ইসরায়েলের হস্তান্তর করা ৩০ ফিলিস্তিনি বন্দীর দেহাবশেষ বুঝে নেওয়ার পর বিশ্রাম নিচ্ছেন হাসপাতালের এক কর্মী। গাজার নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্স; ৩১ অক্টোবর ২০২৫
ইসরায়েলের হস্তান্তর করা ৩০ ফিলিস্তিনি বন্দীর দেহাবশেষ বুঝে নেওয়ার পর বিশ্রাম নিচ্ছেন হাসপাতালের এক কর্মী। গাজার নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্স; ৩১ অক্টোবর ২০২৫

‘স্বপ্ন ছিল বুকে জড়িয়ে ধরার, এখন আশা দাফনটা যদি অন্তত করতে পারি’

সাদা রঙের দেয়াল ঘেরা সাদামাটা ছোট্ট একটি হলঘর। ডজনখানেক মা ও স্ত্রী চুপচাপ বসে আছেন সামনের সারিতে। বাবা, ভাই ও বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছেন পেছনের দিকে, দেয়াল ঘেঁষে। সবার চোখ স্থির ফিলিস্তিনের গাজার দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত খান ইউনিসের নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের ওই কক্ষের একটি স্ক্রিনের দিকে। সেখানে দেখানো হচ্ছে পচে-গেলে যাওয়া মরদেহের ছবি। এসব দেহাবশেষের কোনো একটি হয়তো তাঁদেরই এক প্রিয়জনের।

গাজার স্থানীয় কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে এখানে এসেছে পরিবারগুলো। নিবিষ্টভাবে ছবিগুলো দেখছেন পরিবারের সদস্যরা। এ আশায় যে, ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত এই ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যদি নিখোঁজ স্বজনকে শনাক্ত করা যায়।

মরদেহগুলো সম্প্রতি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সঙ্গে হওয়া বন্দী বিনিময় চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ হস্তান্তর করেছে। মরদেহগুলোতে নির্যাতন ও পচনের সুস্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে। তবে এগুলো ফেরত দেওয়া হয়েছে শনাক্তকরণের কোনো উপায় ছাড়াই। এমনকি মৃত্যুর তারিখ বা স্থানেরও উল্লেখ করা হয়নি।

গাজায় ডিএনএ পরীক্ষার সরঞ্জাম না থাকায় স্বজনদের জন্য তাঁদের প্রিয়জনকে শনাক্ত করার একমাত্র উপায় হলো পচে-গলে বিকৃত হয়ে যাওয়া মরদেহের ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখা। এটি যেমন নিদারুণ যন্ত্রণাভরা এক প্রক্রিয়া, ঠিক তেমনই আর কোনো উপায়ও নেই।

‘চুল থেকে জুতো— সব মনোযোগ দিয়ে দেখি’

পচাগলা মরদেহের ছবি দেখে পরিচয়ের সূত্র খুঁজতে থাকা শোকাহত মায়েদের একজন ওয়াফা আল-আলোউল। ৪৫ বছর বয়সী এই নারী বর্তমানে চিকিৎসার জন্য মিসরে রয়েছেন। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শনাক্ত করার অংশ হিসেবে মরদেহের ছবিগুলো অনলাইনে পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রকাশ করেছে। এরপর থেকে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছবিগুলো দেখছেন।

ওয়াফার ছেলে মোহাম্মদ আল–আলোউল কোনো চিহ্ন পান কি না খুঁজে দেখছেন। গত সেপ্টেম্বরে তাঁর ছেলে নিখোঁজ হয়েছিল। মিডল ইস্ট আই-কে তিনি বলেন, ‘আমি মরদেহগুলোর মধ্যে তার মুখটা খুঁজে বেড়াই।’

হামাসের সঙ্গে চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েল এখন পর্যন্ত ২৭০ জনের মরদেহ ফেরত দিয়েছে। এসব মরদেহের বেশিরভাগ পচে এতটাই বিকৃত হয়ে গেছে যে, শনাক্ত করার উপায় নেই। কিছু মরদেহের হাত-পা নেই, কিছু ছিল হাতকড়া পরা বা চোখ বাঁধা অবস্থায়। মরদেহগুলোতে নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার স্পষ্ট চিহ্ন দেখা গেছে।

মোহাম্মদের মা বলেন, ‘আমি চুল থেকে হাত, উচ্চতা এবং জুতো—প্রতিটি খুঁটিনাটি মনোযোগ দিয়ে দেখি। আর কেবলই হতাশায় ভেঙে পড়ি। আমার আত্মীয়রা ইসরায়েলের ফেরত দেওয়া মরদেহগুলো খুঁজেছে, কিন্তু তাঁরা তাকে খুঁজে পায়নি।’

হামাসের সঙ্গে চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েল এখন পর্যন্ত ২৭০ জনের মরদেহ ফেরত দিয়েছে। এসব মরদেহের বেশিরভাগ পচে এতটাই বিকৃত হয়ে গেছে যে, শনাক্ত করার উপায় নেই। কিছু মরদেহের হাত-পা নেই, কিছু ছিল হাতকড়া পরা বা চোখ বাঁধা অবস্থায়। মরদেহগুলোতে নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার স্পষ্ট চিহ্ন দেখা গেছে। এখন পর্যন্ত স্বজনদের মাধ্যমে মাত্র ৭৮ জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

‘স্বপ্ন ছিল বুকে জড়িয়ে ধরার’

গাজার উত্তরাঞ্চলের বেত লাহিয়ায় যে এলাকায় ওয়াফার পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল, সেখানে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে তিনি মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন। এরপর গত এপ্রিলে তাঁকে চিকিৎসার জন্য মিসরে সরিয়ে নেওয়া হয়।

