
ভাইঝি প্রবন্তী শুরুতেই বলল, ‘আমরা চলে যাব পাঁচতলায়। ওখানেই ছবিগুলো আছে।’
সদ্য গ্রেড টেনে ওঠা নিউইয়র্কের বাসিন্দা এই মেয়েটির কথা তো অবহেলা করা চলে না। ওই তো আমাদের মূল পথপ্রদর্শক।
নিউইয়র্কের মোমাতে এসেছি। মোমা মানে মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট। কয়েক দিন আগে প্রথম আলোর আহমাদ মাযহার দিয়েছিলেন এক অসাধারণ তথ্য—প্রতি শুক্রবার বিকেল চারটা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মোমাতে ঢোকা যায় বিনা মূল্যে। খুব কম নিউইয়র্কপ্রবাসী বাঙালিই এই তথ্যটি জানেন। মোমা সম্পর্কে পড়তে গিয়ে জেনে যাই, নিউইয়র্কের অন্য জাদুঘরগুলোর মতো ডোনেশান দিয়ে ঢোকার ব্যবস্থা নেই এখানে। শুক্রবার ছাড়া বাকি দিনগুলোয় প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য টিকিটের দাম ২৫ ডলার, সিনিয়র সিটিজেন অর্থাৎ ৬৫ বছরের ওপরে বয়স হলে আইডি কার্ড দেখিয়ে এখানে ঢোকার জন্য লাগবে ১৮ ডলার, আর শিক্ষার্থীদের জন্য ১৪ ডলার। ১৬ বছরের কম বয়স হলে বিনা মূল্যে ঢুকতে পারবে যখন-তখন।
নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের ফিফথ ও সিক্সথ অ্যাভিনিউয়ের মাঝে ৫৩ স্ট্রিটে এই মোমা। গত সপ্তাহের শুক্রবার বিকেল তিনটার কাছাকাছি সময়ে আমরা যখন মোমার দরজায় পৌঁছলাম, তখন তাদের এক কর্মচারী বললেন, একটু ঘুরে ৫৪ নম্বর স্ট্রিটে চলে যেতে। সেদিক দিয়েই ঢোকার ব্যবস্থা। ঘুরে ৫৪ নম্বর স্ট্রিটে এসে দেখি, দড়ি দিয়ে মোমায় ঢোকার পথটি আলাদা করে রাখা হয়েছে। আমাদের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে শ দুয়েক মানুষ। কিন্তু সারির লোকজন এগোচ্ছে খুব দ্রুতগতিতে। জাদুঘরের কর্মচারীরা ওই কিউয়ের মধ্যেই সবার হাতে দিয়ে দিচ্ছেন ফ্রি টিকিট। আমাদের সাতজনের দলটি এগিয়ে যেতে থাকে আর তক্ষুণি প্রবন্তী বলে, ‘আমরা চলে যাব পাঁচতলায়।’
পাঁচতলার স্বর্গে
রেনেসাঁর শিল্পীদের চেয়েও ইমপ্রেশনিস্টেরা আমাকে আজন্ম বেশি টানে তাঁদের যাপিত জীবনের কারণে। বিশেষ করে পল গগ্যাঁ আর ভ্যান গঘ। একই সঙ্গে এদুয়ার মানে, অগস্ত রেনোয়া, পল সেজান, ক্লদ মনের নামও বলতে হয়। আর ভিন্নধারার হলেও পাবলো পিকাসো তো অনেক বেশি আলোচনায় এসেছেন। তাঁর আঁকা ছবি দেখার কথা ভাবলেই রোমাঞ্চিত হতে হয়। বাংলাদেশে বসে এদের কারও অরিজিনাল ছবি দেখার সুযোগ আমার হয়নি। তাই রোমাঞ্চটা ছিল অনেক বেশি। পঞ্চম তলার করিডর থেকেই টানানো হয়েছে ছবি। এখানেই পল সেজান আর পিকাসোর দুটো ছবি দেখি আমরা। ভিড়ের মধ্যে ছবির সঙ্গে ছবিও