
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের ‘দুই পাখি’ কবিতাটিতে কবি যেভাবে স্বাধীনতার দর্শন পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন, তা নানা বিবেচনাতেই ব্যতিক্রমধর্মী। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানে যেমন ঈশ্বর ও ভালোবাসার মানুষ এক ও অভিন্ন হয়ে পড়েন, পাঠককে গভীর মগ্নতার সঙ্গে ভাবতে হয় ‘কে ঈশ্বর’, ‘কে ভালোবাসার মানুষ’ ইত্যাদি এবং এই উপসংহারে পৌঁছাতে হয় যে, ভালোবাসার জনই তো ঈশ্বর, আর ঈশ্বরই তো সর্বোচ্চ ভালোবাসার পাত্র। শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর ও ভালোবাসার মানুষ নির্দ্বিধায় একাকার হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্যায়ের গান, যেমন প্রার্থনাতে, সংগীতে নিবেদন করা যায়, একইভাবে প্রার্থনা সংগীতকে ভালোবাসার জন্য নিবেদন করা যায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে। মহৎ সাহিত্যিক ও দার্শনিকেরা এ রকমই বিস্ময় তৈরি করতে পারেন বলে তাঁরা নিজেরাই হয়ে ওঠেন বিস্ময়কর, কখনো কখনো অতীন্দ্রিয়।
‘দুই পাখি’ কবিতাটি আমি হাতের কাছে সব সময় রাখি। কবিতাটি ভালো লাগে বলেই যে রাখি তা নয়, কবিতাটি আসলে বোঝার চেষ্টা করি। বহুবার পড়েও কবিতাটি ঠিক বুঝতে পারি না বলে আমার কাছে এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করে। বুঝতে না পারার দায় কখনো কখনো রবীন্দ্রনাথের ওপর চাপাতে ইচ্ছে করে। আবার মন যখন স্থির হয়ে এলে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় নিজেকে প্রবোধ দিই—‘এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু’ বলে। স্বাধীনতার, ভালোবাসার বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা, বহুমাত্রিক অর্থ কবিতাটির চরণে চরণে প্রবল আবেগে সরলভাবে উপস্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কবিতাটির উপসংহারে চিরায়ত পথে তিনি হাঁটেননি। সাধারণ বাঙালি পাঠক তাই সমীকরণ মেলাতে না পেরে ভাবনার অতল সাগরে নিক্ষেপিত হয়ে পড়ে। দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ পাঠকের হাতে ধরিয়ে দেন গণিতের কঠিন সমস্যার ‘বাড়ির কাজ’। সমস্ত কবিতাতে রবীন্দ্রনাথ এতই নির্মোহ থাকেন যে, তাঁর পক্ষপাতিত্ব বুঝতে পারা যায় না। গূঢ় বার্তা বুঝতে আমার মতো সাধারণ পাঠকের মস্তিষ্কে তাই ঝড় বয়ে যায়।
মহৎ কবিরা শুধু বিস্ময় ও ভাবালুতা তৈরির মাধ্যমেই পাঠক মনে ভাবনার উদ্রেক করেন না, তাঁরা যে বার্তাটি পাঠককে দিতে চান, তা হয় শাশ্বত ও প্রাসঙ্গিক। ‘দুই পাখি’ কবিতার বার্তাটিও দেশ-কালের পরিপ্রেক্ষিতে অতি প্রাসঙ্গিক। আমি কবিতাটির নতুন কোনো মূল্যায়ন করতে এ লেখার অবতারণা করছি না। বারবার পড়ে কবিতাটি যতটা ধারণ করতে পেরেছি, আমাদের দেশের মানবমুক্তির অবস্থা ও অবস্থানের সঙ্গে তার কিছু তুলনা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করার চেষ্টা করছি।
কবিতাটিতে একটা গল্প আছে। গল্পটা খুব সহজ; পরিবেশনা আরও সহজ। এই যে ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’, রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের কথাটিকে সহজেই অতিক্রম করেন এই কবিতায়। পাঠক গল্পটি বুঝতে পারেন, কিন্তু পড়া শেষে বিস্ময় ও ধন্দ থেকেই যায়। আশ্চর্যজনকভাবে হালের বাংলাদেশের মানুষের মানসিক গঠনের প্রতিফলনও দেখা যায় এ কবিতায়।
