রানু

কুমিল্লার ছোট্ট একটি শহরে রানুর জন্ম। চার ভাইবোন। অভাব অনটনের সংসারে সে বড়। একটা সংগঠনে নাটক করে। সপ্তাহে পাঁচ দিন সন্ধ্যা হলেই তাঁকে রিহার্সেলে যেতে হয়। কিন্তু প্রতিদিন ঘর থেকে বের হওয়ার মতো পর্যাপ্ত সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি কোনোটাই তাঁর নেই। একই জামা বা শাড়ি পরে যেতে তাঁর খারাপ লাগে, তবু যায়। মাঝে মধ্যে পাশের ঘরের ভাবির শাড়ি চেয়ে এনে নাটকের দিন পরে। তাও তিনি দেন খুব বিরক্ত হয়ে বা বলবেন যেন, নষ্ট না করে। রানু কিছু মনে করে না। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলে, ভাবি ধন্যবাদ। যত্ন করে রাখব। সে জানে হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, দুঃসময়ে অপমান গায়ে মাখতে নেই। সেও মাখে না। এও সে জানে এ দুঃসময় একদিন থাকবে না।
রানু ভাবে এবার শীতের মৌসুমে যখন বাইরের জেলায় নাটক করতে যাবে, তখন তাঁর আয় করা পয়সা দিয়ে কিছু শাড়ি ও কাপড় কিনে ফেলবে। স্যান্ডেলও কিনবে। তাঁর একটা হাই হিলের শখ। হিল দিয়ে শাড়ি পরলে খুব সুন্দর লাগে। কিন্তু তাঁকে পরতে হয় ছেঁড়া জুতা। এই যে গতকাল হঠাৎ করে একটা বেল্ট ছিঁড়ে গেল। সে কি পরে যাবে? অবশেষে ঝুনুর বাটার চপ্পল পায়ে দিয়ে গেল। কেউ যাতে না বোঝে তাই ইচ্ছে করে শাড়িটা একটু বেশি নামিয়ে পরল। রিহার্সেল রুমের এক কর্নারে গিয়ে একটা চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকে। নায়িকার ছোট বোনের চরিত্র তাঁর। নাটকের নায়িকা সাবেরি আপা খুব সুন্দর অভিনয় করেন। যদিও চেহারা তেমন কিছু না কিন্তু নাটকের মেকআপ নেওয়ার পর একেবারে বদলে যান। কাপড়ে পরেন সব কেতাদুরস্ত। রানু অপেক্ষায় আছে একদিন নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করবে।
নতুন হলেও সবাই তাঁর অভিনয়ের খুব প্রশংসা করছেন। তাঁর এখন অভিনয়ই ধ্যান জ্ঞান। যদিও ঘরে মা-বাবা এই নাটক করা নিয়ে সমানে লড়াই করে যাচ্ছেন। বাবার কথা সে মেট্রিক পরীক্ষাটা ভালো মতো দিক তারপর যা হয় হবে। মা বলছেন উল্টো কথা, সমস্যা কি একটা কিছু শিখে রাখা ভালো। তবে খুব সত্য কথা সে নাটকে গিয়েছে সংসারের অভাব দূর করতে। তাঁর মধ্যে এমন কোনো স্বপ্ন নেই যে সে অভিনেত্রী হবে বা কোনো মাধ্যমে যাবে। নাকি এ রকম কোনো ইচ্ছে তাঁর মধ্যে ছিল কখনো? রানুর মনে হয় ছোট বেলা সে প্রায়ই সিনেমার নায়িকা সাজতো মায়ের শাড়ি পরে। মায়ের সঙ্গে গিয়ে দেখা সিনেমার সব ডায়ালগ তাঁর মুখস্থ হয়ে যেতো। বড় হতে হতে কপি করতে থাকে ফ্যাশন। তাঁর চুল সুন্দর তাই ইচ্ছে মতো সে সুন্দর করে খোঁপা করে। মাঝে মাঝে দু’চারটা সাদা ফুলও লাগিয়ে দেয়। ক্লাস টেনে পড়লেও নাটক করার জন্য তাঁর চলনে বলনে একটা কলেজ পড়ুয়া বালিকার মতো বড় বড় ভাব চলে এসেছে।
ঘর থেকে বের হলেই পাড়ার ছেলেরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। তবে তাঁদের পাড়ার ছেলেরা অনেক ভদ্র, কেউ কোনো ধরনের খারাপ ব্যবহার বা ইভটিজিং করে না। কথা বলারও সাহস নেই। তাঁদের পাড়ায় সবচেয়ে সুন্দর রতন ভাই। ফরসা শরীরে একটা কালো শার্ট পরে প্রায় সময় পাড়ার দোকানে বসে থাকেন। ভাবখানা যেন বাংলা নাটকের নায়ক জাহিদ হাসান। সুযোগ বুঝে এটা-সেটা প্রশ্ন করেন। কিন্তু মুখে গম্ভীর ভাব ধরে রাখেন। ভালো ছেলেদের ভাব ধরে রাখাই ভালো।
