
নীতি পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইরানে প্রায় চার মাস ধরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। অপর দিকে দেশটির সরকার বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করছে। সবশেষ গতকাল সোমবার নতুন করে তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কথা জানিয়েছে ইরানের বিচার বিভাগ। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত বিক্ষোভে সংশ্লিষ্ট ঘটনায় ১৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আছেন চিকিৎসক, র্যাপার, কারাতে চ্যাম্পিয়ন, নাপিত ও অভিনেতা। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে গত ডিসেম্বরে তড়িঘড়ি দুজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ৭ জানুয়ারি আরও দুজনের একই পরিণতি হয়। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অনেকে ফাঁসি কার্যকর হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইরানে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
পুলিশি হেফাজতে গত সেপ্টেম্বরে কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যুর পর ইরানে বিক্ষোভ শুরু হয়। সরকারবিরোধী এ বিক্ষোভ ক্রমে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
নিউইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদনটি তৈরি করতে গিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কয়েকজনের বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। পাশাপাশি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্যগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে ফাঁসির ঝুঁকিতে থাকা কয়েকজনের তথ্য তুলে ধরেছে নিউইয়র্ক টাইমস।
বিক্ষোভে অংশগ্রহণের পর গত ২৩ সেপ্টেম্বর তেহরান থেকে সাহান্দ নুরমোহাম্মদ-জাদেহ গ্রেপ্তার হন। তার বিরুদ্ধে একটি ময়লার বাক্স ও টায়ার পুড়িয়ে দেওয়ার এবং হাইওয়ে রেল ধ্বংস করে দেওয়ার অভিযোগ করা হয়। তাঁর আইনজীবী বলেছেন, নুরমোহাম্মদের বিরুদ্ধে আদালতে প্রমাণ হিসেবে ঝাপসা ভিডিও ফুটেজ উপস্থাপন করা হয়েছে, সেটির ভিত্তিতে তাঁকে অপরাধী হিসেবে শনাক্ত করা যায় না।
পরিবারের সঙ্গে ফোনালাপে নুরমোহাম্মদ বলেছিলেন, গ্রেপ্তারের দিনেই বলে দেওয়া হয়েছে, তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। বিবিসির পারসি ভাষার সংস্করণে ফোন রেকর্ডটি প্রকাশ করা হয়েছিল।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন পোস্ট থেকে জানা গেছে নুরমোহাম্মদ-জাদেহ একজন বডিবিল্ডার। জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তিনি জয়ী হয়েছেন।
সাহান্দ নুরমোহাম্মদ ছোট একটি সোনার দোকানে কাজ করতেন। সেপ্টেম্বরে ওই দোকানের কাছেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। জাদেহ বলেছেন, ঘটনার দিন তিনি শুধু শপিং মলের বাইরে থাকা একটি ডাস্টবিনে লাথি দিয়েছেন এবং আগে থেকেই ভাঙা রেললাইন সরিয়ে নিয়েছিলেন। বিবিসির পারসি সংস্করণে এ–সংক্রান্ত একটি অডিও টেপ প্রকাশিত হয়েছিল।
তাঁকে নির্দোষ দাবি করে শপিং মলটির শতাধিক কর্মী ও দোকানি আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন।
অক্টোবরের শেষের দিকে তেহরান থেকে মাহান সাদরাত মারানিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে আধা সামরিক স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী বাসিজের এক সদস্যের ওপর ছুরি নিয়ে আক্রমণ, মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ এবং একটি মুঠোফোন ক্ষতিগ্রস্ত করার অভিযোগ আনা হয়।
অ্যামনেস্টি বলছে, নিম্নমানের ভিডিও ফুটেজের ওপর নির্ভর করে আদালতে প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে। ওই ফুটেজে কোনো ছুরি দেখা যাচ্ছে না।
