
ঠিক পৌনে সাতটায় ঘুম ভাঙল অনির। সাতরঙা রবি রশ্মি আজ জানালার ভারী লাল পর্দা ভেদ করে অনির ঘরে ঢুকে জানান দিচ্ছে উঠে যাও। আজ রোববার। ছুটি। শান্তির আমেজ নিয়ে চোখ মেলে ঘরের চারদিকে তাকাল অনি। জানালার পর্দা সরিয়ে উপভোগ করল জুন মাসের রৌদ্রোজ্জ্বল সুন্দর সকাল। ম্যানহাটনের গ্র্যাজুয়েট সেন্টারের মিটিংয়ে উপস্থিত হওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই হাতে। তাই মনটা আজ বেশ ফুরফুরে। এই কয়েক বছরে কোনো একটা ছুটির দিনে সে সময় পায়নি। সব সময় ছুটতে হয়েছে মিটিং, সেমিনার বা লাইব্রেরিতে। তা না হলে বসতে হয়েছে কলিগদের সঙ্গে। এই গতকালও দুপুর ১২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাটিয়েছে ড. কুনরডের সঙ্গে। থিসিস প্রায় শেষ, এখন শুধু জমা দেওয়ার পালা।
স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলে, এক কাপ চা নিয়ে অনি গিয়ে বসল ব্যালকনিতে। এই ব্যালকনিটা তাঁর অবসর কাটানোর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। এমনিতেই ঝোপ-ঝাড়ের ভেতরে এই অ্যাপার্টমেন্ট তার ওপর বাড়তি নানা ধরনের ফুল গাছ আর গ্রিলে জড়ানো লতাপাতা এই ব্যালকনিটাকে আরও সুন্দর, সবুজ করে তুলেছে। এখানে বসলে কেমন যেন একটা শান্তির ছোঁয়া পায় সে। শীতের সময় অবশ্য এই ব্যালকনি বা বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য এত সুন্দর থাকে না। লতাপাতাহীন শুকনো খটখটে গাছ কাঠির মতো সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকে শুধু। চারদিকে কেমন যেন খাঁ খাঁ করে। তবে যাই হোক না কেন কী শীত কী গ্রীষ্ম এই ব্যালকনিটাই অনির খুব পছন্দ।
নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় হাইল্যান্ড অ্যাভিনিউর কোনায় পার্কের ঠিক উল্টো দিকে এই বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট। এখানে দুই বেডরুমের বাসা ভাড়া নিয়েছে অনি। রুমমেট আছে একজন কোরিয়ান। বেড রুমের সঙ্গে এই ব্যালকনিটা পেয়েছে বলে, প্রতি মাসে ভাড়া বাবদ ৫০ ডলার বেশি দিতে হয় তাঁকে। কিন্তু সে জন্য বাড়তি সুবিধাও সে পেয়েছে। নিরিবিলি, চুপচাপ, তার প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না একাকিত্বের এক বিরাট অংশীদার এই ব্যালকনি।
বেশ ভালোই আছে অনি কোরিয়ান রুমমেট ব্যাঙ হেইজিনের সঙ্গে। খুব ভালো মেয়ে। অনির চেয়ে বছর চারের ছোট। অনি সিটি ইউনিভার্সিটিতে এডুকেশন সাইকোলজিতে পিএইচডি করছে। এ বছরেই শেষ হবে। গ্র্যাজুয়েট লেভেলে স্কলারশিপ নিয়ে এসেছিল প্রায় দুই যুগ আগে। এরপর এইচ ওয়ান ভিসায় কাজ করার পাশাপাশি লেখাপড়া করা। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এত বছর পর অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ নিয়ে শুরু করেছে পিএইচডি। ব্যাঙ হেইজিন গ্রাফিকস ডিজাইনার। নিউজার্সির রাদার ফোর্ডে একটি ফ্যাশন-ডিজাইন কোম্পানিতে কাজ করে।
চা নিয়ে আসার সময় অনি দেখল হেইজিনের রুমের দরজা খোলা, সে নেই। মনে পড়ে গেল আজ জেভিস্ট কনভেনশন সেন্টারে তার শো আছে। শো শেষে তার হবু স্বামীর সঙ্গে হোটেলে থাকবে। আজ আর ফিরবে না সে।
নিজের অজান্তেই একটু হেসে চায়ে চুমুক দিল অনি। তাকিয়ে দেখল পার্কের লেকের দিকে এই সাত সকালেও লেকের ধারের বেঞ্চে বসে আছে দুজন তরুণ-তরুণী। জড়াজড়ি করে ধরে তারা পরস্পরকে চুম্বন করছে। এ দৃশ্য এখানে অহরহই দেখা যায়। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই। অনি চোখ ঘুরিয়ে লেকে হাঁসের সাঁতার কাটা, কাঠবেড়ালির ছুটোছুটি, পাখির কলরব প্রাণ ভরে উপভোগ করতে লাগল। কী যে ভালো লাগছে তার। কী সুন্দর, কী চমৎকার এই প্রকৃতির লীলা-খেলা।। গুনগুন করে সে গাইতে লাগল ‘প্রতিদিন আমি হে জীবন স্বামী, দাঁড়াব তোমারই সমুখে’।
কিন্তু এ ভালো লাগার অনুভূতিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। বুকের ভেতর কেমন যেন একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল। শ্যামলের বিশ্বাসঘাতকতার আঘাতটা পুরো হৃৎপিণ্ডে স্থায়ী ভাবে গেঁথে গেছে। কোনোক্রমেই উপরে ফেলা যাচ্ছে না। যখন শ্যামলের সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার দৃশ্যটি ভেসে উঠে তখনই মনে হয় শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরা ছিঁড়ে উত্তপ্ত রক্ত প্রবাহিত হয় তার শরীরে। এ মুহূর্তে তার কপালের দুপাশের শিরা দুটি দপ দপ করে কাঁপছে। শিথিল হয়ে এল তার আজ এই সুন্দর সকালের ভালো লাগা। সব আনন্দ, সব সুখ ছাপিয়ে তার স্মৃতিতে মাথা চাড়া দিয়ে জেগে উঠল ২০ বছর আগে ফেলে আসা এক প্রতারিত অতীত। ঠিক এ রকম একটি রোদ ঝলমল উজ্জ্বল সুন্দর সকালেই তার জীবনের সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায়। প্রায় ২০ বছর হলো সে আমেরিকায় এসেছে। তারও তিন বছর আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় সৃষ্ট এক মহা দূর্যোগময় রাতে আশ্চর্যজনক ভাবে দেখা হয়েছিল শ্যামলের সঙ্গে।
অনি তখন টিচার হিসেবে জয়েন করেছে ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন রিসার্চে। ডে শিফটে ফুল টাইম ও নাইটে খণ্ডকালীন এম এড-এ মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার সপ্তাহে দুদিন ক্লাস নেয়। সেদিন ছিল মঙ্গলবার, ২৭ নভেম্বর ১৯৯০। এম এড কার্যক্রমের শিক্ষা গবেষণা বিষয়ের চূড়ান্ত পরীক্ষা। বাংলাদেশে অস্থিরতা। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়েছে স্বৈরাচার সরকারের অপসারণের দাবিতে। ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন রিসার্চের পরিচালক ড. লতিফ স্যারের নির্দেশে এম এড কার্যক্রমের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়নি। অনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই খবর ছড়িয়ে পরে ডা. মিলনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। হাজারো ছাত্র অস্ত্র হাতে মিছিলে অংশগ্রহণ করেছে। স্লোগানের কারণে তেমন কিছুই শোনা যাচ্ছে না। কোনো যানবাহন নেই। এদিকে আলতাফ সাহেব খুবই উত্তেজিত। তিনি জেদ ধরেছেন টিএসসির দিকে যাবেন, মিলনকে যেখানে হত্যা করা হয়েছে। অনির সঙ্গে ছিলেন সাইকোলজির শিক্ষক আলতাফ হোসেন। অনি ভেবে পাচ্ছে না সে একা কী করবে। হাঁটতে হচ্ছে না, ভিড়ের ঠেলায় তারা সামনের দিকে এগোচ্ছে। পেছনে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। টিএসসির কাছে এসে ভিড় ঠেলে একটু এগিয়ে অনি দেখতে পেল জমাট রক্তের মধ্যে ছড়ানো কিছু ফুল। ডা. মিলনের রক্ত। মানুষের জমাট বাধা রক্ত দেখে মাথা ঘুরে গেল অনির। বমি আসছে তার। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ফুটপাতে এসে দাঁড়িয়ে অনি রিকশা খুঁজছে। সাধারণ মানুষ বাড়ি ফেরার জন্য হন্যে হয়ে যানবাহন খুঁজছে। এ সময় কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের দেখা মিলল। এদের সঙ্গে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত হেঁটে এসে অনি দাঁড়িয়েছে রিকশা, বেবি ট্যাক্সি বা বাসের জন্য। কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। চারদিকে হই চই। অনির চোখের সামনে ভাসছে শুধু তাজা রক্তের ওপর কিছু ফুল। এ যেন আর একটি মুক্তির যুদ্ধ।
হঠাৎ একজন সুদর্শন যুবক এসে অনিকে জিজ্ঞাসা করল—ম্যাডাম কোন দিকে যাবেন?
অনি বলল, গ্রিন রোডে।
শ্যামল পরিচয় দিল, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বছর তিনেক আগে বুয়েট থেকে বেড়িয়েছে। একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করছে। বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে বাড়ি পৌঁছে দিল অনিকে। তখনো দেশের উত্তেজিত পরিস্থিতির পরবর্তী কোনো খবর তারা পায়নি।
গ্রিন রোডে শমরিতা হাসপাতালের পাশেই ছোট একতলা বাড়ি অনিদের। বাড়িতে ঢোকার মুখেই বেশ বড় জায়গাজুড়ে ফুলের বাগান। বাগান পেরিয়েই লম্বা গ্রিল ঘেরা বারান্দা। ভেতরে বড় বড় চারটি কামড়া।
গাড়ি থেকে নেমে একটু ইতস্তত করে অনি বলল বেশ রাত হয়েছে। একটু বসবেন কি? খুব সহজ ভঙ্গিতে শ্যামল বলল—বসব, এক কাপ চা খাব এবং খবর শুনব। অনির বমি বমি ভাবটা তখনো যায়নি। সে চা খেল না। শ্যামল খবর দেখতে দেখতে চা খেল এবং জানাল, অনিদের এই বাড়ি আর বাগান তার খুব ভালো লেগেছে। কথায় কথায় সে জেনে নিল এ বাড়ির সদস্য সংখ্যা মোটে তিনজন। অনি, অনির চাচাতো ভাই শহীদ। সে তিতুমীর কলেজে পড়ে। আর দূর সম্পর্কের আত্মীয় কমলা। কমলা এ বাড়ির সবকিছু দেখা শোনা করে। বড় ভাই এসপি, রাজশাহীতে পোস্টিং। বড় বোন থাকে কানাডায়। বাবা-মা নেই।
যাওয়ার সময় শ্যামল তার কার্ড অনিকে দিয়ে অনির ফোন নম্বর লিখে নিল। প্রথম দেখাতেই শ্যামলকে খুব ভালো লেগে গেল অনির। মনের কোণে একটা প্রেম প্রেম ভাব জেগে উঠলেও তাজা রক্তের ওপরে ছড়ানো ফুল, দেশ ও মানুষের কল্যাণে আত্মত্যাগ করা মানুষটির অবদানের সম্মানে অনি সে রাতে প্রেমকে প্রশ্রয় দিতে পারেনি।
অবশেষে দেশে গণতন্ত্রের জয় হলো। শ্যামলের ফোনের অপেক্ষায় রোমাঞ্চ রোমাঞ্চ একটা অনুভূতি নিয়ে প্রতিদিন রাতে অনি ঘুমাতে যায়। প্রতিদিন সে শ্যামলের ফোনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
অনেক দিন পর একদিন। সে দিন ছিল ছুটির দিন। রোদ ঝলমল সুন্দর সকাল। বাগান ভর্তি ফুল ফুটেছে। অনির মন আকুলি-বিকুলি করছে শ্যামলের জন্য। দ্বিধা, ভয়, লজ্জা এ রকম একটা অনুভূতি নিয়ে অনি ফোন করল শ্যামলকে।
একটু অনুযোগের স্বরে বলল—অনেক অপেক্ষার পর আমি ফোন করলাম।
বেশ মজা করে শ্যামল বলল—আমি কিন্তু এই ফোনটির জন্যই অপেক্ষা করছিলাম এত দিন। বলেই দুষ্টুমি করে বলল, জানেন আমি কিন্তু রোজ শাহবাগের মোড়ে আপনাকে খুঁজি। যদি একটু লিফট দেওয়ার সুযোগ পাই।
অনি বলল—আমার কিন্তু আজ একটা লিফট দরকার, দেবেন নাকি!
সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল শ্যামল। বলল, দিতে পারি। আজ আমি ফ্রি। শুধু লিফট নয়, সারা দিন আপনার সঙ্গে ঘুরতে পারি।
প্রচণ্ড ভালো লাগার আবেগে কেমন যেন একটা সুখানুভূতিতে শিরশির করে উঠল অনির শরীর। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ফ্যাস ফ্যাস গলায় সে বলল, না না কোনো লিফট দরকার নেই। জাস্ট কিডিং। প্রায় দুই ঘণ্টা কথা বলার পর ঠিক হলো আজ বিকেলে তারা দুজনে মিলে নাটক দেখতে যাবে মহিলা সমিতিতে। আজকের নাটক সৈয়দ শামসুল হকের ‘নুরল দীনের সারা জীবন’।
ঠিক বিকেল পাঁচটায় এসে হাজির হলো শ্যামল। অনিকে দেখে বলল, গাঢ় বেগুনি রং আমার খুব পছন্দ। লজ্জায় লাল হয়ে গেল অনি। সে পরেছে গাঢ় বেগুনি রঙে সোনালি চওড়া জড়িপার শাড়ি।
কী যে ভালো লাগল অনির। কী সুন্দর করে কথা বলে শ্যামল। এরপর থেকে তিনটি বছর কী সুন্দর কেটেছে তাদের। নাটক দেখা, বেড়ানো, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। এর মধ্যেই অনিদের বাসায় এল শহীদের ছোট বোন। অনিদের বাসায় থেকে সে ল’ পড়বে। খুব সুন্দর দেখতে। স্লিম, শ্যামলা, তার নাকের ডগায় ছোট্ট একটা কালো তিল আরও সুন্দর করে তুলেছে। শ্যামলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে অনি। শ্যামল এখন এ বাড়ির একজন সদস্যের মতোই। কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে হবে অনি আর শ্যামলের।
বেশ কিছুদিন থেকে শ্যামল বেশ ব্যস্ত। কী একটা ঝামেলা হয়েছে তার পার্টনারের সঙ্গে। এ রকমই সে বলেছে অনিকে। আগের মতো আর ফ্রি পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। দেখা সাক্ষাৎ কথাবার্তাও হচ্ছে না। বিয়ের ব্যাপারে একটু কথা বলবে তাও যেন শ্যামলের সময় নেই। এদিকে ইউএসএ-তে অনির স্কলারশিপের ব্যাপারটাও অনেক এগিয়ে গেছে। অনি যাওয়ার আগেই তারা বিয়ে করবে এ রকমই ঠিকঠাক সবকিছু। অনির মন মেজাজ খুব ভালো। বিয়ে, স্কলারশিপ সব মিলিয়ে সে খুশির দোলনায় দুলছে।
সেদিনও ছিল ছুটির দিন। খুব সকালে ঘুম ভাঙল অনির। খুব সুন্দর একটা সোনালি রোদের আভা পড়েছে বাড়িতে। সবকিছুই সুন্দর লাগছে অনির চোখে। সে স্থির করল শ্যামলকে আজ ধরতেই হবে। এত চমৎকার দিন সে আজ কাটাবে শ্যামলের সঙ্গে। কথা হলো ফোনে। খুব ধীর স্থির ভাবে শ্যামল বোঝাল অনিকে তার সমস্যা। কোনো ভাবেই আজ সে সময় দিতে পারবে না। পার্টনারের সঙ্গে আজ তার মিটিং আছে। সে অনিকে বলল, তুমি ময়মনসিংহ যেতে চেয়েছিলে তোমার অসুস্থ মামাকে দেখতে। আজ বরং সেখান থেকেই ঘুরে আসো। পরে কিন্তু সময় পাবে না। অনি ভাবল মন্দ হয় না। ছোট খালার সঙ্গে আগেই কথা হয়েছে অনি যখন যাবে তাকে যেন সঙ্গে নিয়ে যায়।
কমলা চা নিয়ে এল অনির জন্য। সে দাঁড়িয়ে আছে। অনি জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবি? কমলা বলল, আপনি যখন নাইট কলেজে পড়াতে যান, তখন রেখা আপা শ্যামল ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলে অনেকক্ষণ। অনি রাগ হয়ে বলল, তাতে তোমার অসুবিধা কী?
