রানু কী করবে?

রানুর বাবা বিয়ের খবর দেওয়াতে তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। সে প্রায় অনেকক্ষণ আনমনা কাটাল। বাবার কাছ থেকে উঠে গিয়ে নিজের রুমে বালিশে মুখ গুঁজে কিছুক্ষণ কান্নাও করেছে। এই মুহূর্তে সে বিয়ে করতে চায় না। প্রেম ভালোবাসার জন্য নয়। সে এমনিতেই এখন কোনো ঝামেলায় যেতে চাইছে না। আবার এসএসসি পরীক্ষা দিতে চায়। এ সংসারে তার অনেক কাজ। সবেমাত্র একটু গুছিয়ে এনেছে। এখন ততটা অভাব হয়তো নেই, তবু সচ্ছলতাও আহামরি তেমন কিছু নয়। কিন্তু কীভাবে কী করবে বুঝতেও পারছে না। সে ভাবছে, মাকে বোঝাতে হবে। সে চলে গেলে তিনি একা সংসার কীভাবে চালাবেন? কিন্তু এটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। বাবা পানির মতো, আর মা আগুনের মতো। এতে তাঁদের কম্বিনেশনে সুবিধা হয়েছে। কিন্তু মাঝখানে তাদের ভিজতে হয়, পুড়তে হয়।

সে কিছুক্ষণ রবীন্দ্র সংগীত শুনল। তার মন একটু ফ্রেশ লাগছে। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। রান্না করতে হবে। মা তো ঘরে ঢুকেই আগে খাবার খোঁজেন। বাবা আগে মাঝেমধ্যে নিজেই রান্না করতেন। কিন্তু এখন সে আর ঝুনু মিলে করে। মা রাতের খাবার তৈরি করেন শুধু।

কী রান্না করবে? ভাবতে ভাবতে আরও পাঁচ-ছয় মিনিট গেল। ফ্রিজ থেকে সে সবজি বের করল। মাছ আগেই বের করে রেখেছিল। ভাবল একটু শুঁটকি ভর্তা করবে; মায়ের প্রিয় খাবার। মা মাছ মাংসের চেয়ে শুঁটকি, শাক এসব পছন্দ করেন। দেখা যাক সুবিধা বুঝে মাকে ফেরাতে পারে কি না। সে ভাত চুলায় দিয়ে মাছ ধুয়ে তুলেছে। এর মধ্যে তার বাবা এসে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—
-কী রে কী করিস?
-দুপুরের রান্না করি বাবা।
-এত মন খারাপ করিস কেন? দেখি কী করা যায়? তোর মা ঘরে আসুক। এখন খুশি থাক মা।
-আচ্ছা বাবা।

রানু ভাবে, বাবা কেন নিজেকে অক্ষম বলে ভাবেন? তিনি তো অনেক কিছুই সঠিকভাবে বুঝতে বেশি সক্ষম। কী অদ্ভুত এক মানুষ! জীবনে টাকা-পয়সা উপার্জনই কি সব? টাকা একটা অতি প্রয়োজনীয় জিনিস, তা সত্য। কেন যে অচল হয়ে গেলেন? বাবা সক্ষম-সবল থাকতে তাদের এত কষ্ট ছিল না। এখন তাঁর জীবন এ বাড়ির উঠান আর হাসপাতালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বহু দিন হয় কোথাও যান না। বাবার নিশ্চয় অনেক কষ্ট, যা কাউকে বলতে পারেন না। মা তো সদাই খিটমিটে। যদিও তাঁদের তেমন ঝগড়াঝাঁটি হয় না। তবে মা মাঝেমধ্যে কঠিন কথা বলে ফেলেন। বাড়িতে মাছওয়ালা এলে বাবা হয়তো বড় মাছ একটা বেশি নিয়ে নিলেন। তারাও পয়সা পরে দেবেন বলে রেখে যায়। মায়ের মাথায় তখন ধার-দেনার চিন্তায় বাজ পড়ে। এখন অবশ্য এসব দিক সে-ই সামাল দেয়।

-আরেক কাপ চা দিতে পারবি?
-হ্যাঁ, পারব। তবে চা পাতা নেই। আমি দোকান থেকে নিয়ে আসি। তুমি ভাতটা দেখ।
-আচ্ছা যা।
রানু ব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে পাড়ার দোকানে রওনা হলো।
বের হয়েই দেখা পেল বোকারাম আবুল ভাইয়ের। চোখাচোখি হতেই রানু চোখ ফিরিয়ে নিল। তিনি তবু একটু তোতলামি করে জিজ্ঞেস করলেন
-কে-কেমন আছ রানু? তো-তোমাকে তো আজকাল দেখা যায় না।
-জি, ভালো আছি। ব্যস্ত থাকি তাই।
-তুমি একেবারে ই-ইস্টা-র হয়ে গেছ।
-কী যে বলেন আবুল ভাই। আচ্ছা আসি।
-আমার চি-চিঠির জ-জবাব দিলে না?
-জবাব নাই। আর কখনো লিখলে চাচাকে বিচার দেব।
-তু-তুমি ল-লক্ষ্মী মেয়ে, দিতে পা-পারবে না।
রানু ফিক করে হেসে ফেলল। বেচারা!
-চাচা লিপটন চা পাতা দেন তো এক প্যাকেট।
-এই নাও মা। তা কালকে এত রাত করে ফিরলে? কোথায় গেছিলা মা?
-কাজ ছিল। একটু শক্ত হয়ে বলল, যাতে আর কোনো প্রশ্ন না করেন। বাকি পয়সাটা তাড়াতাড়ি দেন।
-এই নাও মা।

রানু ঘুরতেই দেখে পাট-বয় জাহিদ হাসান ওরফে রতন ভাই একদম তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। শরীর থেকে কোনো একটা পারফিউম বা আফটার শেভের তীব্র গন্ধ এসে নাকে লাগল।
-কেমন আছ রানু। তুমি তো একেবারে সেলিব্রেটি হয়ে গেছ।
-জি, ভালো আছি। কী যে বলেন? এত সহজ নাকি এসব হওয়া।
-আচ্ছা আসি। পরে কথা হবে।

মনে মনে শ্রাগ করল যে, পাড়ার ছেলেগুলোর জন্য ঘর থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। আড়চোখে দেখল রতন ভাই তার পথের দিকে চেয়ে আছেন। সে কী খুব বেশি সুন্দর? সবার নজর তার ওপর কেন?

চা খেয়ে, রানুর বাবাই তরকারি রান্না করে দিলেন। কীভাবে মাছটা কষাতে হবে, তা দেখিয়ে দিলেন। মাছটা তুলে তারপর সবজিটা দিতে হবে। সব শেষে ধনে পাতা আর কাঁচা মরিচ ছেড়ে দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। ভালোই হলো রান্নাবান্নায় সে এখনো ততটা দক্ষ না। তার চেয়ে রানু বেশি দক্ষ। শুঁটকি ভর্তা, আর ডাল রান্না করল। রান্নাঘর ও বাকি ঘরদোর পরিষ্কার করে গোসল সেরে এল। বাবা ভাত খাবেন কি না জিজ্ঞেস করে এল। সবাই এলে খাবেন। পাঁচটা বাজতে এখনো অনেক দেরি।

রানু কলম আর প্যাড নিয়ে বসল। জাদুকে একটা চিঠি লিখবে। কী লিখবে? ভেবেও কিছু ঠিক করতে পারছে না। এক-এক করে তিন-চারটা প্যাডের কাগজ নষ্ট করল। যদিও নিশ্চিত নয়, তবুও অবশেষে বিয়ের ব্যাপারটা জানাল। আগামীকাল রিহার্সাল আছে। চিঠিটা তার হাতে দিয়ে দেবে। তাদের যোগাযোগ চিঠিতেই বেশি। পরিচালক বশির ভাইয়ের কড়া নির্দেশ আড্ডাবাজি, অহেতুক কথা কাজের সময় না।

মা এবং ভাইবোন সবাই এসে গোসল করে খেতে বসল। সবার আগে বসেছে নিলয়। তার বেশি খিদে লেগেছে। চোখেমুখে দুনিয়ার দুষ্টুমি। স্কুলে কার কার সঙ্গে কী করেছে, তার ফিরিস্তি দিয়ে চলেছে। নিলয়ের মুখে ভাতের নোলা তুলে দিচ্ছেন বাবা। কী সুন্দর দৃশ্য! বাবার হাতের মাখানো ভাত খুব মজা। মন-মেজাজ ভালো থাকলে বাবা নিজের মাখানো ভাত তাদের মুখেও তুলে দেন। মাস্টারনি মায়ের আবার এসব দয়ামায়া নেই। তবে বাইরে থেকে অতি যত্নে সব জোগাড়যন্ত্র মা-ই করেন। এই সেদিনও বিশাল এক খাঁচা আম নিয়ে এসেছেন। এর মধ্যে সবাই এসে খাওয়া-দাওয়া শুরু করল। হালকা-পাতলা ঘরোয়া দু-চারটা কথা হলো। ‘শুঁটকি ভর্তা খুব মজা হয়েছে’, দুবার বললেন মা। মাকে বেশ খুশি লাগছে। সে যে কাল রাতে এত অঘটন ঘটিয়েছে, তার কোনো তিক্ততা নেই। একপর্যায়ে মা বলে উঠলেন, ‘রানু তুই কী আজ আবার রিহার্সালে যাবি?’ মাথা নিচু করে রানু জবাব দেয়, ‘না আজ নেই।’ ‘ঠিক আছে তোর সাথে কথা আছে। আমি সন্ধ্যায় বলব সব। এখন একটু রেস্ট নিই।’

সন্ধ্যায় চা খেতে মা রানু, ঝুনু দুজনকে ডাকলেন—
-আগামী শুক্রবার রানুকে দেখতে লোক আসবে। বরের পছন্দ হলে ওরা আংটি পরিয়ে যাবে। লন্ডন থেকে এসেছে।
-মা শুক্রবারে নাটক আছে আমি পারব না।
-ঠিক আছে। তাহলে বলে দেব শনিবার আসতে।
-আমি পরীক্ষা দেব মা। বিয়ে পরে ঠিক করো।
-তোমার কথামতো আমি চলতে পারব না। পরীক্ষা দেওয়া যাবে। বিয়ে করেই তো সঙ্গে সঙ্গে লন্ডন নিয়ে যাবে না।
মায়ের রুদ্রমূর্তির সামনে গলা দিয়ে আর কোনো কথা বের হয় না। তবু কষ্ট করে বলল, ‘তুমি একা সংসার চালাবে কীভাবে?’
-সেটা তোর ভাবনা না।
মায়ের এ কথার পর কথা বলা বেকার।
-আমি আবার বলতেছি তাড়াহুড়া করে কোনো অঘটন ঘটাইতে যাইও না।

পেছন থেকে রানুর বাবা কথাগুলো বলে উঠলেন।
-তোমার কথামতো চললে আমার চলবে না। ভালো জামাই সব সময় মেলে না। এটাই ফাইনাল। শনিবারে ছেলের বাড়ির লোক আসবে। তারপর দেখা যাক। মেয়ে তো তিনটাই তরতর করে বড় হচ্ছে। ভাবনা তো আমাকে করতে হবে। সব সময় বেশি বোঝাতে এসো না।
এই কথাগুলো নিজের কানে শোনার পর থেকে ঘরের বাতাস ভারী লাগতে শুরু হলো। নিজের রুমে গিয়ে মনের বিরুদ্ধে সে নাটকের স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু মুখস্থ করতে পারছে না। সব আরও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তার চোখ বারবার অন্য একটা চরিত্রের ডায়ালগে গিয়ে আটকে যাচ্ছে, আর চোখের সামনে যাদুর মুখ ভাসতে লাগল।

‘তুমি কে? আমি জানি না। কেনই-বা তোমার সাথে আমার যোগাযোগ হলো, তাও জানার জ্ঞান হয়নি আমার। আমার আত্মা বলছে, “তুই আমার কিছু হবিরে, তা- না হইলে তোর জন্য আমার পরান কেন এত কান্দে।। তোর সাথে কোন এক জনমের ভালোবাসা ছিল আমার।। তা না, হইলে তোর জন্য কেন পরান এত কান্দে।”’

তোর জন্য কেন প্রাণ কান্দে বিড়বিড় করতে করতে রানু ঘুমিয়ে পড়ল। রাত দশটার দিকে ঝুনু দুবার ডেকেছে খাওয়ার জন্য। সে ডাকতে না করেছে। শেষ রাতে তার ঘুম ভাঙল। চারদিকে আজানের শব্দ। মনে হচ্ছে শব্দেই তার ঘুম ভাঙল। কিন্তু অদ্ভুত রকম ভালো লাগা কাজ করছে। সাধারণত সে এ সময় ওঠে না। আজ উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে অজু করে নামাজ পড়ল। মন থেকে যত রকম আকুতি জানানো যায়, তা আল্লাহকে জানিয়ে নিজেকে একটু হালকা করে নিল। ছেলে পক্ষ যেন তাকে অপছন্দ করে এটাই ছিল তার একমাত্র চাওয়া। আল্লাহই শুধু তাকে রক্ষা করতে পারেন।

খুব অল্প বয়সে বিয়ে কোনো মেয়েরই কাম্য নয়। নাটকের বইগুলো পড়ে জীবন সম্পর্কে তার ধ্যানধারণা অনেক বদলে গেছে। সে সেটা কীভাবে মাকে বোঝাবে। যে মা ছাড়া জীবন অচল, সে মা-ই কখনো সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে যান। তার কি বিয়ে করা খুব জরুরি। মা বললে সে যাদুর সঙ্গে মেলামেশা কমিয়ে দিত। কিন্তু তিনি তাকে কোনো অপশনই দিচ্ছেন না। যেন বিয়েই একমাত্র সমাধান। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছা হয় কোথাও পালিয়ে যেতে। তা কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে? এ রকম তো কেউ নেই। দেখা যাক বিকেলে যাদুর সঙ্গে কথা বলে কোনো বুদ্ধি পাওয়া যায় কি না?