
ভেনিস থেকে রাত দুটার সময় এসে পৌঁছলাম পারদোননে। এই স্টেশন এই গাড়ি পার্কিং করা ছিল; সোজা ফ্রেডির ভিলায় চলে গেলাম; কাপড়চোপড় খুলে গোসলটা সেরে নিলাম চটপট। এক কাপ চা নিয়ে বসে শুরু হলো আমাদের গল্প, সেই গুলশান ২৫ নম্বর রোডের বাড়ির সেই অফিস থেকে ইতালির ভিসা। প্লেনে উঠিয়ে দেওয়া থেকে প্রথম কয়েক মাস চিঠিপত্র আদান–প্রদান, তারপর ফ্যাক্স এবং দু–একটা ফোনকল—অতঃপর সব শেষ। এক বছর পর আমি চলে আসলাম লন্ডনে, যোগাযোগ ওই খান থেকেই বিচ্ছিন্ন। ঢাকায় বসিউরের কাছে মাঝে মাঝে শুনতাম গল্প, কিন্তু ব্যাটে আর বলে সংযোগ আর হয়নি গত ৩০ বছর ধরে। ইতিমধ্যে বুড়িগঙ্গায় অনেক জল গড়িয়ে গেছে। সেই ঢাকা আর ঢাকা নাই। এয়ারপোর্ট রোডে উত্তরায় আগের মতো আর ১২০ মাইল বেগে গাড়ি চালানোর কোনো সুযোগ নেই। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ১৮০ ডিগ্রি টার্ন করার কথা স্বপ্নেও ভাবা যায় না। মহাখালীতে ফ্লাইওভার শুনলে কেমন লাগে, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে দুপাশেই আকাশচুম্বী ভবন। বনানী বাজার কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। ভুতুড়ে বনানী ১১ নম্বর এখন সারা দিন রাত লোকে লোকারণ্য। চেনার কোনো উপায়ই নাই। ওর মাথায় সাদাপাকা চুল, চোখে চশমা, কত যে পরিবর্তন। টগবগে একটা ২০-২১ বছরের তরুণ সেই ছিপছিপে মানুষটা আজ প্রায় ৫৫ বছরের মধ্যবয়সী ব্যক্তিত্ব। এক্সট্রিম ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সিএডির ( কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন) ডিরেক্টর; লন্ডন ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম আর রিট্ট্রাক্টঅ্যাবল ছাউনি বানিয়েছে ওদের ওই কোম্পানি। তার পরিবার আমাদের পরিবার, মা–বাবা, ভাইদের কথা বলতে বলতে সকাল ৭:৩৫ মিনিটে ঘুমাতে গেলাম দুইজন।
দুপুর ১২টায় ঘুম ভেঙে গেল আমার। উঠেই এক কাপ লেমন চা বানালাম আর আমার ওঠার আওয়াজে তারও ঘুম ভেঙে গেল। দুজন এক সঙ্গে চা পান করেই জামাকাপড় পরে বেরিয়ে পড়লাম পারদোনেন শহরটা দেখতে। নদী একটা আছে খুবই সুন্দর, একদম ছবির মতো দেখতে; ভীষণ খরস্রোতা; পাহাড়ের চূড়ার সব বৃষ্টির পানি এই নদী দিয়েই নেমে আসে। একদম ভিউ কার্ডের ছবির মতো একটা শহর, নেই কোনো কোলাহল, নেই কোনো ব্যস্ততা, নীরব ছিমছাম পরিচ্ছন্ন একটা শহর। দেখা হলেই এক আগন্তুক আরেক পথচারীকে অভিবাদন জানাচ্ছে। কি সুহৃদ সম্পর্ক! আমাদের দেশের মতো একজন আরেকজনের দিকে কর্কশ নেত্রে চায় না। লন্ডনের চেয়ে অনেক গরম এখানে। হাঁটতে হাঁটতে শহরের মধ্যখানে চলে আসলাম। বিশাল একটি গির্জা আর গির্জার পাশেই ২৭০ মিটার উঁচু চার্চের টাওয়ার সেই ১২০০ সালে নির্মিত।