যে বাসিজ সদস্য মারানির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন, পরে তাঁকে ফাঁসি থেকে বাঁচানোর চেষ্টায় অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। ফাঁসিতে ঝোলানোর কয়েক ঘণ্টা আগে সাদরাত মারানির সাজা স্থগিত করা হয়। তবে তাঁর পরিণতি এখনো অনিশ্চিত।
মারানির জীবন বাঁচাতে তাঁর দাদি-নানিরা ভিডিও আবেদন জানিয়েছেন। তাঁদের ভাষ্য, মারানি বডিবিল্ডার হিসেবে প্রশিক্ষণ দিতেন। মা-বাবা আর বোনদের সঙ্গে থাকতেন তিনি। পরিবারের খরচ জোগাতে তিনটি চাকরি করতেন তিনি।
তেহরানের কাছে পাকদাশত এলাকা থেকে মোহাম্মদ বোরোঘানি গ্রেপ্তার হন। চাপাতি বহন, গভর্নরের ভবনে আগুন দেওয়া ও দায়িত্বরত এক কর্মকর্তাকে ছুরিকাঘাতে আহত করার অভিযোগ করা হয়েছে। ইনস্টাগ্রাম বার্তাকে উদ্ধৃত করে আদালত তাঁকে পাকদাশতে দাঙ্গার নেতা হিসেবে উল্লেখ করেছে।
বয়স ১৮ হওয়ার পর থেকে নিজের জীবন নিয়ে র্যাপ গাওয়া শুরু করেন তিনি।
ইরানি সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে, বোরোঘানির বাবা বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহীত লোহার বর্জ্য বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
২ জানুয়ারি ইরানের সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছেন বোরোঘানির বিরুদ্ধে আগের রায় বহাল থাকবে।
২২ সেপ্টেম্বর তেহরান থেকে মোহাম্মদ ঘোবাদলু গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে গাড়িচাপা দেওয়া, এক ব্যক্তিকে হত্যা এবং আরও পাঁচজনকে আহত করার অভিযোগ দায়ের হয়। একটি স্বীকারোক্তিকে প্রমাণ হিসেবে আমলে নিয়েছেন আদালত। তবে অ্যামনেস্টি বলছে, নির্যাতনের মধ্য দিয়ে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে।
ঘোবাদলু তেহরানের একটি সেলুনে কাজ করতেন।
২৪ ডিসেম্বর ইরানের সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছেন, ঘোবাদলুর বিরুদ্ধে রায় বহাল থাকছে।
২৪ বছরের সামান সিদি পেশাগতভাবে ইয়াসিন নামে পরিচিত। গত ২ অক্টোবর তেহরান থেকে তিনি গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে পিস্তল বহন এবং বিক্ষোভ চলার সময় তিনবার ফাঁকা গুলি ছোড়ার অভিযোগ করা হয়েছে। একটি স্বীকারোক্তিকে প্রমাণ হিসেবে আমলে নিয়েছেন আদালত। তবে অ্যামনেস্টি বলছে, নির্যাতনের মধ্য দিয়ে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে।
র্যাপার ও গ্রাফিকশিল্পী সিদি ইরানের সংখ্যালঘু কুর্দি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। তিনি তাঁর মা-বাবা ও দুই বোনের সঙ্গে থাকতেন। ইনস্টাগ্রামে নিজের বিভিন্ন মিউজিক ভিডিও শেয়ার করতেন তিনি। কুর্দি ভাষায় সামাজিক অন্যায়-অবিচার নিয়ে র্যাপ করতেন সিদি। তাঁর বাবা ইরান-ইরাক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত এক ভিডিওতে সিদির মা বলেন, ‘আমার ছেলে একজন শিল্পী, আমার ছেলে দাঙ্গাবাজ নয়।’
হামিদ ঘারে হাসানলু গত ৪ নভেম্বর তেহরানের খুব কাছের এলাকা কারাজ থেকে গ্রেপ্তার হন। বিক্ষোভ চলার সময় এক বাসিজ সদস্যকে হত্যা করার অভিযোগে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। তাঁর স্ত্রী ফারজানেহকেও (৪৬) ২৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কারাভোগের সময় তাঁর সঙ্গে কারও দেখা করাও নিষেধ।
অ্যামনেস্টি বলছে, নির্যাতন করে ফারজানেহর কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। সে স্বীকারোক্তিকেই প্রমাণ হিসেবে আমালে নিয়েছেন আদালত। যদিও ফারজানেহ পরে সে স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করে নেন।
গ্রেপ্তারের আগের দিন ঘারে হাসানলু ও তাঁর স্ত্রী গাড়ি চালিয়ে কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন। পথে বিশাল বিক্ষোভ চলার কারণে তাঁরা গাড়ি নিয়ে সামনের দিকে যেতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে তাঁরা গাড়ি রেখে হাঁটতে শুরু করেন। হামিদ ঘারের সহকর্মী ও অ্যামনেস্টি বলছে, সেদিন তাঁরা এক বাসিজ সদস্যের সঙ্গে অন্য মানুষদের হাতাহাতির মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন।
রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, হামিদ ঘারে হাসানলু ওই বাসিজ সদস্যের ওপর আক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।
গত ৩ জানুয়ারি ইরানের সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছে, তদন্তজনিত তথ্যের ঘাটতি থাকায় তাঁরা হাসানলুর বিরুদ্ধে দেওয়া রায় বহাল রাখছেন না। এখন মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য আবারও আগের বিচারপতির কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ এ চিকিৎসক এখনো ফাঁসির ঝুঁকিতে আছেন।
হোসেন মোহাম্মদি গত ৫ নভেম্বর কারাজে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। কারাজে বিক্ষোভ চলার সময় এক বাসিজ সদস্যকে হত্যার দায়ে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অ্যামনেস্টি বলছে, তাঁর কাছ থেকে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করে তা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছে। সে স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেই তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন আদালত।
পুরস্কার বিজয়ী মঞ্চ অভিনেতা মোহাম্মদি কবিতা লিখতেন, গান গাইতেন। বেশ কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ও নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। স্থানীয় শিল্প উৎসবে তিনি সেরা অভিনেতার পুরস্কারও জিতেছেন।
গত ৩ জানুয়ারি ইরানের সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছে, তদন্তজনিত তথ্যের ঘাটতি থাকায় তাঁরা মোহাম্মদির বিরুদ্ধে দেওয়া রায় বহাল রাখছেন না। এখন মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য আবারও আগের বিচারপতির কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ তিনি এখনো ফাঁসির ঝুঁকিতে আছেন।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর মানুচেহের মেহমান নাভাজ তেহরান প্রদেশ থেকে গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে একটি সরকারি ভবন ও কয়েকটি গাড়িতে আগুন দেওয়া এবং নিরাপত্তা ফাঁড়িতে আক্রমণের অভিযোগ করা হয়েছে। বন্ধুকে নাভাজের পাঠানো একটি খুদে বার্তা এবং ঝাপসা ফুটেজকে প্রমাণ হিসেবে আমলে নিয়ে আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। আদালতে কৌঁসুলিরা অনুরোধ করেছেন, নাভাজ যেখানে অগ্নিসংযোগ করেছেন, সেখানেই যেন তাঁকে প্রকাশ্য ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
ইরানে বিক্ষোভের ঘটনায় এ পর্যন্ত চারজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন মোহাম্মদ মেহদি কারামি (২২), সায়িদ মোহাম্মদ হোসেইনি (৩৯), মোহসেন শেকারি ও মাজিদ রেজা রাহনাভার্দ।
সোমবার যে তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাঁদের আপিলের সুযোগ আছে। তাঁরা হলেন সালেহ মিরহাশেমি, মাজিদ কাজেমি ও সাঈদ ইয়াঘুবি। ‘খোদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’-এর অভিযোগে তাঁদের সাজা দেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত ২ জানুয়ারি ইরানের ভিন্নমতাবলম্বী লেখক ও চিত্রকর মেহেদি বাহমানকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তেহরানের একটি ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।
অ্যামনেস্টির ভাষ্য, ইরানে আরও বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ করা হয়েছে। তাঁদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধে ‘খোদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’-এর মতো অভিযোগ করা হয়েছে। ইরানে এ ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে সাধারণত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়ে থাকে।