নর্থ আমেরিকান এক্স-১৫ বিমানটি আসলে রকেটচালিত সুপারসনিক বিমান। এক্স-প্লেন সিরিজের অংশ হিসেবে এটিকে যৌথভাবে তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী এবং মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। ৬০ বছরের বেশি আগে প্রথম আকাশে উড়েছিল ‘নর্থ আমেরিকান এক্স-১৫’। এখন পর্যন্ত মানুষচালিত বিমানের মধ্যে সুপারসনিক এ বিমান সবচেয়ে দ্রুতগতিতে ছুটতে পারত। রাশিয়ার সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আমেরিকা এ বিমান তৈরির জন্য গবেষণা শুরু করেছিল।
১৯৫৯ সালে প্রথম যাত্রা শুরু। এরপর নয় বছরে ১৯৯ বার পরীক্ষামূলকভাবে উড়েছে। এক্স-১৫ ওড়ানোর জন্য ১২ জনের একটি দলই তৈরি করেছিল আমেরিকা। এই দলে ছিলেন চাঁদে প্রথম পা রাখা নিল আর্মস্ট্রংও।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে পরীক্ষা মূলকভাবে ৬০টি বিমান তৈরি করে মার্কিন বিমানবাহিনী ও নাসা। ১৯৫২ সাল থেকে এর উৎপাদন শুরুর সময় এক্স-১৫ সুপারসনিকের গতি ছিল ঘণ্টায় ৭০০ মাইল। গতি ছিল শব্দের চেয়েও পাঁচ গুণ বেশি।
প্রায় ২০০টি উড়ানে মাত্র দুবার জরুরি অবতরণ করতে হয়েছে এ সুপারসনিককে। ১৯৬৭ সালে দুর্ঘটনায় পড়লে পাইলট মাইকেল অ্যাডামস নিহত হন। দুটি দুর্ঘটনাকে বাদ দিলে এক্স-১৫-এর মাত্র নয় বছরের জীবদ্দশায় তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে আকাশের পথ ছেড়ে দেয় নর্থ আমেরিকান এক্স-১৫। তবে অবসর নেওয়ার আগের বছর একটি রেকর্ড গড়ে নেয় বিমানটি। সেটি আজও অক্ষত। সে বছর এ সুপারসনিকের ককপিটে বসেছিলেন পিট নাইট নামের এক পাইলট। তিনি বিমানটিকে উড়িয়েছিলেন ঘণ্টায় ৪ হাজার ৫২০ মাইল বা শব্দের ৬ দশমিক ৭ গুণ বেশি গতিতে।
বাতাসের গতিতে নয়, এর চেয়েও বহুগুণ বেশি জোরে ছুটতে পারত এই সুপারসনিক বিমান। দেখতে চিরাচরিত বিমানের মতো নয়, অনেকটা বুলেটের আকারে তৈরি। এটি আসলে একটি রকেট, এর সঙ্গে লাগানো ছিল ককপিট। তাতে বসেই চালক উড়িয়ে নিয়ে যেতেন ‘নর্থ আমেরিকান এক্স-১৫’। দক্ষ পাইলটের হাতে পড়লে প্রায় সাত গুণ গতিতে ছুটতে পারত বিমানটি।
বিমানটির একজন পাইলট ছিলেন বিল ডানা। তিনি বলেন, ‘এটাই “আসল” বিমান, যা ওড়ে।’ নাসার আর্মস্ট্রং রিসার্চ ফ্লাইট সেন্টারের প্রধান ক্রিস্টিয়ান গেলজার বলেন, সবচেয়ে বেশি গতি, সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা এবং সবচেয়ে বেশি ভয়—এ তিন অনুভূতি একসঙ্গে হতো বিমানটি উড়ানোর সময়।
ক্রিস্টিয়ান গেলজার আরও বলেন, ‘গতির লক্ষ্যে পৌঁছাতে ঝুঁকিও কম ছিল না। এ ধরনের বিমানকে সাধারণ বিমানের তুলনায় আরও উঁচুতে ওড়াতে হতো। ভূপৃষ্ঠ থেকে আড়াই লাখ ফুট উঁচুতে ওড়ানোই লক্ষ্য ছিল আমাদের। আর সেটি যে বড়সড় ঝুঁকি নেওয়া, তা আর না-ই বলি।’ তিনি বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটেই এ বিমান তৈরির জন্য গবেষণা শুরু হয়।
বিমানের গতির মতোই এর উড়ানোর পদ্ধতিও ছিল ভিন্ন। অন্য বিমানের মতো এটি রানওয়েতে দৌড়ে আকাশে উড়ত না; বরং এটিকে বি-৫২ বোম্বার বিমানের সহায়তায় আকাশে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো। গেলজার বলেন, দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার এডওয়ার্ড বিমানঘাঁটি থেকে নেভাদা বা ইউটার দিকে ঘণ্টায় ৬০০ মাইলেরও বেশি গতিবেগে উড়ে যেত বি-৫২ বোম্বার বিমান। এ সময় বিমানটির পেটের নিচে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকত এক্স-১৫। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪৫ হাজার ফুট উঁচুতে যাওয়ার পর এক্স-১৫-কে আকাশে ছেড়ে দেওয়া হতো। এরপরই ৫০ ফুট লম্বা সুপারসনিক বিমানটির ইঞ্জিন চালু করতেন পাইলট।
এই বিমানের জ্বালানিও ছিল অভিনব। তরল অক্সিজেনের সঙ্গে অ্যামোনিয়ার মিশ্রণ ব্যবহার করা হতো জ্বালানি হিসেবে।
বিমানটি যে আলাদা ছিল, তা বোঝা যায় এ বিমানের অপর এক পাইলট মিল্ট টমসনের কথায়। তিনি বলেন, ‘এটাও অন্য বিমানগুলোর মতোই আকাশে ভাসত। তবে যখন ওপরে উঠতে শুরু করত, তখন মনে হতো এটি কাউকে পরোয়া করে না। যে কয়টি বিমান উড়িয়েছি, তার মধ্যে একমাত্র এই বিমানের ইঞ্জিন বন্ধ থাকলে স্বস্তি পেতাম।’
রানওয়েতে নামার ক্ষেত্রেও ভিন্ন চরিত্র দেখা গেছে এ সুপারসনিক বিমানের। রানওয়ে ছোঁয়ার জন্য বেশির ভাগ বিমান ঘণ্টায় ২০০ মাইল গতিতে প্রস্তুতি নেয়। তবে এক্স-১৫ তা শুরু করত ২০ হাজার ফুট উঁচুতেই।
তথ্যসূত্র: সিএনএন