায়েলের তেল হাই কলেজের সমাজবিজ্ঞানী ইয়াহেল কুরলান্দার একই মত পোষণ করেন। মিডল ইস্ট আইকে তিনি বলেন, ইসরায়েলি, থাই ও নেপালের শিক্ষার্থী—প্রত্যেকে খুন হয়েছেন। প্রত্যেকের ওপর হামলা হয়েছে।

এ হামলার জবাবে গাজার সব ফিলিস্তিনি শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তি স্থগিত করে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। দখলকৃত পশ্চিম তীর থেকে আসা বেশির ভাগ ফিলিস্তিনি শ্রমিকের চুক্তিও স্থগিত করা হয়।

শ্রমিকের এ ঘাটতি পূরণে ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালাবিসহ কয়েকটি দেশ থেকে লোক নিচ্ছে ইসরায়েল। ইসরায়েলে পৌঁছানোর পর নতুন এই শ্রমিকদের অনেকেই নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে মারাত্মক উদ্বেগের পাশাপাশি নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন।
শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি ইসরায়েলি সংগঠনের মুখপাত্র আসিয়া লাদিঝিনস্কায়া মিডল ইস্ট আইকে বলেন, ‘তাঁরা (শ্রমিকেরা) আমাদের বলেছেন, তাঁদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি এবং বাস্তবতার মধ্যে যে ব্যবধান, তা নিয়ে তাঁরা মর্মাহত।’
এই অধিকার কর্মী বলেন, কঠিন কাজ, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, বাজে পরিবেশ, নিয়োগদাতার সঙ্গে যোগাযোগে জটিলতা—সবাই জানেন না এসব সমস্যা নিয়ে কার সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি বলেন, তাঁরা (শ্রমিকেরা) সীমান্তের খুব কাছে কাজ করছেন এবং তাঁরা আতঙ্কিত।

আসিয়া আরও বলেন, মারগালিয়তে ৪ মার্চের হামলার আগে সংগঠনটির কাছে উদ্বেগের কথা জানিয়েছিলেন ভারতীয় শ্রমিকেরা।

ইসরায়েল যাওয়ার জন্য ব্যবহারিক পরীক্ষায় অংশ নিতে ভারতের হরিয়ানায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সারিতে অপেক্ষমাণ তরুণেরা

ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি

ভারতীয় শ্রমিকেরা বেসরকারি চুক্তির মাধ্যমে এসেছেন। ফলে তদারকি ও তাঁদের অধিকার সুরক্ষার সুযোগ কম থাকছে। আসিয়া বলেন, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে এসেছেন থাই শ্রমিকেরা। তাদের ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা এবং তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ আছে। কারও না কারও কাছে তারা সাহায্য চাইতে পারেন; কিন্তু বেসরকারি চুক্তিতে সুরক্ষা তুলনামূলক কম।

সমাজবিজ্ঞানী ইয়াহেল বলেন, অভিবাসী শ্রমিকদের বিপজ্জনক আবাসন পরিস্থিতি তাঁদের সীমান্তবর্তী শহরগুলোয় ইসরায়েলিদের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে ফেলেছে। তিনি আরও বলেন, ইসরায়েলিদের চেয়ে অভিবাসী শ্রমিকেরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে রয়েছেন। কারণ, বাসায় আশ্রয় নেওয়ার মতো ব্যবস্থা কম।

মারগালিয়তের মতো যুদ্ধ চলছে এমন এলাকা থেকে অধিকাংশ বাসিন্দারা নিরাপদ এলাকায় সরে গেছেন। কৃষিখামার সচল রাখতে কেউ কেউ রয়ে গেছেন।

আসিয়া বলেন, যদিও তাঁদের সুরক্ষিত জায়গায় আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ আছে, কিন্তু যাঁরা কৃষিজমিতে কাজ করেন, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সাইরেন বেজে ওঠার পর নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে যথেষ্ট সময় পান না।

এই অধিকারকর্মী আরও বলেন, ইসরায়েলিদের ফল ও সবজির জোগান দিতে গিয়ে মানুষের মরতে যাওয়া উচিত নয়।

ইকুইডেম নামের একটি শ্রম অধিকার সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মুস্তফা কাদরি বলেন, প্রান্তিক অবস্থানে থাকা অভিবাসী শ্রমিকেরা ক্রমাগত ‘শোষণ ও দুর্ব্যবহারের’ মুখোমুখি হচ্ছেন, যে সমাজ ও অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে তাঁরা সাহায্য করে আসছেন।
মুস্তফা কাদরি মিডল ইস্ট আইকে বলেন, আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীন বেসামরিক নাগরিক হিসেবে অভিবাসী শ্রমিকেরা সুরক্ষিত গোষ্ঠীর মর্যাদা পান। অভিবাসী শ্রমিকসহ সুরক্ষিত মর্যাদা পাওয়া অন্য সব ব্যক্তি ও বস্তুর প্রতি ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি ও লেবাননভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে।

ভাষান্তর: মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম