কবিতার এক পাতা

>কবিতা মানুষের মনোজগতে বিচরণ করা মানুষ, প্রকৃতি, প্রতিবেশ সম্পর্কিত ভাবনার ব্যঞ্জনাময় শৈল্পিক প্রকাশ। কবিতা একজন কবিকে মর্ত্যলোকেই এক অমর্ত্যলোকের সন্ধান দেয়। কবি ধ্বনির ব্যঞ্জনার পথ ধরে অমৃতলোকে প্রবেশ করেন এবং তাঁর পাঠককে সেই আনন্দ ভ্রমণের সাথি করে নেন। ‘কবিতার এক পাতা’ তার অভিযাত্রার প্রথম বর্ষ পূরণ করল। বর্ষপূর্তি সংখ্যাটিকে একটু অন্যরকম করে দেখার চেষ্টায় ঋতু বৈচিত্র্য বিশেষত: পূর্বের হেমন্ত ও পশ্চিমের ফল ঋতুকে এক পাতায় মেলে ধরা হলো। এই এক বছরের পথ পরিভ্রমণে ‘কবিতার এক পাতা’ আমেরিকা ছাড়াও বাংলাদেশসহ দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের বাঙালি কবিগণের কবিতা পাঠকগণের সামনে মেলে ধরার প্রয়াস পেয়েছে। কাব্যচর্চায় সনিষ্ঠ মনঃসংযোগ তৈরির উদ্দেশ্যে মানসম্পন্ন ভালো কবিতা প্রকাশে সচেষ্ট থেকেছে। কাব্য রসিকগণ পাঠে আনন্দ পেয়ে থাকলে আমাদের চেষ্টা ও পরিশ্রম সার্থক বিবেচনা করা হবে। যাঁদের কবিতা দিয়ে বছরজুড়ে পাতাটি সাজানো হয়েছে, তাঁদের অভিনন্দন এবং আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। যাঁরা কবিতাগুলো পড়েছেন, শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, উৎসাহ জুগিয়েছেন, তাঁদের সবাইকে আমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।—ফারুক ফয়সল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ইকবাল হাসান
আষাঢ় শ্রাবণ এলে

মাঝে মাঝে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে
সহসাই দৃশ্যচিত্রে ঢুকে যায় আষাঢ় শ্রাবণ
মগজের ভেতরে ওড়ে শুভ্র কাশফুল
হালকা মেঘেরা ওড়ে স্বপ্ন ও বাস্তবে
প্রকৃত প্রস্তাবে, এই সব সজল ও ঘন
মুখর ও সঙ্গীতময় মেঘেরা
উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে মগজের
ভেতরে ঢুকে যায়, তারপর
যা হবার তাই হয়-
বৃষ্টি, বৃষ্টি
শিবকুমার শর্মার সন্তুরের মতো অবিরাম বাজে
শ্রাবণ ধারার এই ধ্রুপদি নিক্কনধ্বনি
থামার নামগন্ধ নেই
এই সুদূর প্রবাসে
তবে, সত্যি বলতে কী, এসবই ভাবনায় ঘটে
আর ওদিকে ঢাকার রাস্তায় আমার আত্মীয়-দূরাত্মীয়রা
আষাঢ় ও শ্রাবণ এলে এক হাঁটু জলে ম্যানহোলে হাবুডুবু খায়।

শামস আল মমীন
ও কদম ফুল, ও বন্ধু আমার
(বন্ধুর পাঠানো কদম ফুলের ছবি দেখে)

এই তো আছি, বেশ আছি
গাছে গাছে পাতাহীন ডালগুলো
শতায়ু বৃদ্ধের মতো মাঝে মাঝে নড়ে ওঠে
মা’র হাত ধরে হেঁটে যাওয়া ছোট্ট মেয়েটি কি বুঝতে পারে
কি মায়া ছড়িয়ে দিচ্ছে সে পিতার পরানে।
বৃষ্টির শাসন মেনে
চিলেকোঠায় বসে বসে স্বপ্ন দেখে ভীরু দোয়েল।
হেমন্তের রোদ এসে ছুঁয়ে যায় মাঠ ভরা শস্য ঘ্রাণ। এমন দিনে
জানালার গ্রিল ধরে কি ভাবে নতুন বধুয়া. .
ও বন্ধু আমার...
দূর দেশের কদম ফুল, কি প্রিয়,
কি প্রিয় যে টলমল জলে।

ফকির ইলিয়াস
পরিণত পাতার বেদনা

কোথাও মাঠ জুড়ে উঠছে ফসল, নবান্নের ঘ্রাণ
কোথাও পড়ছে পাতা, লাল হয়ে ঝরছে আসমান
কে ছড়াচ্ছে এমন রং যথাতথা-
কে এঁকে রাখছে বেদনার রং খুলে এই খাতা
যদি বলি হেমন্ত, যদি বলি এই ফিরে আসা
অথবা মাটির প্রতি রৌদ্রের স্থায়ী ভালোবাসা।

এই যে বিদায় বন্ধু! এই যে ঘোরের আবর্তন
তাকে কি বলবে না তুমি দ্বার খোলা জলের সদন
যদি তাই বলো, তবে এসো রাঙাই এ পথ
যারা হেঁটে যাবে কিংবা যারা যাপন করবে আগামী শরৎ।
তাদের জন্যই রেখে যাই কাল-মহাকাল
রাত্রি শেষে যারা করে আরাধনা, আর আঁকে মরমি সকাল।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তাপস গায়েন
হেমন্ত গান

সপ্তর্ষি মণ্ডল নিয়ে
আমাদের রাত ছিল হেমন্তের
আর জলের স্ফটিকে
প্রতিসরিত, বিচ্ছুরিত দিন ছিল
রংধনুর চেয়ে উজ্জ্বল, তবু
সিংহীর হৃদয় নিয়েও আমরা ব্যথিত হই, যখন
পাতা ঝরে পার্কে, খানাখন্দে, কফিহাউস চত্বরে
যখন সময় ঝরে পড়ে সময়ের অতলান্তে!

জেনেছি অপসৃয়মানতাই শ্রেয়,
তবু আমাদের সাক্ষ্য দিতে হয়-
রঙের পৃথিবী প্রেমের মতোই ভ্রান্তিতে পূর্ণ
আমরা যারা ভেসে গেছি হলুদ, খয়েরি, আর
লাল রঙের উজ্জ্বল আর দীর্ঘ তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যে
তাদের অনেক বিকেল জমা পড়ে আছে হেমন্ত পাহাড়ে
তোমার নিঃস্পৃহতায় বিদ্ধ আমার রক্তাক্ত দুচোখ দেখে নিচ্ছে
পাতা ঝরার অপসৃয়মানতায় উজ্জ্বল এই রঙিন পৃথিবীকে!

রওশন হাসান
হেমন্তকল্পবেলা

বোহিমিয়ান আকাশে চেয়ে দেখো হেমন্তবর্তী মেঘরাশি
ফুলবন, সবুজ পাতাদের হলুদ মেটামরফসিস
হারানোর ব্যথায় বনভূমির আর্ত হাহাকার
হুইসিল বাজিয়ে ট্রেনের প্রস্থান মনে করিয়ে দেয় অপেক্ষার স্তব্ধ মর্ম
ছিন্ন ছিন্ন বিষণ্নতা পৌঁছে দিয়েছে অবসন্নতার দিকে
প্রলম্বিত রাত্রির আগমনে ক্রমশ ফিরে যাচ্ছি যেন হেমন্তে মোড়ানো উন্মেষকালে।
শির দোলানো সাদা কাশবনের হাতছানি
এক অসহায়বোধ ঘিরে রাখে অন্তর মেদুরতাহীন
হিম সমীরণে জানান দেয় তুষারবার্তা
বিস্তৃত আকাশের পথ ধরে নিথর চলি যুগ্মবোধে
অন্তর্গত বিচ্ছেদ অবিচ্ছেদ্য ক্রোশ অহর্নিশ
ফেলে আসা গার্হস্থ্য মাটির সজ্জিত ঘর
দেহে দেহহীন খুলে দিয়েছে সৌন্দর্যরাশি
নরস্পর্শে যেন প্রগাঢ় অসাড়তায় নৈসর্গের পরিতোষ
শীতল নদী যেমন জেগে ওঠে শীৎকারে
গোপন বাঁশির বাদ্যে গৃহহীন মৌসুমের ইঙ্গিতসূত্র বিরহ জাগানিয়া এলিজি পরবাসী।