কমলা বলল—আমার ভালো ঠেকে না। এই ভালো ঠেকে না কথাটা অনির কানে একটু লাগল। সে পাত্তা না দিয়ে ময়মনসিংহ যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। কিন্তু এই ভালো ঠেকে না কথাটা তাকে যন্ত্রণা দিতে শুরু করল। মনে পড়ে গেল, একদিন নাইট শিফটে ক্লাস হয়নি। অনি বাড়ি ফিরে দেখে রেখা ফোনে কথা বলছে। তাকে দেখেই রেখা পট করে ফোনটা রেখে দিল। সে দিনও অনি পাত্তা দেয়নি। টুকটাক কথা মনে হতে লাগল তার।
পূর্ণিমা নামের একটা মেয়ের সঙ্গে শ্যামলের সম্পর্ক ছিল অনেক দিন। পরে শ্যামল তাকে বিয়ে করেনি। এ রকম একটা কথা অনিকে বলেছিল তার ক্লাসমেট শফি। তখন শফি আর শ্যামল পাশাপাশি থাকত। এ ব্যাপারটা নিয়ে শ্যামলের সঙ্গে বেশ কথা-কাটাকাটি হয়েছিল। প্রথমে শুনে বেশ জোরে জোরে হেসে শ্যামল বলেছিল, ও পূর্ণিমা। খুব ভালো বন্ধু আমাদের। অনি বারবার জেরা করায় রেগে গিয়েছিল শ্যামল। বলেছিল, তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে নাকি শফিকে। আমি তোমার নিজের লোক না শফি। শফির কথার সঙ্গে আমার কথা মিলছে না। একজনকে তো তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে। তা হলে বেনিফিট অব দ্য ডাউট তুমি কাকে দেবে শফিকে না আমাকে।
বাসায় ফিরে এসে ঘুমোতে পারেনি অনি। খুব খারাপ লেগেছিল শ্যামলের জন্য। অনেক রাতে শ্যামলকে ফোন করে আবারও স্যরি বলে সেদিন প্রথম ফোনেই ছোট্ট একটা চুমু দিয়েছিল অনি শ্যামলকে।
এসব ভাবতে ভাবতেই অনি তৈরি হয়ে চলে এল ছোট খালার বাসায়। খালুর খুব জ্বর রাত থেকে। ময়মনসিংহ যাওয়া হলো না। সারা দিন খালার বাসায় থেকে ফিরে এসে দেখে রেখা নেই। শ্যামলকে ফোন করে পাওয়া গেল না। অনি একাই বের হলো। রবীন্দ্র সংগীত সম্মেলনের আজ শেষ দিন। অনি চলে এল শিল্পকলা একাডেমিতে। রিকশা গেটে এসে থামতেই অনি দেখল শ্যামল গাড়িতে হেলান দিয়ে সিগারেট ধরাচ্ছে আর রেখা হেসে হেসে কথা বলছে। গাঢ় নীল রঙের একটা শাড়ি পরেছে রেখা। কী সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে শ্যামলের পাশে। অনি ঝট করে রিকশা থেকে নেমে আড়াল হয়ে ওদের লক্ষ্য করতে লাগল। শ্যামল রেখার কোমর জড়িয়ে ধরে অডিটোরিয়ামে ঢুকে সামনের সারিতে গিয়ে বসল। অনি বসল অনেক পেছনে। তার চোখ সামনের সারিতে বসা দুজন নতুন প্রেমিক-প্রেমিকার দিকে। অহংকারী ভাব নিয়ে মাথা উঁচু করে রেখা বসে আছে শ্যামলের পাশে। অবিশ্বাস্য অনুভূতি অনির। সে যেন স্বপ্ন দেখছে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। কী করবে এখন সে? সবার শেষে হল থেকে বের হলো অনি। বাসায় এসে না খেয়েই শুয়ে পড়ল। রেখা ফিরেছে প্রায় মধ্য রাতে। গাড়ির শব্দ শুনে বুঝতে পারে অনি, শ্যামল রেখাকে নামিয়ে দিয়ে গেল।
