
নবাবপুর পার হয়ে বাহাদুর শাহ্ পার্ক পেরিয়ে বাংলাবাজার। সেখান থেকে একটু এগিয়ে বাঁয়ে মোড় নিলে প্যারিদাস রোড। এই রোডের পাশেই শ্রীশদাস লেন। আর এই লেনের ১ নম্বর বাড়িটিই বিউটি বোর্ডিং। হলুদ বর্ণের পুরোনো একটি দোতলা বাড়ি। দেশভাগের পর বাংলাবাজার হয়ে ওঠে প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু। তখন থেকেই বিউটি বোর্ডিং শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে।
চল্লিশের দশকে কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকসহ অনেক বিখ্যাত মানুষ এখানে আসতেন আড্ডা দিতে। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, ফজলে লোহানী ছিলেন বিউটি বোর্ডিংয়ের নিয়মিত মুখ। আসতেন কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। সত্য সাহা, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কলাম লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী, ভাস্কর নিতুন কুণ্ডু, কবি আল মাহমুদ প্রমুখ মেতে উঠতেন আড্ডায়। আর থাকতেন শহীদ কাদরী, যার কবিতার ভাষা, ভঙ্গি ও বৈশিষ্ট্য হিসেবে উঠে এসেছিল দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্ববোধ, প্রকৃতি ও নগর জীবনের অভিব্যক্তি। আমাদের বাংলা কবিতায় নাগরিকতা ও আধুনিকতাবোধের সূচনাকারী এই কবির উচ্ছল উপস্থিতি মাতিয়ে রাখত বিউটি বোর্ডিং।
একদিন বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডায় যোগ দিতে শহীদ কাদরী যখন প্রস্তুত, তখনি নামল ঝুম বৃষ্টি। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরও যখন বৃষ্টি কিছুতেই থামছিল না, তখন কবি কাপড় বদলে খাতা-কলম টেনে বসলেন জানালার পাশে। আড্ডায় যেতে না পারার হতাশা থেকেই জন্ম নিল ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’ কবিতাটি। এ বর্ষা কালিদাস বা রবীন্দ্রনাথের বর্ষা নয়। এ এক নতুন বর্ষার প্রকৃতি, যা অগ্রজদের থমকে দেয়, যা বাংলা সাহিত্য অঙ্গনকে চমকে দেয়। এখানে কবি বৃষ্টিকে সন্ত্রাস বলেছেন। এখানে মানুষের একাকিত্ব আছে, বিলাপ আছে, সেই সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী প্লাবনে ভেসে যাওয়া সভ্যতার উদ্দাম, অনিশ্চিত যাত্রার কথাও আছে। এখানে কবি অঝোর বর্ষণে নিমজ্জিত আত্মার আবেগ ও যন্ত্রণার কথা বলেছেন। এমন তেজ, এমন বিপ্লব শহুরে বৃষ্টিতে এর আগে বা পরে আর কেউ দেখেনি। একটি সাধারণ মুহূর্তে হুট করে খাতা কলম টেনে এমন অসাধারণ কবিতার জন্ম দিলেন শহীদ কাদরী।
কবিতার বই বের করা যার উদ্দেশ্য ছিল না, যিনি কখনো নিজ কবিতায় সময়কাল লিপিবদ্ধ করেননি, যার কাব্যগ্রন্থ ও কবিতা ছাপা হতো বন্ধুদের জোরাজোরিতে, যার কাছে জনপ্রিয়তা ছিল একটি ফালতু বিষয়; তিনিই শহীদ কাদরী। এই বিরলপ্রজ কবি তাঁর জীবদ্দশায় মাত্র চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একজন লেখকের প্রধান কথাগুলো বলে ফেলবার জন্য ৫০-৬০টি গ্রন্থের প্রয়োজন হয় না। তাঁর রচনায় বলার ভঙ্গি, উপমা, শব্দাবলি, ভাব সম্প্রসারণে বাক্যের ব্যবহার আমাদের চমকিত করে। একটি কবিতা বারবার পড়েও মনে হয় কী যেন থেকে গেল অধরা! বিশ্লেষণ করার শব্দ খুঁজতে হয় দীর্ঘ সময় ধরে।
আমার দুর্ভাগ্য যে, একই শহরে বাস করেও এমন একজন কবির আশীর্বাদ নেওয়া হয়নি কখনো। খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখা হয়নি কখনো। আজ যখন মিসেস কাদরী, আমার শ্রদ্ধেয় নীরা আপুর মুখে স্যারের কবিতার পঙ্ক্তি ও ব্যাখ্যা শুনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকি। মনে হয় কত অজ্ঞ আমি! কত কী জানার আছে, কত কী বোঝার বাকি!
এমন কবিরা কখনো হারিয়ে যায় না। তাঁরা চলে গিয়েও যুগ যুগ বেঁচে থাকেন মানুষের হৃদয়ে। প্রজন্ম তাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। শহীদ কাদরীকে নিয়ে এমন অজস্র লিখে যাওয়া যাবে। আশ মিটবে না। বরং পাঠকদের জন্য তাঁর ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’ কবিতাটি এখানে তুলে ধরে আমার বিদায় নেওয়াই ভালো—