আমাদের কাদামাটির হৃদয়, অদৃশ্য রেইনড্রপস
অবিন্যস্ত সুখ দুঃখের বাষ্পীয় যোগাযোগ
সোনালি ধানের শিষ, বিহঙ্গের মৌন বিমুগ্ধ ডাক
বিবর্ণ রঙের প্রগল্ভতা
চোখের দূরত্বে স্মৃতির ব্যবধান, দৃশ্য ভঙ্গ অর্কেস্ট্রা
তবুও ভালো লাগে ভাবনার নৈকট্য পরিধি পরিধান।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মনিজা রহমান
স্মৃতিহীন মানুষ

হলুদ পাতা ঝরে যাওয়ার সরসর শব্দে
চমকে উঠে পেছনে তাকাই
যদি সে আবার ‘দুঃখ প্রকাশ’ করতে ফিরে আসে।
পাতাগুলি ঝরতে ঝরতে
খোলা প্রান্তর ঢেকে যায়,
কোথাও শুনি না চেনা পায়ের মচমচ শব্দ।
বাসস্টপ, গ্রোসারি শপ, লন্ড্রোম্যাট
খাঁ খাঁ করে
শেষ বিকেলের হেলে পড়া আলোয়,
বাতাসে উড়ে বেড়ায় লাল-নীল-ধূসর হাহাকার।
মুখের ভেতর খুঁজে ফিরি সেই নোনাজল
যে জলে একদিন দুজনে ভিজেছিলাম নদীর ধারে
বিশাল ঢেউ এসে ভিজিয়েছিল দুজনকে!
পোড়া স্মৃতির গন্ধ ভাসে হলুদ পাতার দিনে,
স্মৃতিহীন মানুষ আসে না ফিরে
নদীর জলে আকণ্ঠ ডুবে গেলেও
বাড়িয়ে দেয় না কেউ ভালোবাসার হাত।


স্বপ্ন কুমার
ওগো হেমন্তের বাতাস

আমাকেও উড়িয়ে নিয়ে যাও
যেভাবে উড়িয়ে নিয়ে যায়—হেমন্তের বাতাস
ঝরা পাতা
আমাকেও উড়িয়ে নিয়ে যাও
ওগো হেমন্ত বাতাস...
মন যে আমার পড়ে আছে
নদীর পাড়ে পাড়ে
মন যে আমার পড়ে আছে
বিলের ধারে ধারে
শিমুল গাছের তলায়

মন যে আমার পড়ে আছে
ধান খেতের ওই আলে
মন যে আমার পড়ে আছে
পুকুর-ডোবা-খালে
বকুল ফুলের মালায়

ওগো হেমন্ত বাতাস
আমাকেও উড়িয়ে নিয়ে যাও
যেখানে আমার—
সব পড়ে আছে

শুকনো তুলোর মতো করে
ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো করে
দলছুট মেঘের মতো করে
ঘূর্ণিতে পড়া ধুলোর মতো করে
আমাকেও উড়িয়ে নিয়ে যাও

আমাকেও উড়িয়ে নিয়ে যাও
ওগো হেমন্ত বাতাস—
আমি ঝরা পাতা...