ভাবতেই আশ্চর্য লাগে; টাওয়ারের নিচের তলায় হলো ওই শহরের ক্ষুদ্র জেলখানা। ২০ জন কয়েদির মতো জায়গা হবে মন হলো। লাইব্রেরিতে থরে থরে ইতালীয় ভাষায় বই সাজানো, বাচ্চাদের এবং বয়স্কদের আলাদা আলাদা সেকশন; নীরব নিস্তব্ধ চারপাশ; নেই টু শব্দটিও। যে যার মতো বইয়ের পাতায় নিমগ্ন; অনেক হাঁটলাম সেই প্রসিদ্ধ রোমান ইট বিছান ক্যাবল স্ট্রিটে; ক্লান্ত ও গরমে ঘেমে কর্দমাক্ত; উপায়ান্তর না পেয়ে একটা বারে ঢুকে দুজন দুটি আইসক্রিম খেলাম পেভমেন্টে বসে বসে। সম্পূর্ণ পর্যটকদের মতো হালফ শর্টস পরা মাথায় হ্যাট, গলায় ঝুলান ক্যামেরা, রাক্সাকে ভরা পানির বোতল, সানক্রিম, ওয়াকিং স্টিক ও অন্যান্য সামগ্রী। ইতালির প্রত্যেক শহরেই পাবলিকদের পানি পান করার জন্য রয়েছে পানির ফোয়ারা ।
মানুষের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক দেখে আমি অভিভূত; আমাদেরকেও ওরা শুভেচ্ছা জানাতে কোনো কৃপণতা দেখাচ্ছে না। আরও অনেকক্ষণ হেঁটে শহরের আরেক প্রান্তে এসে একটা লেবানিজ রেস্তোরাঁয় ঢুকে হমুস আর ব্রেড সঙ্গে ল্যাম্ব শর্মা কাবাব খেলাম দুই বন্ধু মিলে। খেয়ে–দেয়ে আবার বের হলাম হাঁটতে, হেঁটে চলে শহরের জাদুঘরে; সেই রোমান, গ্রিক, খ্রিষ্টান, বর্বরদের আক্রমণ ও পার্টিসান হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস থেকে শুরু করে ওশট্র হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য হয়ে হ্যাবসবার্গ ডাইনাস্টির ইতিহাসসহ এই এলাকার খুঁটিনাটি কোনো কিছুই বাদ পড়েনি এদের সংরক্ষণ থেকে। অভিভূত হয়ে গেলাম; রোমানদের পোশাক ও ওদের খাদি কাপড় দেখে মনে পড়ল, ২৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার তাঁতিদের বানানো খাদি কাপড় রোমানদের কাছে রপ্তানি করা হতো। টলেমির বইয়ে কোথায় জানি একবার পড়েছিলাম। আবার আরেকটা বড় লাইব্রেরি দেখতে ঢুকে পড়লাম, কি পরিচ্ছন্ন! এখানেও বাচ্চাদের আলাদা পড়ার জায়গা আর এক পাশে বয়স্কদের। শতভাগ বই–ই ইতালিয়ান ভাষায় লেখা; সেই ১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ইতিহাসে ভরা এই বিব্লিওটেকা (ইতালিতে লাইব্রেরিকে তাই বলে)। ঘণ্টা খানিক বসে চতুর্দিক অবলোকন করলাম আর ওদের লাইব্রেরির ওএইচপিতে দেখতে লাগলাম ইতিহাস সমৃদ্ধ ছবি, সেই ক্যামেরা আবিষ্কার হওয়ার আদিকাল থেকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি ও হিটলার, হলোকাস্ট—এসব নিয়ে অনেক ছবির সংগ্রহ এই বিব্লিওটেকাতে। মনে হলো এটা মনে হয় এই শহরের পাবলিক লাইব্রেরি বোধ হয়।
বাইরে ভীষণ কড়া রোদ, রাস্তাঘাট জনশূন্য। আগস্ট মাস মানেই হল সবার হলিডে, পুরো দেশ ছুটি কাটাচ্ছে। ওদের দেশের লোকেরা অন্য দেশে যায়, আর অন্যান্য দেশের মানুষ তাদের দেশে আসে। ইউরোপে বছরে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মানুষ ভ্রমণ করে। কম্যুনে (ওদের পৌরসভা অফিস) একদম শূন্য। মনে মনে ভাবলাম, চুয়াডাঙ্গা পৌর সভার কথা। কারণে–অকারণে ওই অফিসে কম করে হলেও ২০০–৩০০ মানুষ ঘুরে বেড়াত। নেই কোনো দালাল, ফড়িয়া, নেই মুহুরি, নাই ক্যানভাসার বা প্রদীপ চানাচুর ওয়ালা। নিস্তব্ধ নিশ্চুপ পরিচ্ছন্ন একটা পরিবেশ। এখানে বোর্ডে থরে থরে ছবিগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে বাঁধিয়ে রেখেছে, যেসব জনগণ অতিসম্প্রতি মারা গেছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি; কি সুন্দর ওদের কালচার!
