
বিতর্কিত এক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মানবিক সহায়তা কেন্দ্র নির্মাণে গাজার বিভিন্ন স্থান প্রস্তুত করছে ইসরায়েল। কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে এমনটি দেখা গেছে।
ইসরায়েল সরকার গত মার্চে গাজায় খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ স্থগিত করে দিয়েছিল।
ইসরায়েলি মন্ত্রীদের দাবি, অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি দিতে হামাসের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। জাতিসংঘ, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা এ পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছেন।
জাতিসংঘ বলেছে, গাজায় ইসরায়েলি অবরোধের কারণে খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। গত সোমবার বিশ্ব সংস্থাটির প্রকাশিত এক মূল্যায়নে বলা হয়, গাজার প্রায় ২১ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের গুরুতর ঝুঁকিতে আছেন।
যুক্তরাষ্ট্র গত সপ্তাহে নিশ্চিত করেছে, গাজার বিভিন্ন স্থান থেকে যাতে ত্রাণ বিতরণ করা যায়, সেই লক্ষ্যে তারা এক নতুন ব্যবস্থা গড়ে তুলছে। এটি পরিচালনা করবে বেসরকারি কোম্পানিগুলো। সুরক্ষা দেবে নিরাপত্তা ঠিকাদার ও ইসরায়েলি বাহিনীগুলো।
কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিগুলো বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি ভেরিফাই। এতে দেখা গেছে, গাজার দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে অন্তত চারটি স্থানে সম্প্রতি জমি সমতল করে রাস্তা ও মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে।
সহায়তা বিতরণ কেন্দ্রগুলো কোথায় নির্মাণ করা হবে তা প্রকাশ্যে জানায়নি ইসরায়েল। তবে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আগেই ব্রিফিং পাওয়া মানবিক সহায়তা–সংক্রান্ত সূত্রগুলো বিবিসি ভেরিফাইকে জানিয়েছে, গাজার দক্ষিণাঞ্চলে অন্তত চারটি কেন্দ্র ও উত্তরে নেতজারিম করিডরের কাছে আরেকটি কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। নেতজারিম করিডর ইসরায়েলি সেনানিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড, যা গাজাকে কার্যত দুভাগে ভাগ করেছে।
গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠন এ পরিকল্পনার সহায়তায় গঠিত হয়েছে। তারা বলেছে, প্রথম ধাপে ১২ লাখ মানুষকে খাদ্য, পানি ও পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী সরবরাহ করা হবে, যা গাজার মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের কম।
সহায়তা কেন্দ্রগুলো কোথায় নির্মাণ করা হবে তা প্রকাশ্যে জানায়নি ইসরায়েল। তবে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আগেই ব্রিফিং পাওয়া মানবিক সহায়তা–সংক্রান্ত সূত্রগুলো বিবিসি ভেরিফাইকে জানিয়েছে, গাজার দক্ষিণাঞ্চলে অন্তত চারটি কেন্দ্র ও উত্তরে নেতজারিম করিডরের কাছে আরেকটি কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।
গতকাল বুধবার সংস্থাটি জানায়, তারা মে মাস শেষ হওয়ার আগেই কার্যক্রম শুরু করবে। আর পূর্ণাঙ্গ বিতরণ কেন্দ্র চালু না হওয়া পর্যন্ত স্বাভাবিক পথে ত্রাণ সরবরাহ চালু রাখার জন্য তারা ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটি গাজার উত্তরাঞ্চলেও সহায়তা কেন্দ্র গঠনের দাবি জানিয়েছে, যা মূল পরিকল্পনায় ছিল না।
জাতিসংঘের সংস্থাগুলো জোর দিয়ে বলেছে, তারা এ পরিকল্পনার সঙ্গে কোনো ধরনের সহযোগিতা করবে না। এ পরিকল্পনা মৌলিক মানবিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় দপ্তরের (ওসিএইচএ) মুখপাত্র ওলগা চেরেভকোর অভিযোগ, ‘সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে ইসরায়েল খাদ্য ও জ্বালানিকে চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছে।’
