ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা। এই ধ্বংসস্তূপের নিচে অনেক ইসরায়েলি জিম্মির মরদেহ চাপা পড়ে আছে বলে দাবি হামাসের। বৃহস্পতিবার গাজা নগরীতে
ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা। এই ধ্বংসস্তূপের নিচে অনেক ইসরায়েলি জিম্মির মরদেহ চাপা পড়ে আছে বলে দাবি হামাসের। বৃহস্পতিবার গাজা নগরীতে

জিম্মিদের মরদেহ ফেরতে বিলম্বকে চুক্তি লঙ্ঘন বলছেন নেতানিয়াহু, একমত নয় যুক্তরাষ্ট্র

ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরুর মাত্র ছয় দিনের মাথায় উপত্যকাটিতে আবার হামলা শুরুর হুমকি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি না মানলে ইসরায়েল এ হামলা চালাবে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। যদিও যুদ্ধবিরতির পর গাজায় ২৪ জনকে হত্যা করে ইসরায়েলই চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ হামাসের।

আজ বৃহস্পতিবার ছিল ট্রাম্পের ২০ দফা ‘শান্তি’ পরিকল্পনা অনুযায়ী গাজায় যুদ্ধবিরতির সপ্তম দিন। আগের দিন বুধবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে টেলিফোনে সাক্ষাৎকার দেন ট্রাম্প। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে প্রশ্ন করা হয়, তাঁর প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনা অনুযায়ী হামাস যদি ভবিষ্যতে অস্ত্রসমর্পণ করতে রাজি না হয়, তাহলে তিনি কী পদক্ষেপ নেবেন?

জবাবে ট্রাম্প বলেন, তিনি এটি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। তিনি বলার সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েল গাজার রাস্তাগুলোয় ফিরে যাবে। আর ইসরায়েল যদি আবার গাজায় প্রবেশ করে, তখন হামাসের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেবে। ফলে হামাস অস্ত্রসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। গাজায় নতুন হামলা থেকে তিনিই এখন ইসরায়েলকে বিরত রেখেছেন।

ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার ষষ্ঠ দফায় রয়েছে হামাসের অস্ত্রসমর্পণের বিষয়টি। পরিকল্পনার প্রথম ধাপ অনুযায়ী বর্তমান যুদ্ধবিরতি চলছে। যুদ্ধবিরতির এই ধাপে ইসরায়েলি জিম্মিদের ফেরত দেওয়া হবে। পরবর্তী ধাপে অস্ত্রসমর্পণ করবেন হামাস সদস্যরা। এর বিনিময়ে তাঁদের ‘ক্ষমা’ করা হবে। যদিও পরের ধাপের অস্ত্রসমপর্ণসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে এখনো সমঝোতা হয়নি।

এমন পরিস্থিতিতে গাজায় ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করা এলাকাগুলোয় হামাস সদস্যদের অস্ত্র হাতে টহল দিতে দেখা গেছে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়িয়েছেন তাঁরা। এ বিষয়ে সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, ‘সহিংস গোষ্ঠীগুলোকে নির্মূল করছে হামাস।’ গত সপ্তাহেও তিনি বলেছিলেন, গাজায় শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য হামাসকে সাময়িক সময়ের জন্য অস্ত্র ধরার অনুমতি দিয়েছেন তিনি।

নেতানিয়াহুর সঙ্গে একমত নয় যুক্তরাষ্ট্র

যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী গাজায় বন্দী থাকা জীবিত ২০ ইসরায়েলি জিম্মিকে ফেরত দিয়েছে হামাস। মৃত ২৮ জিম্মির মধ্যে ১০ জনের মরদেহও ইসরায়েলকে ফেরত দিয়েছে তারা। এই মরদেহগুলোই শুধু তাদের কাছে ছিল বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি সংগঠনটি। তাদের ভাষ্য, দুই বছর ধরে ইসরায়েলের হামলায় গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ায় বাকি মরদেহ খুঁজে বের করতে সময় লাগবে।

তবে এ কথা মানতে নারাজ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তাঁর মতে, যুদ্ধবিরতি শুরুর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জীবিত ও মৃত—সব জিম্মিকে ফেরত না দিয়ে চুক্তি লঙ্ঘন করেছে হামাস। গতকাল জেরুজালেমে নেতানিয়াহু বলেন, সব জিম্মি ফেরত আনতে বদ্ধপরিকর তাঁরা। ইসরায়েলের লড়াই এখনো শেষ হয়নি। ইসরায়েলে হস্তক্ষেপ করলে চড়া মূল্য দিতে হবে।

ফিলিস্তিনি নারী হায়াম মেকদাদ (৪৯)। দাঁড়িয়ে আছেন নিজ বাড়ির ধ্বংসস্তূপের ওপর। যুদ্ধবিরতির পর এখন বাস করছেন তাঁবুতে। বুধবার গাজা নগরীতে