পরদিন আর ভার্সিটিতে গেল না অনি। ফোন করল শ্যামলকে। কী সুন্দর স্বাভাবিক শ্যামল। খুব সাবলীল ভঙ্গিতে সে বলল, গতকালের ব্যস্ততার কথা আর বলো না। দুপুর ১২টায় বসেছি মিটিংয়ে, উঠেছি রাত ১১টায়।
অনি বলল, তুমি তো রবীন্দ্র সংগীত উপভোগ করেছ রেখাকে সঙ্গে নিয়ে। একটু চুপ করে থেকে শ্যামল বলল, রেখা বলেছে বুঝি। দুষ্টুমি করেছে হয়তো তোমার সঙ্গে।
অনি বলল, না কেউ দেখেছে তোমাদের।
শ্যামল হো হো করে হাসল কতক্ষণ। বলল, কোথায় পাও এসব কথা। কে কাকে দেখেছে না দেখেছে। আমার নিশ্বাস নেওয়ার সময় নেই। তা রেখাকে জিজ্ঞেস করলেই পারতে। অনি বলল, তুমি আমার ভালোবাসার লোক তো তাই তোমাকেই জিজ্ঞেস করলাম।
শ্যামল বলল, কে কাকে দেখল না দেখল, এ নিয়ে ভালোবাসার মানুষের কাছে কেউ প্রশ্ন তোলে? আমাকে এ রকম ভাব কীভাবে। একটা বিশ্বাস থাকবে না ভালোবাসার মানুষের প্রতি। আমার প্রতি বিশ্বাস রাখা উচিত নয় কি? বেনিফিট অব দ্য ডাউট বলে তো একটা কথা আছে নাকি!
অকারণে অনেকগুলো কথা বলে ফেলল শ্যামল। ধীর স্থির হয়ে সাবলীল কণ্ঠে অনি বলল, তোমার ব্যস্ততা ফুরোলে যোগাযোগ করো।
অনুভূতিহীন হয়ে গেছে অনি। রাগ, ক্রোধ, আক্রোশ কিছুই প্রকাশ করতে পারছে না। ইচ্ছেও করছে না। নিঃশব্দে ফোন রেখে দিল সে। শ্যামল অনেক চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করার। নানা ভাবে এড়িয়ে গেছে অনি। রেখাকে এখন আর চেনাই যায় না। আরও সুন্দর হয়েছে। একটা সতেজ ভাব ফুটে উঠেছে চেহারায়।
কিছুদিনের মধ্যেই অনি চলে এল আমেরিকায়। সন্তানসহ এখানে বহু অবিবাহিত আমেরিকান সিঙ্গেল নারী কলিগদের মাঝে পঞ্চাশোর্ধ্ব চিরকুমারী নিঃসন্তান নিঃসঙ্গ বাংলাদেশি-আমেরিকান অনি ভালোই আছে।
এই ২৫ বছরে কত শত বার অনির মনে হয়েছে এ ঘটনা। যখনই নভেম্বর মাস আসে, যখনই দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় আর যখন কোনো ছুটির দিনে এ রকম রোদ ঝলমল সকাল আসে তখনই সে অনুভব করেছে—এই তো চোখের সামনে ঘটেছে এসব ঘটনা। চা কখন শেষ হয়ে গেছে। অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এল অনির মুখ থেকে বেনিফিট অব দ্য ডাউট।
গত ২৫ বছর ধরে এ রকম রোদ ঝলমলে প্রতিটি সকাল এভাবেই কাটছে অনির। মাঝে মাঝে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে, আর কত দিন কাটবে এভাবে?