অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লার পশ্চিমে ফিলিস্তিনি গ্রাম বেইত উর আল–ফৌকার কাছে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের জন্য নির্মাণাধীন নতুন সড়কের স্থানে বিক্ষোভ দেখাতে সমবেত হন ফিলিস্তিনিরা। এ সময় তাঁদের পাহারা দেন ইসরায়েলি সেনারা। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লার পশ্চিমে ফিলিস্তিনি গ্রাম বেইত উর আল–ফৌকার কাছে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের জন্য নির্মাণাধীন নতুন সড়কের স্থানে বিক্ষোভ দেখাতে সমবেত হন ফিলিস্তিনিরা। এ সময় তাঁদের পাহারা দেন ইসরায়েলি সেনারা। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

পশ্চিম তীর দখলে ইসরায়েলি পার্লামেন্টে বিল অনুমোদন, কাতার–সৌদি আরব–জর্ডানের নিন্দা

অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা নিয়ে একটি বিলে প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছে দেশটির পার্লামেন্ট নেসেট। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড কার্যত দখল বা সংযুক্তিকরণের সমান এ পদক্ষেপকে আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন বলে মনে করা হচ্ছে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তাঁর লিকুদ দলের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১২০ সদস্যের নেসেটে গত মঙ্গলবার ২৫–২৪ ভোটে বিলটি অনুমোদিত হয়। বিলটি আইন হিসেবে কার্যকর হওয়ার আগে মোট চার ধাপের ভোটাভুটির প্রথম ধাপ এটি।

নেসেটের এক বিবৃতিতে বলা হয়, জুদিয়া ও সামারিয়া (পশ্চিম তীরের) অঞ্চলে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রয়োগ করার জন্য বিলটি প্রাথমিকভাবে অনুমোদিত হয়েছে। এখন বিষয়টি আরও আলোচনার জন্য নেসেটের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কমিটিতে যাবে।

এ ভোট এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হলো, যখন এক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি ইসরায়েলকে অধিকৃত পশ্চিম তীর দখল করার অনুমতি দেবেন না। আবার ভোটের দিনই গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি জোরদার করতে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ইসরায়েল সফর করছিলেন।

এক বিবৃতিতে লিকুদ দল এ ভোটকে তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নষ্টের লক্ষ্যে বিরোধী দলের আরেক উসকানি হিসেবে বর্ণনা করেছে।

এ ভোট এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হলো, যখন এক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি ইসরায়েলকে অধিকৃত পশ্চিম তীর দখল করার অনুমতি দেবেন না। আবার ভোটের দিনই গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি জোরদার করতে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ইসরায়েল সফর করছিলেন।

দলের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সত্যিকার সার্বভৌমত্ব কাগজে–কলমে চোখধাঁধানো কোনো আইন পাসের মাধ্যমে নয়; বরং কার্যক্ষেত্রে সঠিকভাবে কাজের মাধ্যমেই অর্জিত হবে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, অধিকৃত পশ্চিম তীর সংযুক্ত করার অর্থ হলো, কার্যত জাতিসংঘের প্রস্তাবনায় উল্লেখিত ইসরায়েল–ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনাকে শেষ করে দেওয়া।

লিকুদ দলের সদস্যের সিদ্ধান্তমূলক ভোট

প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর জোটের অংশীদার জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন–গভিরের নেতৃত্বাধীন জিউইশ পাওয়ার এবং অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচের নেতৃত্বাধীন রিলিজিয়াস জায়োনিজম দলের কিছু সদস্য বিলটির পক্ষে ভোট দেন।

‘জনগণ ইতিমধ্যে তাদের মত দিয়েছে’, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে লেখেন স্মোট্রিচ। তিনি আরও লেখেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষদের উত্তরাধিকার জুদিয়া ও সামারিয়ার সম্পূর্ণ ভূখণ্ডে পূর্ণ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার সময় এসেছে এবং শক্ত অবস্থানে থেকে প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’

জনগণ ইতিমধ্যে তাদের মত দিয়েছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের উত্তরাধিকার জুদিয়া ও সামারিয়ার সম্পূর্ণ ভূখণ্ডে পূর্ণ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার সময় এসেছে এবং শক্ত অবস্থানে থেকে প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
বেজালেল স্মোট্রিচ, ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী

বিলটি উত্থাপন করেছিলেন কট্টর দক্ষিণপন্থী নোআম পার্টির নেতা আভি মাওজ। তাঁর দল সরকারে নেই। বেশির ভাগ লিকুদ সদস্য ভোটে অংশ নেননি বা ভোটে উপস্থিত ছিলেন না। তবে দলটির একজন সদস্য ইউলি এডেলস্টাইন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর অবস্থান উপেক্ষা করে বিলের পক্ষে ভোট দেন।

পরে এডেলস্টাইন এক্সে লেখেন, ‘এ মুহূর্তে আমাদের মাতৃভূমির সর্বত্র ইসরায়েলি সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করাই সময়ের দাবি।’

বিরোধী দলের প্রস্তাবিত আরেকটি বিল নেসেটে পাস হয়েছে। পশ্চিম তীরের মালে আদুমিম নামের একটি ইসরায়েলি বসতি সংযুক্ত করা নিয়ে বিলটি উত্থাপন করা হয়।

পশ্চিম তীরের বেদুইন গ্রামে ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন এক ফিলিস্তিনি। গ্রামটির কাছে অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা একটি তল্লাশি ফাঁড়ি বসালে সেখান থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা পালিয়ে যান

গত আগস্টে ইসরায়েল মালে আদুমিম ও জেরুজালেমের মাঝখানের এলাকায় একটি বৃহৎ বসতি স্থাপন প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আগে থেকেই সতর্ক করেছিল, এ প্রকল্প ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা ধ্বংস করবে।

আন্তর্জাতিক আইনের প্রকাশ্য লঙ্ঘন

নেসেটের ভোটে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, হামাস, কাতার, সৌদি আরব ও জর্ডান।

ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা নেসেটের ফিলিস্তিনি ভূমি সংযুক্ত করার চেষ্টা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, জেরুজালেম ও গাজা উপত্যকা এবং পশ্চিম তীরের অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড একটি অবিচ্ছিন্ন ভৌগোলিক এলাকা। এর ওপর ইসরায়েলের কোনো সার্বভৌমত্ব নেই।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, অধিকৃত পশ্চিম তীর সংযুক্ত করার অর্থ হলো, কার্যত জাতিসংঘের প্রস্তাবনায় উল্লেখিত ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনাকে শেষ করে দেওয়া।

ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস এক বিবৃতিতে বলেছে, এসব বিল দখলদার ঔপনিবেশিক শক্তির কুৎসিত চেহারা প্রকাশ করেছে। সংগঠনটি বলেছে, ‘দখলদার ইসরায়েলের পশ্চিম তীরের ভূমি দখলের জোরাল চেষ্টা অবৈধ বলে আমরা ঘোষণা করছি।’

কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সবচেয়ে কড়া ভাষায় এ পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলেছে, এটি ফিলিস্তিনি জনগণের ঐতিহাসিক অধিকারের প্রকাশ্য লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি চ্যালেঞ্জ।

সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি দখলদার কর্তৃপক্ষের পরিচালিত সব ধরনের বসতি সম্প্রসারণ ও দখলদারী তারা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করছে।

ইসরায়েলি হামলার মুখে শরণার্থীশিবির ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। পশ্চিম তীরের জেনিনে

জর্ডানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও নেসেটের ভোটের নিন্দা জানিয়েছে। এক্সে দেওয়া বিবৃতিতে তারা বলেছে, এটি আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি দুই রাষ্ট্র সমাধানের ভিত্তি নষ্ট করবে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের অবিচ্ছেদ্য আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও ১৯৬৭ সালের ৪ জুনের সীমারেখার ভিত্তিতে জেরুজালেমসহ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকারে হস্তক্ষেপ।

উল্লেখ্য, পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বর্তমানে সাত লাখের বেশি ইসরায়েলি অবৈধ বসতিতে বাস করছেন। আন্তর্জাতিক আইনে পশ্চিম তীরের সব ইসরায়েলি বসতিই অবৈধ।

২০২৪ সালে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছিলেন, ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল ও সেখানে বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী এবং যত দ্রুত সম্ভব তা অপসারণ করতে হবে।