মেঘ মিলন মানে কী হতে পারে? মেঘে মেঘে মিলন? আজকাল তথ্য প্রযুক্তিতে মেঘ কথাটি ঢুকেছে। তাঁরা বলছেন, ‘ক্লাউড টেকনোলজি’। সে অর্থে, এই করোনাকালে ‘জুমে’ যদি একটি আড্ডা হয়, যেখানে সবাই সবাইকে দেখতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে, এমনকি পাশাপাশি ১৬ জন মানুষের প্রাণবন্ত মুখ তাৎক্ষণিক চলে আসছে। যিনি কথা বলছেন তাঁকে বড় করে দেখা যাচ্ছে, তাঁর পেছনের সাজানো বই দেখা যাচ্ছে, একটি বাচ্চা দৌড়ে চলে গেল তা-ও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে—তখন তাকে মেঘ-মিলন নাম দিলে বেশ কাব্যিক শোনা যায়।
‘রুদ্ধ তনু মুক্ত মন, সাহিত্যে হোক মেঘ মিলন’—এই স্লোগান নিয়ে ১০ ও ১১ অক্টোবর জুম ভিডিও কনফারেন্সে অভিনব সাহিত্য সমাবেশ হয়ে গেল। ছয়টি মহাদেশের ১৮টি দেশ থেকে বাঙালিরা যোগ দিলেন এই অপূর্ব সম্মেলনে।
শুরু হলো আবদুল গাফফার চৌধুরীর শুভেচ্ছা বাণী দিয়ে। কবি আসাদ চৌধুরী দেশের বাইরের কবিদের স্বরচিত কবিতা শুনলেন। প্যানেলিস্ট কবি শামীম আজাদ নোট লিখে, নাম ধরে কবিতার লাইনের উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর ঋদ্ধ পর্যালোচনা দিলেন। মতামত দিলেন কবি নাজমুন নেসা পিয়ারী। স্বরচিত পাঠের আসরটি বেশ মজার ছিল, দুজনের একটি করে প্যানেল। পাঠের পরেই কবিতা বা গল্পটি নিয়ে তাঁরা আলোচনা করেছেন।
বিদেশে বসে মাতৃভাষায় কতটুকু সাহিত্য চর্চা করা যায় সে বিষয়ে অনেক মতান্তর রয়েছে। ডায়াসপোরা সাহিত্য বলে একটি সাহিত্য বিশ্বব্যাপী রয়েছে। ডায়াসপোরা সাহিত্য লিখে নোবেল পুরস্কারও মিলেছে। কেউ কেউ বলছেন, আমরা বিদেশে থাকি দেখেই আমরা প্রবাসী সাহিত্যিক নই, আমরা সংখ্যায় অপ্রতুল বলেই আমাদের লেখাকে খাটো করে দেখা চলবে না। এর মাঝেই লন্ডনপ্রবাসী লেখক সাগুফতা শারমীন তানিয়ার সঙ্গে টেক্সাসের কবি কাজী মঈনুল হকের ‘অনাবাসী’ শব্দটি নিয়ে প্রায় বচসাই শুরু হয়ে গেল।
বিভিন্ন আলোচনা পর্বে এসেছিলেন প্রাবন্ধিক গোলাম মুর্শিদ, অধ্যাপক আলী রিয়াজ, লেখক ও সাংবাদিক আহমাদ মাযহার, প্রাবন্ধিক হাসান ফেরদৌস, সাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ সেলিম জাহান, কবি দিলারা হাফিজ, সাহিত্যিক আবদুন নূর, অধ্যাপক আমীনুর রহমান, শিক্ষাবিদ মোস্তফা সারওয়ার, লেখক অমিতাভ রক্ষিত, কবি আনিস আহমেদ, লেখক এস আশরাফ আহমেদ, লেখক খায়রুল আনাম, লেখক হায়দার আলী খান, লেখক মৌসুমী কাদের এবং আরও অনেকে।
রুদ্র শংকর, শামীম রেজাসহ অনেকের কবিতায় সাম্প্রতিক ধর্ষণের ঘটনা থেকে কবিমনের তথা সমাজের তীব্র প্রতিক্রিয়া উঠে এসেছে।
বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা নিয়ে আলোচনায় যোগ দিলেন দীপেন ভট্টাচার্য, বন্যা আহমেদ, স্বপন বিশ্বাস, রাশিয়া থেকে পদার্থবিদ বিজন সাহা। তাঁরা বিজ্ঞানমনস্কতা বাংলা ভাষায় ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বললেন। দীপেন ভট্টাচার্য বাংলায় বিজ্ঞান পরিভাষার ইতিহাস কিছুটা তুলে ধরলেন।
এই সমাবেশেই জানতে পেলাম ‘শুনি’ নামে বাংলায় অডিও বুকের অ্যাপ তৈরি করেছেন দুই তরুণী। তাঁরা হলেন ফাহমিদা ফেরদৌসী ও রুবাইয়া শারমীন। অ্যাপটি আইফোন বা অ্যান্ড্রয়েডে ডাউনলোড করে বাংলা বই শুনতে পাবেন।
এই সমাবেশের স্বপ্নদ্রষ্টা একুশে পদক প্রাপ্ত সাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত পূরবী বসু। সমাবেশটি হওয়ার কথা ছিল ক্যালিফোর্নিয়ার সানদিয়াগোতে। কিন্তু করোনার কারণে বিশ্ব বাংলা সাহিত্য সমাবেশ ‘মেঘে’ চলে গেল। ২০২১ সালে সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হবে নর্থ ক্যারোলাইনার শার্লটে, ২০২২ এ হবে ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলসে।
দুই দিনব্যাপী এই বিশাল অনুষ্ঠানটি জুমে আয়োজন করায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন ক্যালিফোর্নিয়ার মোহাম্মদ ইরফান ও দীপেন ভট্টাচার্য। অন্যদের ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়ার আনিসুজ্জামান, শীলা মোস্তফা, সামা আকবর, কাজী রহমান, আটলান্টার রিটন খান, আশফাক স্বপন, টরন্টোর ফারহানা আজিম, মৌ মধুবন্তী ও ভার্জিনিয়ার আনোয়ার ইকবাল।
এ এক সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক সংগঠন। এখানে প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারি নেই। আছেন একজন আহ্বায়ক। প্রতি বছর নতুন আহ্বায়ক আসছেন। এ বছর আহ্বায়ক ছিলেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। পরের বছর নর্থ ক্যারোলাইনার ধনঞ্জয় সাহা। তাঁদের আরও একটি অর্জন হলো, হৃদবাংলা নামে একটি সংকলন প্রকাশ করা। হৃদবাংলা সম্পাদনা করেছেন পূরবী বসু।
আড্ডা শেষের দিকে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসু বলছিলেন, তাঁদের স্বপ্ন পূর্ণ হলো। তাঁরা চলে যাবেন। সময়ের অমোঘ নিয়মে একদিন একে একে সবাই চলে যাবেন, তবু সে কথা কেউ যেন মানতে পারছিল না। সবাই চায়, যুগ-যুগ ধরে, দশক ও শতক ধরে বিশ্বজুড়ে অনাবাসী বাঙালিদের নিয়ে চলুক এমন একটি জমজমাট সাহিত্য সমাবেশ; জ্যোতি-পূরবী যুগলের স্নেহ ছায়ায়।