পেছনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে যেসব ছবি স্পষ্ট অনুভবে আমাকে আন্দোলিত করছে, একটির পর একটি মুখ, একেকটি ছবি ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে, যেভাবে মেঘ ফুঁড়ে চাঁদ উঠে—সেই ছবিগুলো আমার শৈশবের ছায়াঢাকা ঘুঘু ডাকা গ্রাম যার নাম ছোট দেশ গ্রাম। গ্রাম বলতে শুধু গ্রামীণ পরিবেশ প্রকৃতি নয়, সে সঙ্গে বড় উপাদান মানুষ। সমাজ, মানুষে মানুষে সম্পর্ক-অসম্পর্ক, ঝগড়া-বিবাদ, চেনা-অচেনা দ্বন্দ্ব, শিক্ষা ও একটি জীবন্ত সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় চলমান জীবনস্রোত। পঞ্চাশের দশকের, আমার শৈশব মানেই দুরন্তপনা দস্যিপনায় গ্রামীণ প্রকৃতিকে আলিঙ্গন। দায়িত্বহীন, চিন্তাহীন, ছোটাছুটি, হইচই, নৌকা বাইস, গাছ বাওয়া, সাঁতার, বৃষ্টিতে ভেজা, দল বেঁধে পাঠশালায় যাওয়া, সন্ধ্যায় হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসা আর মায়ের বকুনি।
আমার জন্ম সিলেট শহরের হাসপাতালে, কিন্তু আমার বেড়ে ওঠা বা বেড়ে ওঠা সময়ের উদ্দাম পৃথিবী ছিল ছোট দেশ নামক গ্রাম। যে গ্রামকে নিয়ে আগেও গর্ব করতাম, এখনো করি। কৃষিনির্ভর আমাদের গ্রামে কোন ভিক্ষুক ছিল না, ছিল না কোন মামলা-মোকদ্দমা। ছোটখাটো ঝগড়া-ঝাটি গ্রামের মুরব্বিরা বসে মীমাংসা করে দিতেন। শতভাগ মুসলিম সে গ্রামের মানুষ ছিল পরস্পরের খুব আপন।
দাদা-দাদি, চাচা, ফুফুহীন আমার আব্বার একক মালিকানার বিরাট বাড়ি। তিনটি উঠান নিয়ে তিন দিকে লম্বা লম্বা টিনের ঘর। পুকুর, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, কবুতর, ফল-ফলাদি ও নানা বৃক্ষ শোভিত ধুলাবালি আর ফসলের ঘ্রাণ ঘেরা এক বর্ণিল শৈশব আমার।
আমার বাবার পরম নির্ভরতা ও ভালোবাসার গ্রাম ছোট দেশ। যে গ্রামের মাটির বিছানায় চিরনিদ্রা যাপন করবেন বলে আমেরিকার মতো দেশের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, মায়া তিনি ত্যাগ করেছিলেন। যে গ্রামের নিসর্গ প্রকৃতি ও সরল, সৎ মানুষকে তিনি গভীর ভালোবাসতেন। গ্রামের মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে আমার বাবা-মা সারা জীবন সচেষ্ট ছিলেন।
একটা জীবনের ভেতর অনেক জীবন ধারণ করে করে পথ চলছি। আমার স্মৃতিশক্তি খুবই নিম্নমানের, কিন্তু বাল্যকালের স্মৃতি যেন সোনার হরফে বাঁধাই করা। শৈশবের অনেক স্মরণীয় স্মৃতির গায়ে ধুলো জমেছে, হৃদয়ের তলায় থাকা স্মৃতিগুলো অপেক্ষায় ছিল ঝড়ের দিনের আম কুড়ানোর মতো উদ্ধারের।
আমরা এমনি সৌভাগ্যবান প্রজন্ম, যারা কুপি বাতির নরম আলোয় অবলোকন করেছি, সমবেত হয়ে কলেরগান শুনেছি যেমন, তেমনি আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধাও ভোগ করছি। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার সাক্ষীও হয়ে আছি।
