লোকে কী বলবে। কী ভাববে। লোকে যদি ভালো বলে, তবেই তা ভালো! জীবনে প্রত্যেকটা বিষয়ে আমাদের অন্য মানুষের অনুমোদন প্রয়োজন। এই একটা ভাবনা থেকে আমরা আমাদের জীবন যতই অসুখের হোক, তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি না। আবার নিজের যা আছে, তা নিয়েও নিজের মতো করে সুখী থাকতে পারি না। উল্টো আপ্রাণ চেষ্টা থাকে লোক দেখানোর, সব ঠিক আছে। ধুঁকে ধুঁকে জীবনটাকে শেষ করে দিই, অব্যবস্থাপনা আর টানাপোড়েনের মাঝে। একটা ভুল জীবনযাপন করি, শুদ্ধ করি না, কারণ জানাজানি হলে লোকে কি বলবে? দিনে দিনে জীবন হয়ে পড়ে জটিল থেকে জটিলতর। তারপর একদিন জীবনটাই শেষ।
জীবনটা আপনার। তাই সুখ–দুঃখ তো আপনিই অনুভব করবেন। লোককে সুখী দেখানোর জন্য তিলে তিলে আপনি নিজেকে শেষ করে দেবেন না। শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রে নয়, নর–নারী সবাই জীবনের বিভিন্ন সমস্যার মধ্য দিয়ে যান। কিন্তু লোকে কি বলবে? এই একটা ভাবনা থেকে বের হয়ে, জীবনে একটা পজ বাটন টেনে কোনো অপশন পছন্দ করেন না। আমরা যা-ই করি, তা যেন বাইরের মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে করি। কাজটা করে নিজে সুখী বা তৃপ্ত কিনা, সে ব্যাপারে মনোযোগ থাকে না বা থাকলেও তা অতি নগণ্য। সব ক্ষেত্রে বাইরের মানুষের এই অনুমোদন কি আসলে জরুরি? নাকি নিজে সুখী কি না, সেটা দেখা জরুরি?
ক্যালিফোর্নিয়ায় এক সভায় সিস্টার শিভানী বিষয়টি নিয়ে একটা সুন্দর উদাহরণ দিয়েছেন, ‘এক অফিসে ১০ জন লোকের মধ্যে আটজনই খুব অনৈতিক কাজ করে, মাত্র দুজন সৎ। তারা তাদের সততা দিয়ে কাজ করে যায়। এখন, বাকি আটজন তাদের সম্পর্কে কি ভাববে? তারা আলাদা থাকবে, না ওই আটজনের সঙ্গে সন্ধি করবে, তাদের অনুমোদনে জীবন চালাবে? তারা তাদের মতোই রয়ে গেল। কারণ তারা নিজের কাজে সৎ থেকে যদি মনে সুখ পায়, তাহলে তো তাদের ওই আটজনের সমর্থন প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নিজের মনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। এভাবে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে প্রয়োজন নিজের প্রাধান্য, লোকের নয়।
শিভানী আরও একটা কথা বলেছেন, বাইরের মানুষজন যখন কোনো ব্যাপারে রসিক হিসেবে সমর্থন দেয়, তখন আমরা খুশি হই। এই মনোভাব খুব ছোটবেলায় আমাদের মাতা-পিতা মস্তিস্কে ‘প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে কোডিং’ করে দেন। যেমন ঘরে অতিথি এলে বলা হতো, একটা ছড়া বা গান বলো। তোমার পরীক্ষার ফল দেখাও। সেটা শুনে তারা বাহবা দিলে আমাদের মা-বাবা বেশি খুশি হতেন বা হন। ঠিক তখনই আমরা শিখতে থাকি, আমরা কিছু করব, তাহলে বাইরের মানুষ ভালো বলবে, যা পরোক্ষভাবে জীবনকে দাঁড় করায় ভুল এক স্থানে।
সামনে ঈদ উৎসব আসছে, এটি আনন্দের ব্যাপার। সবাই একত্র হয়ে উদ্যাপন করব। কিন্তু তা এখনই হয়ে উঠছে চাপের বিষয়। বাজেট ঠিক থাকবে কি না? কাকে কী দেব? দিলেও পছন্দ হবে কি না? প্রতি মুহূর্তে চাপ।