তুলি প্রমাণ হিসেবে দেখাতে পারব বলে। ছবি তোলায় নিষেধ নেই। কিন্তু ভিডিও করা যায় না। শুরুর রোমাঞ্চ কাটিয়ে উঠে প্রথম হলঘরে ঢুকে অবাক হই। একটি ছবির সামনে মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। কার আঁকা ছবি? কোন ছবি? আমরাও দ্রুত পা চালাই সেদিকে। সবাইকে বলে দেওয়া হয়, ছবি দেখা শেষে কোথায় গিয়ে আবার মিলতে হবে, নইলে লোকের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
ছবিটি ভ্যান গঘের আঁকা ‘স্টারি নাইট’, যাকে বাংলায় বলা যায় ‘তারাভরা রাত’। খুব বড় নয় ছবিটি। প্রস্থে ৭৩ দশমিক ৭ সেন্টিমিটার, দৈর্ঘ্যে ৯২ দশমিক ১ সেন্টিমিটার। ভ্যান গঘ ছবিটি আঁকেন ১৮৮৯ সালে। ১৯৪১ সাল থেকে এটি আছে নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে। ভ্যান গঘের জীবনী যারা পড়েছেন তারা জানেন, তেলরঙের এই ছবিটি যখন এঁকেছেন ভ্যান গঘ, তখন পল গগ্যাঁকে নিজের কাছে আমন্ত্রণ, তাঁর সঙ্গে ঝগড়া, নিজের কান কেটে ফেলা, মানসিক হাসপাতালে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনাগুলো ঘটে গেছে তারঁ জীবনে। ওই হাসপাতালে বসেই নিজের সেরা কিছু কাজ করেছিলেন ভ্যান গঘ। ‘স্টারি নাইট’ তারই একটি।
সফরসঙ্গী ডা. চন্দনা সুলতানা ফিসফিস করে জানতে চান, ‘এটা কি ভ্যান গঘের আঁকা অরিজিনাল ছবি? নাকি রেপ্লিকা?’
বুঝিয়ে বলতে হয়, পৃথিবীর সেরা চিত্রকর্মগুলোর বেশির ভাগই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আমেরিকার নিউইয়র্ক, রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ আর ফ্রান্সের প্যারিসে। নিউইয়র্কের মোমা, মেট, পিটার্সবার্গের এরমিতাশ (হেরমিটেজও বলা হয়ে থাকে) আর প্যারিসের লুভে গেলে পৃথিবীর সেরা শিল্পীদের প্রায় প্রত্যেকের খাঁটি কাজ দেখতে পাওয়া যাবে। এ ছাড়া এদিক-ওদিক আরও অনেক জায়গাতেই তাদের আঁকা ছবি আছে, কিন্তু একসঙ্গে অনেক ছবি দেখতে হলে এই তিন দরজায় কড়া নাড়তে হবে।
স্টারি নাইটের ঘরটি পার হওয়ার পর আমরা যে ঘরে যাই, সেখানে পিকাসোর অনেকগুলো কাজ। কিউবিজমে যাওয়ার প্রথম কাজটাই এখানে রয়েছে, বিশাল সে কাজ। ‘দ্য ইয়ং লেডিজ অব আভিনন’ নামের ছবিটিতে পাঁচ নারীকে দেখা যায়। তাঁদের দুজনের মুখে আবার আফ্রিকান মুখোশ। এ ছবিতে নীল, গোলাপির মিশেল রয়েছে। পিকাসোর শিল্পী জীবনকে যে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়, তার মধ্যে নীল ও গোলাপী দুটি ভাগ। পল সেজানের একটি ছবি এবং ইবেরিয়ান স্টাইল ছিল ছবিটি আঁকার অনুপ্রেরণা।এখান থেকেই পিকাসো বদলাচ্ছিলেন আবার।