দেশে গেলে আমার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি ঘেরা বাড়িতে যখন যাই, আমার মনে হয়, বাবা-মা, ভাইবোনহীন বাড়ি যেন সেই বাড়ি নয়, বিষণ্ন মলিন এক বাড়ির কঙ্কাল। আশ্রিত একটি পরিবার বাড়িতে বাস করলেও বাড়ির শেকড় মানুষগুলো ছাড়া বাড়িটি অনুজ্জ্বল। কালেভদ্রে বাড়ির মানুষগুলো বাড়ি ফিরলে বাড়িটা আবার বাড়ি হয়ে উঠে।
ছোট দেশ, কোনাগ্রাম, ফেনগ্রাম ও বাঘন গ্রামের মধ্য একটাই ছিল বিদ্যালয় এবং তা আমাদের গ্রাম ছোট দেশে। ছোট দেশ সরকারি প্রাইমারি স্কুল নামের এল আকৃতির টিনের চালের পাকা লম্বা ঘর ছিল স্কুলের। একপাশে জেলা বোর্ডের রাস্তা ও মসজিদ আর সামনে বিস্তৃত খোলা মাঠ ও পুকুর। তখন আমাদের স্কুল নিয়ে কত রচনা লিখেছি, আজ তা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসছে। আর সেসব রচনা লিখতে লিখতে আমি কখন অজান্তে লেখার জগতে ঢুকে পড়েছি।
সেই স্কুলে ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সাল অবধি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমরা তিন গ্রামের ছেলেমেয়েরা মিলেমিশে পড়াশোনা করেছি, খেলাধুলা করেছি, ঝগড়া করেছি, বন্ধুত্ব করেছি। এক গ্রামের ছেলেমেয়েরা অন্য গ্রামের ছেলেমেয়েদের সুখ–দুঃখের সাথি হয়েছি। তিন গ্রামের শিশুদের জন্য একটা মাত্র স্কুল। তাই শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রচুর। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। পাঁচজন শিক্ষক আমাদের পড়াতেন, তার মধ্য একজন ছিলেন নারী। তাঁর নাম ছিল মালতি বালা দাস। তাঁকে আমরা ‘মাসি’ ডাকতাম। তাঁর শিক্ষকতার পুরো সময়টা তিনি আমাদের স্কুলে কাটিয়েছেন।
সে কালে শিক্ষকেরা ছিলেন সমাজের সবচেয়ে শ্রদ্ধাভাজন ও গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদার অধিকারী। শিক্ষকেরা ক্লাসে ঢুকতেন হাতে লম্বা বেত নিয়ে। সেকালে স্যারদের হাতে মার খাওয়া শিশু অধিকার সনদের লঙ্ঘন বলে গণ্য হতো না। চতুর্থ শ্রেণিতে পাঠকালে আমাদের স্কুলে হেড স্যার হয়ে আসলেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আবদুল ওয়াহাব স্যার। স্যার আমাদের বাড়িতে লজিং থাকতেন। ক্লাসের পরও স্যার তাঁর প্রিয় ছাত্রদের আমাদের বাড়িতে বিনা বেতনে পড়াতেন, স্যারের অক্লান্ত চেষ্টায় প্রথমবার আমাদের স্কুলের দুই প্রিয় ছাত্র জালাল ও খলিল বৃত্তি পেলেন। আমাদের ব্যাচে চারজন ছিলাম স্যারের প্রিয়। আসাদ, কপিল, মহব্বত ও আমি। অক্লান্ত পরিশ্রমে স্যার আমাদের চারজনকেই শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। স্কুলের পর রাতে আমাদের বাড়িতে চারজনকে স্যার পড়াতেন। স্যার কখনো আমাদের বা তাঁর কোন ছাত্রকে বেত দিয়ে আঘাত করতেন না। প্রচণ্ড রেগে গেলে ‘বেহায়াতুল লাজিনা মিনাল কমবক্ত’ বলে ভর্ৎসনা করতেন। এই বাক্যটি শোনার পর লজ্জায় আমার ইচ্ছা হতো মাটি দুভাগ হোক আর আমি মাটির ভেতরে ঢুকে পড়ি।