ওলগা চেরেভকো বিবিসি ভেরিফাইকে বলেন, ‘সামরিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হাতে গোনা কয়েকটি কেন্দ্রের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করা হবে। এ ধরনের বন্দোবস্ত গাজার বড় এলাকা, বিশেষ করে বেশির ভাগ নাজুক মানুষ, যাঁরা সহজে চলাফেরা করতে পারেন না বা সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, তাঁদের জন্য সহায়তা কার্যত বন্ধ করে দেবে।’
অক্সফামের বুশরা খালিদি এ পরিকল্পনাকে ‘প্রহসন’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘সরবরাহ ব্যবস্থার কোনো সমাধানই ইসরায়েলের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ও অনাহারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কৌশল ঠেকাতে পারবে না। অবরোধ তুলে নিন, সীমান্ত খুলে দিন এবং আমাদের কাজ করতে দিন।’
জানা গেছে, প্রস্তাবিত এই নতুন ব্যবস্থা এখনো ইসরায়েলি সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।
কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি ভেরিফাই। এতে দেখা গেছে, গাজার দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে অন্তত চারটি স্থানে সম্প্রতি জমি সমতল করে রাস্তা ও মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে।
কৃত্রিম উপগ্রহের ছবিতে কী দেখা গেছে
গাজা থেকে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকায় সম্ভাব্য চারটি বিতরণকেন্দ্র শনাক্ত করতে কৃত্রিম উপগ্রহের ছবি ব্যবহার করেছে বিবিসি ভেরিফাই। এগুলোর আকার, আকৃতি ও নকশা গাজার মধ্যে বিদ্যমান অন্যান্য বিতরণকেন্দ্র; যেমন ইরেজ, ইরেজ ওয়েস্ট ও কিসুফিমের মতো। সবচেয়ে বড় কেন্দ্রের তুলনা করা যেতে পারে গাজার কেরেম শালোম ক্রসিংয়ের ভেতরে অবস্থিত বিতরণকেন্দ্রটির সঙ্গে।
কৃত্রিম উপগ্রহের ছবি বিশ্লেষণ করে বিবিসি দেখেছে, দক্ষিণ-পশ্চিম গাজার একটি স্থানে গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণকাজ চলছে। জায়গাটি একটি ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্রামের কাছে, যেটি এখন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) ঘাঁটি।
চলতি বছরের এপ্রিলের শুরু থেকে তোলা কৃত্রিম উপগ্রহের ছবিতে দেখা গেছে, সেখানে একটি রাস্তা ও একটি বড় প্রস্তুতিস্থল তৈরি করা হয়েছে। সেটিকে ঘিরে বালু দিয়ে বড় প্রতিরক্ষা দেয়াল তৈরি করা হয়েছে। জায়গাটি মিসর সীমান্ত থেকে প্রায় ৬৫০ মিটার দূরে অবস্থিত।
৮ মে তোলা হাই রেজল্যুশনের একটি ছবিতে দেখা যায়, প্রায় ২০ একর এলাকাজুড়ে বুলডোজার ও খননযন্ত্র দিয়ে কাজ চলছে। কাছেই একটি সুরক্ষিত ভবনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আইডিএফের সাঁজোয়া যান।
একটি জায়গার ছবিতে দেখা গেছে, সেখানকার চারপাশে আলো বসানোর কাজ চলছে। বিবিসি ভেরিফাই ওই জায়গার ভৌগোলিক অবস্থান নির্ধারণ করেছে। ১১ ও ১২ মে তোলা আরও কিছু ছবিতে দেখা যায়, আরও তিনটি জায়গার পরিসর ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে।
ম্যাকেঞ্জি ইন্টেলিজেন্সের জ্যেষ্ঠ ছবি বিশ্লেষক স্টু রে বলেন, এসব জায়গা সম্ভবত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র হিসেবেই প্রস্তুত করা হচ্ছে। কয়েকটি জায়গার অবস্থান আইডিএফের ঘাঁটির খুব কাছাকাছি, যা ইঙ্গিত দেয়, ইসরায়েলি বাহিনী এসব কেন্দ্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়।
এ বিষয়ে জানতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে বিবিসি ভেরিফাই। কিন্তু সম্ভাব্য সহায়তাকেন্দ্র সম্পর্কে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তারা। তবে বলেছে, গাজায় তাদের সব অভিযান ‘আন্তর্জাতিক আইন মেনে’ পরিচালিত হচ্ছে।
গাজার প্রবেশপথ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ইসরায়েলি সংস্থা কোগাট এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।