বিকেল প্রায় ৬টা বাজে রওনা হলাম ওই শহর থেকে ২০-২৫ কিলোমিটার দূরে আলপাইন পর্বত মালার প্রথম নিকটবর্তী চূড়ার উদ্দেশ্যে। সেই ১৯৮২ সালে বিএমএ অডিটোরিয়ামে মিলিটারি জিওগ্রাফির ক্লাস নিচ্ছিল লেফটেন্যান্ট সারওয়ার। পুরো ক্লাসে আমরা হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন ছাড়া সবাই গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন, তখন সারওয়ার বলেছিল, আলপাইন পর্বতমালা একটি টারসিয়ারি পর্বতমালার অংশ। ওই টারসিয়ারি পর্বতমালারই বংশ শেষ হয়েছে হিমালয় পর্বতে। বেশ ভালোই লাগল যে, আজ ৩৬ বছর পরও ওই লেসনটা ভুলিনি। আজ আমিও দ্রুত গাড়ি হাঁকিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি ওই আলপাইন পর্বতমালার একটি চূড়া মাউন্ট কোভালির দিকে। ফ্রেডি বলল, বস আজ রাতে আমরা ওই পাহাড়ের গহিন একটা গুহার কাছে তাঁবু গাড়বো সন্ধ্যা হওয়ার পর। ওই খানেই বার বি কিউ করে রাতের খাবার খেয়ে গাড়িতে করে নিয়ে আসা একটা তাঁবুতে ঘুমাব।জিজ্ঞেস করল, কোনো অসুবিধা নেই তো?
পাহাড়ের চূড়া প্রায় ৭ হাজার ছয় শ ফুট উঁচু। আমরা প্রথম রাতে সন্ধ্যা হওয়ার আগ পর্যন্ত ১২ থেকে ১৫ শ ফুট ওপরে উঠেই রাত নামার আগেই তাঁবু গাড়ব। গাড়ি এসে থামল মাউন্ট কোভোলা পর্বতের স্কি শ্লোপের পাদদেশে। গাড়ি পার্ক করে সব নামালাম। দুজনের কাছে ওজন প্রায় ৬০-৭০ কেজি নিয়ে উঠতে শুরু করলাম পর্বতে। সে এক কঠিন যাত্রা, গ্রীষ্মকালে সব সবুজ পাতায় ঢাকা। আর শীতে পাঁচ থেকে ছয় ফুট বরফে সব ঢাকা পড়ে যায় বছরের ৬-৮ মাস। লাখ লাখ স্কিয়ার এসে এখানে স্কি করতে। আর এখন আসে পর্বত আরোহীরা, যারা হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের চূড়ায় যেয়ে আবার হেঁটে নেমে আসে। কয়েক হাজার লোক, বাচ্চা, আবাল, বৃদ্ধ, বনিতায় একাকার পুরো এলাকা। পা গুলো ক্লান্ত হয়ে গেল ঘণ্টা খানিক হেঁটেই। ফ্রেডির জিপিএস দেখাল, আমরা প্রায় ৯০০ ফুট ওপরে উঠে গেছি । অনেক জায়গায় পাহাড়ে ওঠার পথ প্রায় ৬০ ডিগ্রি খাঁড়া স্লোপ। উঠতে খুবই কষ্ট হয়। তার ওপর অনেক বছরের অভ্যাস নেই পাহাড়ে ওঠার। সন্ধ্যা প্রায় আসন্ন, সহসা উপলব্ধি করলাম প্রচণ্ড ঠান্ডা। নিচে ছিল ২৭ ডিগ্রি। ফ্রেডির জিপিএস দেখাচ্ছে, এখানে তাপমাত্রা মাত্র ৫.৫ ডিগ্রি। ঘাড় থেকে সবকিছু নামিয়ে সেই আগের জীবনের স্কাউটের মতো দুজনই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আলো শেষ হওয়ার আগেই তাঁবু গাড়ার। বার বিকিউ করে রাতের খাবার খেতে শুকনো লাকড়ি-কাঠ বা শুকনো পাতা জোগাড় করতে নেমে পড়লাম। তাঁবু ঠিকঠাক দুটো পাহাড়চূড়ার ভ্যালিতে লাগালাম যাতে, রাতে ঠান্ডা বাতাস কম লাগে আর কাছেই পেয়ে গেলাম একটা ঝরনার নালা। একদম স্ফটিকের মতো পরিচ্ছন্ন পানি। ছবি নিয়ে আই ক্লাউডে সেভ করলাম আর আপন ফাতেমাকে ই–মেইল করে দিলাম সঙ্গে সঙ্গে। তাঁবু গাড়ার পর এক ঝলক সূর্যের আলোর দেখা পেলাম কয়েক মিনিটের মতো; তারপর কখন যে কালো রাত নেমে আসল তা আর টের ই পেলাম না। রাতের আহার বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম দুজনই ...(চলবে)