এদিকে প্রতিবেশী সাত্তার চাচার ছেলে দুদিন দুটি চিঠি পাঠিয়েছে। সে বাগানে পানি দিচ্ছিল। তিনি একটা পাথরসহ কাগজ ছুড়ে মেরেছেন। তিনিও খুব সুন্দর কিন্তু নামটা কেমন বোকা বোকা। সে সেটা কোনো রকম লুকিয়ে জামার ভেতর রেখেছে। অল্পের জন্য ছোট বোন মণি দেখেনি। না হলে ঘরে গিয়ে রাষ্ট্র করে বলত, জানো কি হয়েছে, আবুল ভাই আপাকে একটা কাগজ দিয়েছে। এই সুযোগ তাঁর মেজো বোন কাজে লাগাত। তাঁর সম্মান রক্ষা হয়েছে। নতুবা মায়ের কাছে বাড়িয়ে আরও দশ কথা বলত। মা রাগলে একেবারে রুদ্ররূপ সাক্ষাৎ মূর্তি! স্কুল মাস্টার মা সব সময় কঠিন। সে বোঝে এই কঠিনতর স্বভাবের মূল কারণ অভাব। সে সেই অভাব দূর করতে চায়। সে ভাবনা আছে। এখন মিডিয়া মানে পয়সা। কিন্তু আদর্শবান বাপরে সে কীভাবে বোঝাবে। উনি বেকার হয়ে বসে আছেন। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে স্বপ্ন দেখছেন ছেলে মেয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে।
কেউ তাঁর মনের কথা বিশ্বাস করবে না। সে তেমন কিছু ভাবছে না। এ পাড়ার কাউকে তাঁর প্রেমিক সে ভাবতেই পারে না। জীবন তো সিনেমা না। সে কোনো রাজকুমার বিয়ে করবে। যার বাড়ি গাড়ি থাকবে। অন্তত অভাব থাকবে না। তাঁর অভাব ভালো লাগে না। খুব বেশি কিছু যে চায় তা না। ছোট একটা সংসার। ছোট্ট ছিমছাম একটা বাসা। সাজানো একটা ড্রয়িংরুম যেখানে কোনো মেহমান আসলে আনন্দ নিয়ে বসবে। সে খুশি নিয়ে কিছু ভালো নাশতা দেবে। চা দেবে। কিছু কাপ থাকবে মন্নু সিরামিকের। সাদা চায়ের পট। তাঁর তিনটা ছেলে মেয়ে থাকবে। যাদের আলাদা আলাদা পড়ার টেবিল থাকবে। সুন্দর কিছু ফ্রক মেয়েদের জন্য কিনবে। মনের মতো। যাহ! এ সব কি ভাবছে সে! তবে রানুর ভাবনাগুলো এমনই।
অন্যের ঘর থেকে চায়ের কাপ চেয়ে এনে চা দেওয়া যে কি লজ্জার! কেউ এলে কাঠের চেয়ারে বসাতে হয়। তাঁর খুব কষ্ট লাগে। তাঁর বন্ধুরা এলে সে মিথ্যে করে বলে আমাদের ড্রয়িংরুম তালা দেওয়া। আমার ছোট বোন সব নষ্ট করে ফেলে তাই। এই নিয়ে তাঁর মেজো বোন তাঁর সঙ্গে খুব ঝগড়া করে। সে কেন মিথ্যা বলে? ঝুনু তিনবার বলেছে ছি ছি ছি! মিথ্যে সে বলতে চায় না কিন্তু সম্মান বলে তো একটা জিনিস আছে। মা-বাবা গরিব বলে সে নিজেরে তো ছোট করতে পারে না। স্কুলের বান্ধবীর এমনিতেই বদনাম করতে থাকে কার বাসায় কম খাওয়ালো, কার বাসায় কি নেই! কিছু না থাকলেও সে নিজেকে ছোট করতে মোটেও রাজি না।
রানুর এই একটাই দোষ সে প্রচুর বানিয়ে বানিয়ে বলে। আসলে সে খুব কল্পনা বিলাসী। যা যা ভাবে তা কখন জানি বলে ফেলে। সে নিজেও বুঝতে পারে না।
কারও বাসায় গেলে তাঁকে যদি, বিস্কুট দিয়ে চা দেয় সে এসে বলবে। বোম্বের টোস্ট করে দিয়েছে, সেই সঙ্গে পুডিং। সে তো কারও খারাপ বলছে না। প্রশংসা করছে। এ সব মিথ্যায় কিছু হয় না। রানু নিজেও জানে না সে কেন এ সব বলে!
একদিন সে সংগঠনের নাটকে নায়িকার চরিত্রের জন্য তৈরি হলো। খুব রোমান্টিক নাটক। রোমান্টিক মানে খুব ধরা ছোঁয়া যে তা নয়। নায়কের মোটরসাইকেলে তাঁরা ঘুরে বেড়াত ভিক্টোরিয়া কলেজে ও পার্কের কিছু জায়গায়। শহর থেকে দূরে কোথাও চলে যেত গ্রামে। এ সবই শুধু সংলাপে। একটা গান, ‘না না দিসনে ধরা দিসনে আমায় ভালোবাসার ফন্দি’ এটায় অভিনয় করতে গিয়ে তাঁর গাল ব্যথা করত। গাল কেমন গোলাপি হয়ে যেত। পরিচালক রাতুল দা তো প্রশংসায় যেন অ্যাওয়ার্ড দিয়ে দেন। সত্যি সত্যি কী এক আবেগ খেলা করে সে নিজেও বুঝতে পারে না। নাটকের নায়ক যাদব কুমার! হিন্দু সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। তাঁর বাবা খুব বড় ব্যবসায়ী। সবে কলেজ পাস দিয়ে বের হয়েছেন।
যাদব খুব সুন্দর আবৃত্তি করে। বলেছে তাঁদের বাসায় একদিন হুট করে চলে আসবে। আজকাল সে যাদবের প্রতীক্ষায় থাকে। পাড়ায় মোটরসাইকেলের শব্দ হলেই তাঁর বুক কেঁপে ওঠে। অযথা দৌড়ে জানালার কাছে যায়। সে বুঝতে পারছে এটা ঠিক না। তাঁর সব এলোমেলো লাগে। সে মাকে বলে রেখেছে। মা বলেছেন আচ্ছা। তাঁর বাবাও এখন অনেক শান্ত হয়েছেন। সে গত শীতের মৌসুমে বেশ কয়েকটা জায়গায় নাটক করেছে। সব মিলিয়ে অনেকগুলো টাকা পেয়েছে। সামান্য কিছু শাড়ি জামা কিনে সে সবই মায়ের হাতে দিয়েছে। মা এক সেট চায়ের সরঞ্জাম কিনে এনেছেন। তাঁদের আয় বলতে প্রাথমিক স্কুল শিক্ষিকা মায়ের বেতন। ছাত্র পড়িয়ে কিছু বাড়তি আয় হয়।
আজকাল অনেকে তাঁকে ঢাকা গিয়ে টিভি নাটক করার পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু যাদব দাদা তাঁকে পুরো নিষেধ করে দিয়েছেন। সে এটা খুব মনে রেখে চলে। কিন্তু যাদবের সব কথা মনে রাখাই যেন তাঁকে আরও বেশি কষ্ট দেয়। যাদবকে সে মনে মনে যাদু বলে। অচেনা যাদু অচেনা এক কষ্ট! না মেলে অঙ্ক না মেলে সমীকরণ। কোথায় যেন ভাঙন হয়! আবার কোথাও আনন্দের খেলা! সে বুঝতে পারে না।