ডোবা ও জলপদ্ম
অঁরি মাতিসের ‘ডান্স’ বা ‘নৃত্য’ ছবিটি দেখতে গিয়ে মনে পড়ল, এ বিষয়ে কবে যেন পড়েছিলাম! পাঁচজন নাচছেন হাত ধরাধরি করে, তিনটি মাত্র রঙের ব্যবহার ছবিতে—নীল, গোলাপী আর সবুজ! এই ‘ডান্স’ একটি নয়, দুটি আঁকা হয়েছিল। একটি আমাদের চোখের সামনে, আরেকটি রয়েছে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে।
মাতিসের ‘পিয়ানো লেসন’টাও ভালো লাগল। তার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম আমরা। শুধু আমরা কেন, জাদুঘরে আসা প্রতিটি মানুষই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ছবিগুলোর সামনে। অবশ্য এমন অনেকেই আছেন, যারা তাতে বিরক্ত হচ্ছেন। ছবি তোলার ঠেলায় তারা ঠিকভাবে উপভোগ করতে পারছেন না চিত্রশালার পরিবেশ।
পিকাসোর ‘ঝরনার ধারে তিন রমণী’ দেখা শেষ করে যখন সামনে এগোচ্ছি, তখন পাশের ঘরটিতেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ক্লদ মনের ‘ওয়াটার লিলি’ বা জলপদ্ম। এখানে পৌঁছানোর পর একটা বেশ মজার ঘটনা ঘটল। মোমার যে কর্মী এখানে ছিলেন, তিনি বাঙালি। খুবই উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘দেখেন দেখেন। ভালো করে দেখেন। এই ছবি দেখার জন্যও মানুষ ভিড় করে। কী আঁকসে, কে জানে, ডোবার মধ্যে পদ্ম ফুল, এইটা দেখার জন্য এত ভিড়!’
ওয়াটার লিলি অনেকগুলোই এঁকেছেন ক্লদ মনে। লুভের পাশে ওরাগারিয়ে নামে এক মিউজিয়ামে আছে মনের জলপদ্মের বিশাল বিশাল আটটি ছবি। জলপদ্ম ক্লদ মনের শেষ বয়সের প্রেম। সিরিজটি তিনি এঁকেছেন ৮২ বছরের জীবনের শেষদিকে এসে। মোমায় আমরা তারই একটা ছবি দেখতে পেলাম। পেলব পুকুরে ফুটে থাকা জলপদ্ম, এক কোমল অনুভূতি এনে দিল মনে। আমরা জানতে পেরেছি, এই শহরেই মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট-এ ক্লদ মনের আরও অনেক কাজ দেখার সুযোগ আছে। সেখানেও হানা দেওয়া হবে, সে তো সময়ের ব্যাপার মাত্র।
মানুষ আর মানুষ
কত শত শিল্পীর কাজ যে এখানে আছে, তা যেমন বলে শেষ করা যাবে না, তেমনি একদিনে দেখেও শেষ করা যাবে না। আমরা অনেকটা ‘বুড়ি ছোয়া’ স্টাইলে ছবিগুলো দেখেছি। ছবি দেখার বর্ণনা আসলে ছবি দেখার আনন্দের তুলনায় কিছুই নয়। তাই ছবি দেখার আনন্দ ও রোমাঞ্চ পেতে হলে ছবিগুলো সামনাসামনি দেখে ফেলা দরকার। যতই বলি না কেন, ছবিটা খুব সুন্দর, তাতে বোঝাই যাবে না কতটা সুন্দর, যদি ছবিটা না দেখি।
তাই আপাতত ছবির বর্ণনা বাদ দিয়ে মিউজিয়ামের কথাই বলি।