মরদেহ ফেরতে বিলম্বকে নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করলেও যুক্তরাষ্ট্র তা মনে করে না বলে সিএনএনকে জানিয়েছেন দেশটির দুজন জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা। তাঁরা বলেন, মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে হামাস এই নিশ্চয়তা দিয়েছে যে বাকি জিম্মিদের মরদেহ খুঁজে বের করতে এবং ফেরত দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রও এ কাজে সহায়তা করছে।

জিম্মিদের মরদেহ খুঁজে বের করার জটিলতার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ট্রাম্পও। বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এটি একটি ভয়াবহ কাজ। তারা (হামাস) খোঁড়াখুঁড়ি করছে। অনেক মরদেহ খুঁজে পাচ্ছে। এরপর মরদেহগুলো আলাদা করতে হচ্ছে। আপনারা এটি বিশ্বাস করতে পারবেন না। অনেক মরদেহ বহু আগে থেকে ধ্বংসস্তূপের নিচে ছিল। ধ্বংসস্তূপ সরাতে হচ্ছে।’

আন্তর্জাতিক বাহিনী গঠন শুরু

ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা অনুযায়ী, সংঘাত–পরবর্তী গাজার নিরাপত্তার জন্য একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী গঠন করা হবে। এই বাহিনী গঠনের কাজ শুরু হয়েছে বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ দুজন কর্মকর্তা। এরই মধ্যে যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণের জন্য ইসরায়েলে ২০০ সেনা পাঠানোর বিষয়ে রাজি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

ওই মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন, এই বাহিনীতে যোগ দেওয়া নিয়ে ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, কাতার, আজারবাইজানসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে কথা বলছে যুক্তরাষ্ট্র। বাহিনীটিকে সহায়তা করবে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের দুই ডজন সেনা।

আঞ্চলিক মিত্রদের সহায়তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী গঠনের কাজটি করতে চাইছে বলে জানান ওই দুই কর্মকর্তা। তাঁরা এ–ও বলেন, সংঘাত–পরবর্তী গাজায় কোনো বাসিন্দাকে জোর করে উপত্যকাটি থেকে বিতাড়িত করা হবে না। আর যেসব ফিলিস্তিনি হামাসকে হুমকি বলে মনে করবেন, তাঁদের জন্য গাজায় একটি নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলা হবে।

২৪ ফিলিস্তিনিকে হত্যা

১০ অক্টোবর গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২৪ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। বৃহস্পতিবার হামাসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দখলদার ইসরায়েলি শক্তি দিনরাত যুদ্ধবিরতির চুক্তি লঙ্ঘন করছে। চুক্তি লঙ্ঘনের এই ঘটনাগুলো নথিবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। সেগুলো যুদ্ধবিরতি আলোচনার মধ্যস্থতাকারীদের কাছে পাঠানো হবে।

এ ছাড়া চুক্তি অনুযায়ী গাজায় প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক ত্রাণ প্রবেশ করতে দেওয়ার কথা ইসরায়েলের। তবে সে পরিমাণ ত্রাণ পাচ্ছেন না গাজাবাসী। যেমন আজ স্থানীয় সময় সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মাত্র ১০০ ট্রাক ত্রাণ গাজায় প্রবেশ করে। ট্রাকগুলোর চালকেরা বলেন, গাজায় প্রবেশের আগে ট্রাকগুলো নিরীক্ষা করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে ইসরায়েলি সেনারা। এতে মূলত বিলম্ব হচ্ছে।

এরই মধ্যে আজও গাজার দক্ষিণে মিসর–নিয়ন্ত্রিত রাফা সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেছে ইসরায়েলি বাহিনী। তাঁদের ভাষ্য, গাজায় ত্রাণ যাবে শুধু ইসরায়েল–নিয়ন্ত্রিত কেরেম শালোম দিয়ে। এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা প্রধান টম ফ্লেচার বলেছেন, গাজায় আগের চেয়ে বেশি ত্রাণ প্রবেশ করছে এটা ঠিক। তবে তা প্রয়োজনের কাছাকাছিও নয়।

এই স্বল্প পরিমাণে ত্রাণ পেয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরেছে গাজাবাসীর মধ্যে। পরিচয় প্রকাশ না করে উপত্যকাটির এক ফিলিস্তিনি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আল্লাহর দয়ায় আমরা অবশেষে ত্রাণ পাওয়া শুরু করেছি। আমার সন্তানেরা খাবার পাচ্ছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। দোয়া করি, সামনের দিনগুলো যেন আমাদের ভালো কাটে।’