সেই থেকে গাজায় থাকা সন্তানদের সঙ্গে আবার মিলিত হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে অপেক্ষা করছেন ওয়াফা। গত সেপ্টেম্বরে তিনি জানতে পারেন, তাঁর বড় ছেলে মোহাম্মদ নিখোঁজ। সদ্য বাস্তুচ্যুত হওয়া পরিবারের জন্য একটি অস্থায়ী আশ্রয় তৈরি করতে কাঠ ও ত্রিপল খুঁজতে বেরিয়েছিল সে। ওয়াফা বলেন, ‘পরিবারের কেউ শেষবারের মতো তাকে সেদিনই দেখেছিল।’

মোহাম্মদের মা বলেন, ‘পরিবারকে রক্ষা করার জন্য কিছু খুঁজতে সে এক আত্মীয়ের সঙ্গে বের হয়েছিল। তারা দুজনই নিখোঁজ হয়ে যায়, আর কখনো ফেরেনি। সেই থেকে আমি বুকভরা কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি।’

নিখোঁজ মোহাম্মদ আল-আলোউল

গত অক্টোবরে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরেও পরিবার কোনো খবর পায়নি। আত্মীয়রা সর্বত্র খুঁজেছে—   ভবনে, ধ্বংসস্তূপের নিচে, রাস্তার ধারে—   কিন্তু কোনো চিহ্নই মেলেনি।

ওয়াফা বলেন, ‘কেউ কেউ আমাদের বলেছে, ইসরায়েলি বাহিনী যখন পুরো রাস্তা বুলডোজার দিয়ে সমান করছিল, তখন হয়তো তাকে হত্যা করে বালিচাপা দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘হয়তো তার দেহ পুঁতে দেওয়া হয়েছে; হয়তো তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হয়তো সে জীবিত, কোথাও বন্দী আছে।’

কীভাবে আমি এমন এক মা হয়ে গেলাম, যে বিকৃত মরদেহগুলোর মধ্যে ছেলেকে খুঁজে পাওয়ার আশা করে। আর শুধু এটা জানার জন্য যে, কোথায় পড়ে আছে সে?
ওয়াফা আল-আলোউল, নিখোঁজ মোহাম্মদ আল–আলোউলের মা

ছেলের কথা স্মরণ করে শোকাহত মা বলেন, মোহাম্মদ ছিল শান্ত ও সহজ-সরল। যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে সে হাইস্কুলের পাঠ চুকিয়েছিল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা নিয়ে ভাবছিল।

ওয়াফা বলেন, ‘তার পড়াশোনা করে কাটানো রাতগুলো আমার মনে পড়ে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখতাম। আমাদের আর্থিক টানাপোড়েন ছিল। তাই সে আমাকে বলেছিল, টিউশনের টাকা জমানোর জন্য সে তার পড়াশোনা পিছিয়ে দেবে।’

এখন ওয়াফার দিন কাটছে নির্যাতিত বন্দীদের আর পচাগলা মরদেহের মধ্যে ছেলের খোঁজে। তিনি আরও বলেন, ‘কীভাবে আমি এমন এক মা হয়ে গেলাম, যে বিকৃত মরদেহগুলোর মধ্যে ছেলেকে খুঁজে পাওয়ার আশা করে। আর শুধু এটা জানার জন্য যে, কোথায় পড়ে আছে সে?’

মোহাম্মদের মা বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল গাজার বাইরে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরার। আর এখন আমি কেবলই তাকে কবর দেওয়ার সুযোগ চেয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি।’

ওয়াফার মতো একই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছে গাজার হাজারো পরিবার। তারা জানে না, তাদের প্রিয়জন নিহত হয়েছেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন নাকি ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে গুম হয়েছেন।

মরদেহ শনাক্তে ইসরায়েলের বাধা

গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা শুরু হওয়ার পর থেকে আনুমানিক ১০ হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাঁদের বেশির ভাগের মরদেহই ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি বা স্থাপনার ধ্বংসস্তূপের নিচে আছে বলে মনে করা হচ্ছে।

জেনেভাভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরের হিসাবে, তুলে নেওয়া প্রায় ২ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনি এখনো ইসরায়েলি হেফাজতে রয়েছেন। তবে তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।

স্ক্রিনে দেখানো পচে-গলে যাওয়া মরদেহের ছবি দেখে স্বজনদের শনাক্তের চেষ্টা। গাজার নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্স; ১৮ অক্টোবর ২০২৫

ওয়াফা বলেন, ‘মরদেহ শনাক্তকারী দলের দিকে তাকিয়ে আর বন্দীদের তালিকায় নজর রাখতে রাখতে এখন আমার সময় কাটছে।’ তিনি বলেন, ‘কখনো কখনো আমি বন্দীদের মধ্যে তার নাম দেখার আশা করি। আবার কখনো কখনো ভয়ে থাকি, নিহতদের ছবির মধ্যে যদি তাকে দেখি।’

গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার শিকার হয়েছেন প্রায় ৬৯ হাজার ফিলিস্তিনি। প্রায় দুই বছর ধরে চলা হামলায় অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় এখন মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থার ৯২ শতাংশেরও বেশি ধ্বংস হয়ে গেছে। এর মধ্যে পরিচয়হীন দেহাবশেষ শনাক্তের ফরেনসিক পরিষেবাও রয়েছে।

এদিকে যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও ইসরায়েলের অব্যাহত অবরোধের কারণে নতুন ফরেনসিক সরঞ্জাম, যেমন ডিএনএ পরীক্ষার যন্ত্র গাজায় প্রবেশ করতে পারছে না। এতে মরদেহ শনাক্ত করার প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।