আমাদের চারজনের মধ্য কপিল ছিল অঙ্কে সেরা, মহব্বত ও আমি সব বিষয়ে মোটামুটি কিন্তু আসাদের ছিল সব বিষয়েই ঈর্ষা করার মতো মেধা। যে কারও কণ্ঠস্বর একবার শুনলেই সে তা নকল করতে পারত। কিন্তু আমাদের বাকি তিনজনের মতো তার পরিবার তার স্কুলে লেখাপড়ার দিকে আগ্রহী ছিল না। কৃষিজীবী বাবাকে কৃষি কাজে তাকে সাহায্য করতে হতো। আসাদ ছিল প্রচণ্ড শ্রুতিধর। একবার যা শুনতো, তা তার মনের মধ্যে গেঁথে যেত। শিল্পী আবদুল আলিমের কণ্ঠ নকল করে গান গাইতে পারত। গজল, কিরাত এমনকি তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খাঁর ভাষণও হুবহু নকল করে সবাইকে শোনাত।
পাঠশালার পর আমাদের সবার জীবনপথ ভিন্ন ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়ে গেল। আমেরিকা আসার পর থেকেই আমার খোঁজখবর করা, আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণসহ, আনা–নেওয়া, ফোনে খোঁজখবর রাখা কপিল নিয়মিত করে যাচ্ছে। বাকি দুজনের খবরাখবর ও কপিলের মাধ্যমেই পাই। ইদানীং ফেসবুকের কল্যাণে মহব্বতের সঙ্গেও একটা যোগাযোগের সেতু তৈরি হয়েছে।
আসাদ এখন দেশের প্রথিতযশা একজন আলেম। মহব্বত বাংলাদেশের জজকোর্টের নামকরা আইনজীবী। কপিল দীর্ঘকাল থেকে আমেরিকাপ্রবাসী প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও কমিউনিটি লিডার, আর আমি বর্তমানে নিউইয়র্কবাসী এক মিটিমিটি জোনাকি। শিশুকালের সহপাঠী ও সমবয়সী হলেও এরা কোনো দিন আমাকে নাম ধরে ডাকেনি। আমি আসাদ ও কপিলের ফুফু আর মহব্বতের খালা। চারজনের দলের একমাত্র মেয়েকে তারা লেখাপড়া, খেলা ও ঝগড়াঝাটিতে সহযোগী রাখত। ছেলেমেয়েদের তফাৎ আমরা কক্ষনো বুঝি নাই।
মহব্বতের ভাইবোনেরা সবাই আমেরিকাবাসী, সেও আমেরিকার গ্রিনকার্ডধারী। গত তিন বছর ধরে শুনি, সে ঝটিকা সফরে আসা–যাওয়া করে। ফেসবুকে দেখলাম মার্চের ১ তারিখে মহব্বত নিউইয়র্কে এসে পৌঁছেছে। ২ তারিখ সকালে কপিলের ফোন, ফুফু ঘরে আছ? মহব্বত এসেছে, তাকে নিয়ে আজ তোমাকে দেখতে আসব।
২ মার্চ দুপুর আড়াইটায় মহব্বতকে নিয়ে কপিল আমার ঘরে আসলে, দীর্ঘ ৫০ বছর পর মহব্বতের সঙ্গে আমার দেখা হল। শৈশব, কৈশোরের দুরন্ত ঘ্রাণ নিয়ে পুরো বাল্যকাল, জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ল আমার ঘরে। আমাদের স্মৃতির সিন্ধুক খুলে আমাদের কথার সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের সোনালি শৈশব, বাবা, মা, পাড়া, প্রতিবেশী সহপাঠীসহ আমাদের শান্ত ভালোবাসার গ্রাম। ওরা চলে যাওয়ার পরও আমি খেলার মার্বেলের মতো একটার পর একটা রঙিন মার্বেল কুড়াতেই থাকলাম।