আমরা খুশি থাকব। কিন্তু খুশি কি আদৌ থাকা যায়? পরিবারের সবাই খুশি হলেও পরিবারের কর্তা ব্যক্তিটি জানেন এই সুখের মূল্য দিতে গিয়ে তাকে প্রতিদিন কী পরিমাণ চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। রক্তচাপ বাড়ছে, আয়ুক্ষয়ে আসছে, সবার তো দুঃখী হওয়ার কথা। কিন্তু সে দুঃখ দেখেও কেউ অনুভব করছে না। যে গৃহকর্ত্রী পাশের বালিশে মাথা রেখে শুয়ে আছেন, তিনিও হয়তো জানেন না বা জানতে চান না। তিনি নিজেই একটা বড় চাপ দিয়ে রেখেছেন। ‘এবার ঈদে কাঞ্চি ভরম কাতান চাই, পাশের ফ্ল্যাটের ভাবি একটা দুটা নয়, অনেক শাড়ি কেনেন ঈদে। আমি একটা ভালো শাড়ি না কিনলে সমাজে সম্মান কি থাকে?’—এ রকম সবারই একটা না–একটা বিষয় থাকে। শুধু পোশাক কেন, আজকাল ঘরের ডেকোরেশন, আসবাব পরিবর্তনের বায়না–বাসনা থাকে। এসব চাহিদা পূর্ণ করতে গিয়ে একজন সৎ মানুষও অসৎ হয়ে যান।
চিন্তা করুন, আমরা একটা শাড়ি নিজের খুশির জন্য কিনি না, কিনি অন্যজন সেই শাড়ি দেখে আমাকে বাহবা দেবে কি, দেবে না—তার ওপর ভিত্তি করে? তার অর্থ, বাইরের মানুষকেই আমার প্রাধান্য দিচ্ছি, আমাকে নয়। তারা ভালো বললে, তবেই আমরা খুশি হই। অবস্থা কেমন হওয়া উচিত ছিল, নিজের যে বাজেট তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে, নিজের ভালো লাগে সে রকম স্বল্প মূল্যের কিছু কিনে চাপমুক্ত থাকা।
অথচ প্রতিনিয়ত নিজেকে চাপের ভেতর ফেলছি। লোকে কী বলবে? খুব সত্য কথা, একটু ভাবলে দেখা যাবে যাদের খারাপ বলার, তারা যতই ভালো করেন, ভালো পরেন—একটা ত্রুটি খুঁজবেই। তাহলে কেন আমরা ভাবব, লোকে কি বলবে? জীবনের দৈনন্দিন অনেক ক্ষেত্রে আমি দেখেছি, সামর্থ্য নেই একটা কেক বাচ্চার জন্য নিয়ে আসার, কিন্তু সোনার জিনিস বন্ধক রেখেও জন্মদিন পালন করছেন। এই তো কিছুদিন আগে এক বন্ধু আমাদেরই আরেক পরিচিত একজনের গল্প করল, ধার করে মেয়েকে জন্মদিনে ল্যাপটপ কিনে দিয়েছে। মেয়ে ছোট, তার সে ল্যাপটপ দিয়ে গেম খেলা ছাড়া করার মতো তেমন কিছু নেই।
একটা মেয়ের বিয়ে না হলে, তেমন কোনো সমস্যা তার হয়তো হচ্ছে না। কিন্তু লোক কী বলবে এ ভাবনায় মেয়ের মা–বাবা কুণ্ঠিত সব সময়। ঘরে বসিয়ে রাখার চেয়েও জরুরি বিয়ে দিয়ে দেওয়া। বর চোর, লুচ্চা, বদমাশ হলেও সমস্যা নেই। লোকে তো বলবে না, মেয়ে বিয়ে দিতে পারেনি, এখানেও লোকের প্রাধান্য। সমাজের অসংগতিপূর্ণ ঘটনা বাদ দিই। খেয়াল করলে দেখবেন, একটু বেশি বয়সে কোনো গৃহিণী যদি সন্তান সম্ভাব্য হয়ে পড়েন, সে বাচ্চা গর্ভপাত করান। কারণ এই বয়সে মা হলে লোকে কী বলবে? দেখেন, এই একটা ভাবনা থেকে নিজের সন্তানকে মেরে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করেন না।
আমাদের খুশি থাকার জন্য, ভালো থাকার জন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন নিজের মনের সমর্থন। জীবন আসলে খুব সহজ সুন্দর, যদি তা নিজের মধ্যে ধারণ করা যায়। মেনে নেওয়া যায়, আমি যেভাবে আছি ভালো আছি, কাউকে দেখানোর প্রয়োজন নেই যে, আমার কি আছে! আমি আমার স্বল্পতে খুশি, আমার বাইরের মানুষের অনুমোদন প্রয়োজন নেই। কে কী ভাবল, তাতে আমার কী আসে যায়? বাইরের লোকের নয়, নিজের জীবনে নিজের চিন্তাগুলোকে মূল্যায়ন করাটা জরুরি।
‘হৃদয়ে বুদ্বুদ মতো
উঠে চিন্তা শুভ্র কত,
মিশে যায় হৃদয়ের তলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।’