বনের পাখি, আর খাঁচার পাখির দেখা হয়ে যায় বিধাতার বিধির লিখনে। বনের পাখি দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, খাঁচার পাখিকে আহ্বান জানায় বদ্ধ খাঁচা, পরাধীন এক ঘেয়ে শেকলপরা জীবন ছেড়ে বনের স্বাধীন জীবনে চলে আসতে। কী আশ্চর্য, খাঁচার পাখি তাতে সম্মত হতে পারে না। বরং খাঁচার পাখি বনের পাখিকে পরিপাটি, নিরিবিলি খাঁচায় চলে আসার আহ্বান জানায়। স্বাধীনতার, মুক্তির স্বাদ নিতে চায় না খাঁচার পাখি। কিন্তু কেন? সজ্জিত, পরিপাটি খাঁচায় দিনের পর দিন বাস করে খাঁচার পাখির মনে এক অজানা ভয়, সংশয়, আত্মবিশ্বাসহীনতা কাজ করে। স্বাধীন, মুক্ত জীবনের স্বাদ তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত, অনাস্বাদিত। খাঁচার ভেতরের নির্ভরশীল পরিপাটি জীবনে সে অভ্যস্ত। বনের পাখি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বুনো গান গেয়ে খাঁচার পাখিকে তার হৃদয়ের অনুভূতি জানাতে চায়। ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা, ভিন্ন গানে শুনে অভ্যস্ত খাঁচার পাখির কাছে তা দুর্বোধ্য। প্রত্যুত্তরে খাঁচার পাখি যখন তার শেখানো বুলি এবং গান দিয়ে বনের পাখির সঙ্গে ভাব বিনিময়ের চেষ্টা করে, বনের পাখিও তখন সে ভাষা বুঝতে পারে না। খাঁচার পাখি তাকে অনুরোধ করে, খাঁচার গান শিখে নিতে। বনের পাখি মুক্ত জীবনের সংগীত বর্জন করে শেখানো গান গাওয়ার অনুরোধে অপারগতা প্রকাশ করে। পাঠকের বিস্ময়ের ঘোর কাটে না, যখন মুক্ত, স্বাধীন অবাধ জীবনের আমন্ত্রণ আসে বনের পাখির কাছ থেকে আর খাঁচার পাখি দ্বিধান্বিতভাবে তার সীমাবদ্ধতার কথা জানায়। কী চমৎকার, কী সহজ ভাব বিনিময়—
‘বনের পাখি বলে, ‘আপনা ছাড়ি দাও
মেঘের মাঝে একেবারে।’
খাঁচার পাখি বলে, ‘নিরালা সুখ কোণে
বাঁধিয়া রাখো আপনারে।’
বনের পাখি বলে—‘না’
সেথা কোথায় উড়িবারে পাই।’
খাঁচার পাখি বলে—‘হায়
মেঘে কোথায় বসিবার ঠাঁই!’
গৃহকোণে, শেকলে বাঁধা থেকে অভ্যস্ত খাঁচার পাখির শূন্য আকাশ, মেঘের কোলে ঠাঁই নেওয়া তার কল্পনার অতীত। বরং নির্দেশিত ও নিয়ন্ত্রিত জীবনাচরণ তার কাছে অনেক বেশি গ্রহণীয়। খাঁচার পাখি বনের পাখিকে বুঝতে পারে না; দুজন দুজনাকে বোঝাতেও পারে না। মুক্ত আকাশে ডানার ওপর ভর করে শূন্যে উড়ে যাওয়ার আনন্দ বোঝানোর ক্ষমতা হয় না বনের পাখির। একই পৃথিবীতে খাঁচার এপার, ওপার থেকে মানসিকভাবে কত দূরে! ভাষা, আচরণ, অভ্যাস, মানসিকতা, সংগীত, সংস্কৃতি এক হওয়ার কথা থাকলেও নিয়ন্ত্রণ, নির্দেশ, অভ্যাস ভিন্ন হওয়ায় দুজনের কাছে দুজন সম্পূর্ণ অপরিচিত। একজন আরেকজনকে ভালোবাসে। খাঁচার এপার-ওপার উভয় পাশ থেকেই অশ্রু ঝরে। ভালোবাসার অনেক গভীর বর্ণনা পড়ে পাঠকের চোখেও অশ্রু ঝরে—
‘এমনি দুই পাখি দোহারে ভালোবাসে
তবুও কাছে নাহি পায়।
খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে পরশে মুখে মুখে,
নীরবে চোখে চোখে চায়।’
কবিতাটিতে যে গল্প আছে, গল্পটির উপসংহার মিলনাত্মক হতে পারত। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা বিবেচনায় উপসংহার বিয়োগান্ত হয়ে যায় খুবই স্বাভাবিকভাবে। বনের পাখি সব শেষে যখন সকাতর আহ্বান জানিয়ে খাঁচার পাখিকে মুক্ত পৃথিবীতে আসার জন্য বলে, তাতে পাওয়া যায় অন্তরের উচ্চারণ, রোমান্টিক আবহ। হৃদয়ের গহিন থেকে উঠে আসে এ আহ্বান। এর বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা আছে। পাঠক কখনো ভাবে এটি ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার আহ্বান। আবার মনে হয় পরাধীন শৃঙ্খলিত প্রাণকে মুক্তির মন্দিরের পাদদেশে আসার আহ্বান। এ আহ্বান যখন খাঁচার পাখির হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করে, তখন অনাদিকাল থেকে পরাধীন থাকা আত্মবিশ্বাসহীন খাঁচার পাখিটি অসহায় আর্তনাদের মতো তার আকুতি তুলে ধরে, ‘হায়- শক্তি নাহি উড়িবার।’ মনে হয় পাখিটি উপলব্ধিতে মুক্ত জীবনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হলেও সে নিরুপায়। তার প্রাণশক্তি প্রাণশক্তি নেই। হীনবল পাখিটি নিজের মুক্তির সাধটি পূরণ করার ন্যূনতম ক্ষমতাটিও হারিয়ে বসেছে।
এই পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ বড় নির্মম। চিরায়ত বাঙালির মতো এখানে তিনি আবেগপ্রবণ নন। খাঁচার পাখির মুখে মুক্ত হওয়ার বাসনার কথা বসিয়ে দেন না। বরং বাস্তবতার কাছে হার মানা খাঁচার পাখির মুখ দিয়ে তিনি বলেন, ‘হায়- শক্তি নাহি উড়িবার।’ পাঠকপ্রিয় হওয়ার লোভ সংবরণ করে তিনি বাস্তবতা ও সত্যের কাছেই নিষ্ঠ থেকেছেন। চিরায়ত মিলন অথবা শৃঙ্খলমুক্তির কোনো ইঙ্গিত না দিয়ে একটি বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দেন। পাঠক ভাবতে থাকে হয়তো সার্বিক মুক্তির কথাই তিনি বলছেন। আবার হয়তো ভাবে, মুক্তির আকাঙ্ক্ষাই জাগ্রত করে তুলছেন কবি। নৈরাশ্যবাদীদের ব্যাখ্যা এমনও হয়, আপাত সুখ, মানুষকে নির্ভরতার শৃঙ্খলে বন্দী করে ফেলে ক্রমশ।
বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার দাড়িচিহ্ন অঙ্কিত হয় যে মাসে, সে মাসে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করি রবীন্দ্রনাথের স্বাধীনতার দর্শন ও আমদের প্রাপ্ত স্বাধীনতাকে মিলিয়ে দেখতে। সেই মিলিয়ে দেখার অঙ্ক সরলভাবে দেখলে মিলে যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো কিছুটা নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখলে মনে হয়, সার্বিক মুক্তির জন্য আমদের আরও কাজ করে যেতে হবে। আমরা কি আমাদের সবার মনের আকুল আকাঙ্ক্ষা স্ব-অধীনভাবে জীবন যাপনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পেরেছি। আমাদের অর্থনীতির অঙ্ক ক্রমাগত জটিল হয়ে পড়ছে। ওই যে সকলে মিলে সমানভাবে ভাগ করে ভোগ করার অঙ্গীকার, তা থেকে আমরা দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছি। বৈষম্য ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার আমাদের ছিল, সে পথে কি আমরা হাঁটছি? ব্যাংকের টাকা লোপাট করে সেকেন্ড হোম বানানোর জন্য আমাদের অনেকেই যখন তৎপর, তখন কি আমাদের দেশ মায়ের ‘বদনটি’ মলিন হয়ে যায় না? আমাদের ভাবতে হবে, অঙ্গীকারকে দৃঢ় করতে হবে। বলতে হবে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। আমরা আমাদের রক্ত দিয়ে গড়া স্বদেশের মাটিকে কারও সেকেন্ড হোম গড়ার সহজ উৎস হিসেবে ব্যবহার করতে দিতে চাই না। বাংলাদেশ হোক আমাদের সবার। সবকিছুর জন্য ভালোবেসে বিচরণের প্রথম ক্ষেত্র হোক। আমরা আহ্বান জানাই, সব নাগরিককে সমানাধিকার নিয়ে, সমান সুযোগ নিয়ে আমাদের প্রথম ভালোবাসার ক্ষেত্রে অবাধে বিচরণের জন্য। যেমন বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘দুই পাখি’ কবিতায়—
‘বনের পাখি বলে, আকাশ ঘন নীল
কোথাও বাধা নাহি তার’, কিংবা স্বাধীনতার চূড়ান্ত সুখ উপভোগের জন্য শূন্যে মেঘের কোলে চরম নির্ভরতায় হারিয়ে যাওয়ার আন্তরিক সেই আমন্ত্রণ—
‘আপনা ছাড়ি দাও
মেঘের মাঝে একেবারে।’