গত চার বছরে একজন মানুষ বছরে গড়ে ১৯ দিন জীবন বিপন্নকারী তাপমাত্রার সম্মুখীন হয়েছে
গত চার বছরে একজন মানুষ বছরে গড়ে ১৯ দিন জীবন বিপন্নকারী তাপমাত্রার সম্মুখীন হয়েছে

দ্য ল্যানসেট–এর গবেষণা

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে মিনিটে ১ জনের মৃত্যু

উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বে প্রতি এক মিনিটে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের প্রতি আগ্রহের কারণে মারাত্মক বায়ুদূষণ ও দাবানল হচ্ছে এবং ডেঙ্গুর মতো রোগ বাড়ছে। উষ্ণতা বৃদ্ধি ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় বিশ্বে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব নিয়ে করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বখ্যাত স্বাস্থ্য সাময়িকী দ্য ল্যানসেট এ গবেষণা করেছে।

‘দ্য ২০২৫ এডিশন অব দ্য ল্যানসেট কাউন্টডাউন অন হেলথ অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি গত মঙ্গলবার ল্যানসেট-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল)। গবেষণায় সহযোগিতা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। বিশ্বের ৭০টির বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার ১২৮ জন বিশেষজ্ঞ এ গবেষণায় যুক্ত ছিলেন।

গবেষণায় যুক্ত অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অলি জে বলেন, বছরজুড়ে প্রতি মিনিটে গড়ে একজন মানুষ তাপজনিত বিভিন্ন কারণে মারা যাচ্ছে। এটি সত্যিই চমকে দেওয়ার মতো একটি পরিসংখ্যান। এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। অলি জে বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, তাপজনিত চাপ (হিট স্ট্রেস) সবাইকেই প্রভাবিত করতে পারে। এমনকি এটি প্রাণঘাতীও হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় অনেক মানুষ সেটা বুঝতে পারে না। অথচ প্রতিটি তাপজনিত মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো নেতাদের জলবায়ু নীতিমালা বাতিল করা ও তেল কোম্পানিগুলোর নতুন মজুত উত্তোলন অব্যাহত রাখায় স্বাস্থ্যের ক্ষতি আরও বাড়বে।

গবেষকদের মতে, ২০২৩ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোকে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ কোটি ডলার ভর্তুকি দিয়েছে। অন্যদিকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মানুষ কৃষিক্ষেত্র ও নির্মাণস্থলে কাজ করতে না পারায় প্রায় একই পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে কয়লার ব্যবহার কমে যাওয়ায় প্রতিদিন প্রায় ৪০০ মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন দ্রুত বাড়ছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান যে হারে জীবাশ্ম জ্বালানিতে অর্থায়ন হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে একটি স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ গঠন করা অসম্ভব।

ইউসিএলের মারিনা রোমানেলো গবেষক দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটি (প্রতিবেদনটি) বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া ধ্বংসাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির একটি অন্ধকার ও অকাট্য চিত্র তুলে ধরেছে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের আগ্রহ থেকে সরে না আসা পর্যন্ত জীবন ও জীবিকার এই ক্ষতি বাড়তেই থাকবে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত চার বছরে একজন মানুষ বছরে গড়ে ১৯ দিন জীবন বিপন্নকারী তাপমাত্রার সম্মুখীন হয়েছে। এর মধ্যে ১৬ দিন এমন তাপমাত্রা ছিল মানবসৃষ্ট। আর উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ২০২৪ সালে ৬৩ হাজার ৯০০ কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জিডিপির ৬ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে।

ল্যানসেট-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাগামহীনভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোয় শুধু পৃথিবী উত্তপ্তই হচ্ছে না, বায়ুদূষণও হচ্ছে। এসব কারণে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। ক্রমবর্ধমান গরম ও শুষ্ক পরিবেশের কারণে সৃষ্ট দাবানলের ধোঁয়ায়ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এসব কারণে ২০২৪ সালে রেকর্ড ১ লাখ ৫৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

এত সব ক্ষতির পরও ২০২৩ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জীবাশ্ম জ্বালানিতে ৯৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলার ভর্তুকি দিয়েছে। ওই বছর বিশ্বে সর্বোচ্চ গরম রেকর্ড করা হয়। অবশ্য ২০২৪ সাল গরমের সেই রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে যুক্তরাজ্য জীবাশ্ম জ্বালানিতে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ও অস্ট্রেলিয়া ১ হাজার ১০০ কোটি ডলার ভর্তুকি দিয়েছে। অপর দিকে সৌদি আরব, মিসর, ভেনেজুয়েলা, আলজেরিয়াসহ ১৫টি দেশ তাদের জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেটের চেয়ে বেশি অর্থ জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকির পেছনে ব্যয় করেছে।

মারিনা রোমানেলো বলেন, ‘আমরা দেখছি, অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা, সরকার ও করপোরেশন জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে করা অঙ্গীকার থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে; যা মানুষকে আরও বেশি ঝুঁকির মুখে ফেলছে।’