Thank you for trying Sticky AMP!!

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি গণমাধ্যমের ভূমিকা

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যা বিশ্বজনমত গঠনে সহায়তা করে। তা ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, নৃশংস বর্বরতা, ধ্বংসযজ্ঞ, শরণার্থীদের দুর্ভোগ বহির্বিশ্বে তুলে ধরায় বিশ্ববাসী মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরেছে। এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত হয়েছে। বিদেশি প্রচারমাধ্যম বিশেষ করে রেডিওর বিভিন্ন খবর, কথিকা, গান  মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দেয় এবং সাহস জুগিয়ে বিজয়ের পথ সুগম করে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো বুঝতে পারে, একটা কিছু হতে চলেছে। তাই তারা তাদের সাংবাদিকদের বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) পাঠাতে শুরু করে। এদের বেশির ভাগই ২৫ মার্চ অবস্থান নেন তৎকালীন শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। এদের মধ্যে ছিলেন আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপানের প্রায় ৩৭ জন সাংবাদিক। ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরুর প্রাক্কালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বিদেশি সব সাংবাদিককে হোটেলে অবরুদ্ধ করে রাখে এবং সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। দেশের খবর যাতে বহির্বিশ্বের মানুষ  জানতে না পারে, সে জন্য সব বিদেশি সাংবাদিকদের দেশত্যাগের নির্দেশ দেয়। বেশ কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে হোটেলের ছাদে উঠে ঢাকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন ও কেউবা রাতের আঁধারে খবর সংগ্রহে বেরিয়ে পড়েন। তারা খবর সংগ্রহ করে ছবিসহ নিউজ বিদেশগামী প্লেনের বিভিন্ন যাত্রীর মাধ্যমে নিজ নিজ দেশের পত্রিকায় পাঠিয়ে দেন।

পরদিন ২৬ মার্চ কলকাতা আকাশবাণী, বিবিসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম গুরুত্ব সহকারে গণহত্যার বিবরণ প্রচার করতে থাকে।

১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ লন্ডনের ‘দ্য অবজারভার’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়, রাশিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারে। মস্কো উপলব্ধি করতে পেরেছে, পরাশক্তিগুলো যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, তবে পাকিস্তানের গণহত্যা বন্ধ হতে পারে। অন্য একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অভ্যুত্থানের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী খবর পাওয়া গেছে। পাকিস্তানি সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, শেখ মুজিবকে তারা ঢাকায় তাঁর নিজ বাসভবনে আটকে রেখেছে। অন্যদিকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, তিনি চট্টগ্রাম রয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি, উপযুক্ত সময়ে ব্যবস্থা নেব।

এদিকে ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান মানেকশ পুনে সফর সংক্ষিপ্ত করে দিল্লি ফিরেছেন। ‘মুজিব যেভাবে বাঙালির মহানায়ক হলেন’ শিরোনামে অন্য একটি প্রতিবেদনে শেখ মুজিব কীভাবে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন, তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে সাংবাদিক সিরিল ডানের এক প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়।

লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ ৩০ মার্চ ১৯৭১ সালে সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যিনি ২৫ মার্চের গণহত্যার সময় বাংলাদেশে ছিলেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঠান্ডা মাথায় ২৪ ঘণ্টা অবিরাম গোলাবর্ষণ করে প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে হত্যা করে। পুলিশ সদর দপ্তর, ছাত্রাবাস, দোকানপাটে নির্বিচারে হত্যা ও আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার খবর দেয়। এতে তারা আরও লেখে, বাঙালি জনগণ যে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল, তা গত সপ্তাহে বেদনাদায়ক এক গণহত্যার মাধ্যমে শেষ হয়ে গেছে। এই দুঃস্বপ্ন ভুলতে তাদের কয়েক প্রজন্ম লেগে যাবে।

টাইম সাময়িকী ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে তারা উল্লেখ করে, পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সম্ভবত কিছু সময়ের জন্য ঢাকাসহ পূর্বাংশের শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু অনির্দিষ্টকাল ৫৪ হাজার বর্গমাইলের বিশাল অঞ্চল বাগে রাখতে পারবে না। কারণ ব্রিটিশরাজ ১৯১১ সালে বাঙালির ভয়ে রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করেছিল।

