
সারা বিশ্ব যখন অনিশ্চয়তার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে, অতিব্যবহারে নাকাল পৃথিবী ফুঁসে উঠছে, যুদ্ধ একটি স্বাভাবিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে, ঠিক তখনই আমেরিকার জনগণ একজন তামাশাপ্রবণ ব্যক্তিকে নিজেদের নেতা হিসেবে নির্বাচন করেছেন। এমন ধারা অবশ্য গল্প কিংবা চলচ্চিত্রে খুব একটা অপরিচিত নয়। অনেক গল্পেই দেখা যায় দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতার মধ্যে নিজের মন ভোলাতে রাজাকে বিদূষকের শরণাপন্ন হতে। বাইরে চলছে যুদ্ধ, আর রাজা শুনছেন কৌতুক। এটা রাজার খেয়াল। আর অস্থির সময়ে ক্ষমতাধর একটি দেশের জনগণ একজন কৌতুকপ্রবণ নেতাকে নির্বাচন করবেন, এটা জনতার খেয়াল।
নির্বাচনী প্রচারের সময় থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখে যে কথাটি সবচেয়ে বেশি শোনা গেছে তা হলো, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’। অভিষেক দিনেও এর ব্যত্যয় হয়নি। ২০ জানুয়ারি অভিষেক বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘আজকের দিন থেকে শুধু আমেরিকাই প্রথম! আমেরিকা ফার্স্ট।’ সেই সময় তিনি নিজেও হয়তো ভাবতে পারেননি, সারা বিশ্বের কৌতুকপ্রিয় মানুষের হাতে তিনি কত বড় অস্ত্র তুলে দিলেন, যে অস্ত্রে শুধু তিনিই নন, আমেরিকাও কাটা পড়তে যাচ্ছে।
ওই অভিষেক অনুষ্ঠানের পর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আমেরিকাকে উদ্দেশ করে ছুটে আসতে থাকে তামাশার তির। এখানে নেদারল্যান্ডসের এক কমেডিয়ানের করা প্রশ্নটিই শুধু উত্থাপন করা যেতে পারে। সদ্য প্রেসিডেন্ট হওয়া ট্রাম্পের আত্মগৌরব নিয়ে বিস্তর হাস্যরসের পর দেশটির জনপ্রিয় কমেডিয়ান আরজেন লুবাচ প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমরা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি যে আমেরিকা প্রথম হতে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা কি দ্বিতীয় স্থানে নেদারল্যান্ডসের কথা বলতে পারি? অনুমতি আছে কি?’ এমনকি ৪৫তম মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্য ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি প্রতিযোগিতাও শুরু হয়েছিল সে সময়, যার নাম ছিল, ‘এভরি সেকেন্ড কাউন্টস’।
রাজনীতি খুব খটমট একটি ব্যাপার, এই যাদের ধারণা, সেই রামগড়ুরের ছানাদের মুখেও একটু হাসি এনে দিতে বছরজুড়েই নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। চরম রাজনৈতিক বিভিন্ন পোস্টে সচেতনভাবেই তিনি তামাশার আঁচড় দিয়েছেন, যা সিরিয়াস রাজনীতিক ও রাজনীতি বিশ্লেষকদের মুখে স্মিত হাসির রেখা টেনে দিয়েছে। আমেরিকায় রাজনৈতিক স্যাটায়ারের পালেও জোর হাওয়া দিয়েছে এই ট্রাম্প প্রশাসন। এক ‘স্যাটারডে নাইট লাইভ’ কমেডি শোয়ের কথা বিবেচনা করলেই এর সত্যতা মিলবে। গত ২২ বছরের মধ্যে এ অনুষ্ঠান এ বছরই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে। আর এই জনপ্রিয়তার মূলে ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, তাঁর তৎকালীন প্রেস সচিব শন স্পাইসার ও অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশন্স। না, তাঁরা এই অনুষ্ঠানে অংশ নেননি। তাঁদের শুধু অনুকরণ করেছিলেন কমেডিয়ানরা।
সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায় বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্টের অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাকে রীতিমতো ‘বক্স অফিস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট। আর নিউইয়র্ক টাইমস-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জোসেফ কানও একই কথা বলেছেন। গত অক্টোবরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমের ব্যবসার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন, বিশেষত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অত্যন্ত ইতিবাচক। তাঁর কারণে সারা বিশ্বেই সংবাদমাধ্যমের গ্রাহক বাড়ছে।’ আর ইউএসএ টুডের এক প্রতিবেদনে কলাম লেখক পল ব্র্যান্ডাস ট্রাম্পকে বিশ্বের ‘এক নম্বর বিক্রয় প্রতিনিধি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলছেন, ‘আর এই বছরের সেরা বিক্রয় প্রতিনিধির পুরস্কারটি যাচ্ছে...ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে।’