শুক্রবার বিনে পয়সায় জাদুঘর ঘুরে দেখা যায় বলে ভিড়টাও থাকে বেশি। নানা দেশের নানা ধরনের মানুষ দেখা যায় এখানে। নিউইয়র্কে মূলত স্প্যানিশ, আফ্রিকান আর এশিয়ান অভিবাসী মানুষই বেশি। তবে পর্যটক হিসেবে ইউরোপীয়দের ভিড়টাও কম নয়।
ম্যানহাটনের ফিফথ অ্যাভিনিউয়ের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে অনেক মিউজিয়াম। তবে তা খুব কাছাকাছি নয়। কোন স্ট্রিটে কোন জাদুঘর, সেটা জানতে পারলেই বোঝা যাবে, কয় ব্লক পার হয়ে কোন জাদুঘরে যেতে হবে। সাবওয়ে বা মেট্রোতে করে ঠিক জায়গায় এসে তারপর হাঁটা আর হাঁটা। ম্যানহাটনে মানুষ শুধু হাঁটতেই থাকে। শত শত মানুষ হেঁটেই চলেছে। সেই ধাবমান মানুষের মধ্যে কত জাতির কত ধরনের মানুষ যে আছে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
এখানে কথা বলার জন্য ইংরেজি জানতে হয়। কিন্তু কোনো কোনো জায়গা আছে, যেখানে একসঙ্গে অনেক স্বদেশি ভাই-বোনের বাস। কোথাও বাঙালিপাড়া, কোথাও চীনা পাড়া, কোথাও রুশ পাড়া। এসব জায়গায় থাকলে বছরের পর বছর নিজ দেশের ভাষা পুঁজি করেও থাকা যায়। কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো ইংরেজি জানলেই হয়। এই জাদুঘরে এসে মনে হচ্ছে, এ রকমই সারা পৃথিবীর শিল্পীদের মহামিলন হয়েছে এখানে।
গর্ভিণী
পাঁচতলা থেকে নেমে জাদুঘরের ভেতরেই যে বাগানটায় নামলাম, তার নাম ‘দ্য অ্যাবি অল্ডরিচ স্কাল্পচার গার্ডেন’। এখানেই যে পিকাসোর বিখ্যাত শি গোট বা গর্ভিণী ছাগলের দেখা পেয়ে যাব, তা কে জানত? এই ছাগলের ছবি আগে দেখেছি অনেকবার। ভাস্কর্য নিয়ে পড়তে গিয়ে এর দেখা মেলে।
পিকাসো এই ছাগলটির ভাস্কর্য বানিয়েছিলেন ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া লোহালক্কড় আর সিরামিক দিয়ে। প্রথমে ভেবেছিলাম, এ বুঝি রেপ্লিকা। মূল কাজ এখানে আসবে কোত্থেকে? কিন্তু এ তো সত্যিই পিকাসোর স্থাপত্যকীর্তি! স্পষ্ট লেখা আছে! তাৎক্ষণিক গুগলের শরণাপন্ন হলে সেও জানাল, কোনো সন্দেহ নেই, এই মাস্টারপিসটা পিকাসো নিজ হাতেই তৈরি করেছেন।
আমরা বেশ বুঝে গেলাম, ৪ ঘণ্টায় এই জাদুঘর দেখে শেষ করা সম্ভব নয়। তাই আরও একদিন যাব বলে ঠিক করলাম। ফেরার পথে চোখে ভাসতে থাকল কীর্তিমানদের আঁকা ছবিগুলো। সে যে কী রোমাঞ্চ, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। শুধু এটুকু বলি, কখন সাবওয়েতে উঠলাম, কখন এক লাইনের ট্রেন থেকে নেমে আরেক লাইনে গেলাম, কখন নামলাম, তার কিছুই সেভাবে মনে করে উঠতে পারছিলাম না। শুধু বাড়িতে পৌঁছানোর পর বুঝতে পারলাম, ফিরে এসেছি। কিন্তু চোখে তখনো ভ্যান গঘ, ক্লদ মনে, পল সেজান, পল গগ্যাঁ, পিকাসো...