১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল নিউজউইক ‘একটি আদর্শের মৃত্যু’ শিরোনামে একটি নিউজ ছাপে। এতে বাঙালির আত্মবিশ্বাস, গণজাগরণ ও পাকিস্তানিদের প্রতি তাদের ঘৃণার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়। একদল লিকলিকে রোগা হতদরিদ্র বাঙালি কীভাবে সড়কি, বল্লম আর বাঁশের লাঠি দিয়ে যশোরে ১ হাজার পাকিস্তানি সুসজ্জিত বাহিনীকে আটকে রেখেছিল, তার এক সুন্দর বর্ণনা রয়েছে প্রতিবেদনটিতে।

ডেট্রয়েট ফ্রি প্রেস ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাতে তারা উল্লেখ করে, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী সরকার গত মঙ্গলবার পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নিজের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করেছে এবং বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশের প্রতি স্বীকৃতি ও সহায়তার আবেদন জানিয়েছে।’

লন্ডনের দ্য অবজারভার ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল ‘স্বপ্নভঙ্গের পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক নিউজ প্রকাশ করে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগে, ছাত্রহত্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জি সি দেব, পরিসংখ্যান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. এ এন মনিরুজ্জামান, হিন্দু ছাত্রাবাস জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ও ইংরেজি বিভাগের রিডার ড. অবিনশ্বর চক্রবর্তী ছাড়াও আরও ৫ জন প্রভাষককে হত্যার খবর ছাপে।

১৯৭১ সালের ১৩ জুন দ্য সানডে টাইমস ‘গণহত্যা’ নামে ১৪ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন ছাপে যার লেখক ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। মার্চের শেষে পশ্চিম পাকিস্তানিদের পরিকল্পিতভাবে হাজার হাজার বেসামরিক লোককে হত্যা, ধর্ষণ, ৫০ লাখের বেশি মানুষের শরণার্থী হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া, গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর জ্বালিয়ে দেওয়া ও লুটপাটের ঘটনার বিশদ বিবরণ দেয়।

দ্য স্পেকটেটর ১৯৭১ সালের ১৯ জুন এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাতে তারা উল্লেখ করে, পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী কয়েক সপ্তাহ ধরে পাকিস্তানে ব্যাপক হারে যে বর্বরোচিত গণহত্যা চালাচ্ছে, তার প্রমাণ প্রকাশ করার বিষয়টি থেকে এখন পিছিয়ে আসার কোনো কারণ নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই বিশ্বের সবচেয়ে জঘন্যতম গণহত্যা।

১৯৭১ সালের ২০ জুন দ্য সানডে টাইমস ‘পাকিস্তানে সংঘবদ্ধ নির্যাতন’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে তারা উল্লেখ করে, বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক হত্যা করছে, ম্যাজিস্ট্রেটদের গুলি করা হচ্ছে, চিকিৎসকেরা গায়েব হয়ে যাচ্ছে, গেস্টাপো কায়দায় চলছে তল্লাশি, ধর্ষণ ও নির্যাতন।

টরন্টো টেলিগ্রাম ১৯৭১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর এক সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে ৩০ লাখ টন খাদ্য ও ভারতে ৮০ লাখ শরণার্থীর খাদ্যের ব্যবস্থা করতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা উল্লেখ করে।

নয়াদিল্লি থেকে ‘দ্য উইকলি নিউ এজ’ পত্রিকা ১৯৭১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘বিজয় নিশ্চিত’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে তারা উল্লেখ করে, গত সপ্তাহে আমরা বাংলাদেশের ছয় মাসের লড়াইয়ের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখতে পাই, মুক্তিযোদ্ধারা বর্তমানে যেভাবে হয়রানি করছে তা আরও তীব্র হলে সামরিক দিক থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থান ভেঙে পড়বে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ নেই। এখন কাজ হচ্ছে এটিকে ত্বরান্বিত করা।

১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর টাইম সাময়িকী ‘যুদ্ধের ভেতর দিয়ে একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপে। এতে তারা লেখে, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বাংলা’। পদ্মা আর ব্রহ্মপুত্রের মতো বিশাল নদীর তীর, সবুজ প্রান্তর আর অসংখ্য গ্রামের অগণন চত্বর থেকে উঠছে বাংলার এই বিজয় ধ্বনি।

তা ছাড়া আকাশবাণীর দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, পঙ্কজ সাহা, উপেন তরফদার, এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’, স্টেটম্যান পত্রিকার মানস ঘোষসহ নাম না জানা অনেক সাংবাদিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন, যা বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে আজীবন স্মরণ করবে।

এ ছাড়া সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গ, লেয়ার লেভিন, আলোকচিত্রী কিশোর পারেখ, মাইকেল লরেন্ট, মার্ক টালি, নিকোলাস টোমালিন, জন পিলজার, মার্টিন অলাকসহ অনেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।