কাঠখোট্টা সংবাদমাধ্যমে রসের রসদ জোগানোর কাজটি এ বছর ভালোভাবেই করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিজের টুইটার পোস্টে যেকোনো কিছুতেই ‘ভুয়া সংবাদমাধ্যম’ শব্দজোড়টি জুড়ে দিয়ে তিনি সংবাদমুখী করেছেন মানুষকে। উদাহরণস্বরূপ বছরজুড়েই তাঁর তোপের মুখে থাকা নিউইয়র্ক টাইমস-এর গ্রাহকসংখ্যা বছরের মাঝামাঝিতেই ২ মিলিয়ন ছাড়িয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর গ্রাহকসংখ্যাও মিলিয়ন ছাড়িয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় বর্তমানে পত্রিকাটির গ্রাহকসংখ্যা তিন গুণ।
বছরজুড়েই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার গ্রাফের তত্ত্বতালাশ করেছে জনমত জরিপের মাধ্যমে। আর এর প্রতিটি প্রকাশের পরপরই ট্রাম্পের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে ‘ভুয়া সংবাদমাধ্যম’ কথাটি টুইটার মারফত। অবশ্য এর কারণও তিনি সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছেন। ট্রাম্পের মতে, ‘নির্বাচনের সময় সিএনএন, এবিসি, এনবিসির করা জরিপগুলোর মতো যেকোনো নেতিবাচক ফল আনা জরিপ ভুয়া।’
যতই টুইটার প্রেসিডেন্ট হিসেবে আখ্যা পান না কেন ডোনাল্ড ট্রাম্প মূলত একজন নিভৃতচারী প্রেসিডেন্ট। উদ্দেশ্যের বিপরীত অবস্থান নিয়েই তিনি সব সময় উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেন। সংবাদমাধ্যমের ব্যবসা চাঙার মতোই এই একই কাজ তিনি করেছেন নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে। প্রকাশ্যে নারীর প্রতি অবমাননাজনক বিভিন্ন বক্তব্য দিলেও তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত নারী আন্দোলনকে বেগবান করা। আর এই ছদ্ম উদ্দেশ্যে তিনি নিঃসন্দেহে সফল। কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পর থেকেই আমেরিকায় নারী আন্দোলন এক ব্যাপক মাত্রা পেয়েছে। তাঁর অভিষেকের প্রথম সপ্তাহেই বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মিছিল করেছেন নারী অধিকারকর্মীরা। শুধু আমেরিকায় নয়, বিশ্বের বহু দেশেই।
এমনকি বিশ্ব ঐক্য, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে ঐক্য স্থাপনের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান কম নয়। সর্বশেষ জেরুজালেম প্রশ্নে তাঁর অবস্থান মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে সারা বিশ্বকেই এক কাতারে নিয়ে এসেছে। জাতিসংঘ বহুদিনের মধ্যে প্রথমবারের মতো দ্রুততার সঙ্গে নিজের তৎপরতা প্রদর্শন করতে পেরেছে। অনেক ক্ষেত্রেই রূঢ় সত্যকে সামনে এনেছেন তিনি। এর মধ্যে মানুষের মধ্যে গোপনে বিরাজ করা ‘বর্ণবাদী’ মনের কথা উল্লেখযোগ্য। ট্রাম্পই এই বস্তুকে দীর্ঘ সুপ্তি থেকে জাগিয়ে সবার সামনে হাজির করেছেন, যা সচেতন মানুষকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে। ইউরোপ-আমেরিকায় ক্রমে বেড়ে ওঠা নয়া-নাৎসিবাদী ধারাটির সম্যক রূপও তিনিই উন্মোচন করেছেন।
এমনকি বৈশ্বিক বিভিন্ন ইস্যুতে পূর্বতন ঐক্যকে ট্রাম্প আরও সংহত করেছেন সুচারু পদক্ষেপের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রসঙ্গটি টানা যায়। ‘প্রচণ্ড ঠান্ডা, নিউইয়র্কে তুষারপাত হচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রয়োজন’, টুইটারে এমন বক্তব্য রাখা প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন, যা বাকি গোটা বিশ্বকে এই প্রশ্নে আরও সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছে। যথার্থ বিদূষকের মতোই নানা তামাশাপ্রবণ পদক্ষেপ ও বক্তব্য দিয়ে শুধু আমেরিকা নয়, পুরো বিশ্বকেই রূঢ় সত্যের মুখোমুখি করেছেন ট্রাম্প। শীতল হয়ে আসা সম্পর্কের গহিনে থাকা বিভাজন রেখাটি স্পষ্ট করেছেন। কোনো ক্ষেত্রে টেনেছেন নতুন বিভাজন রেখা, তাও বৃহত্তর স্বার্থেই নিশ্চয়! আমেরিকা ফার্স্ট স্লোগান তুলে আমেরিকাকেই ছাড়িয়ে নিচ্ছেন তিনি অন্যদের থেকে। তবে এই ছাড়িয়ে যাওয়াটার রাশ নিশ্চয় এখন টানতে চাইবেন এখন আমেরিকানরা। কারণ অস্থির ও জটিল পরিস্থিতিতে বিদূষকের উপস্থিতি স্বল্প সময়ের জন্যই ভালো। দীর্ঘসূত্রতায় এটি এমনকি বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। যেমনটা আঁচ পাওয়া যাচ্ছে উত্তর কোরিয়া প্রশ্নে।