এক.
প্রায় পাঁচ শ বছর আগে কিংবা তারও আগে, সমুদ্রের বুকে পাল তোলা জাহাজ নিয়ে রওনা দিয়েছিল এক নাবিক অজানা পথে, হিরে-মানিক-রত্নের সন্ধানে। বুক ভরা আশা তার। জয় করবে নতুন ভূখণ্ড, দেশে ফিরবে বিপুল সম্পদ নিয়ে। ঘরে তার তরুণী বধূ। সদ্য বিবাহিত তরুণীর প্রচণ্ড ভালোবাসা আছড়ে পরে নাবিকের বুকে সমুদ্রের প্রকাণ্ড ঢেউয়ের শব্দ ছাপিয়ে। আকাশের সাদা মেঘের ভেলায় সে দেখে তার তরুণী বধূর প্রতীক্ষারত আকুল মুখখানি। জাহাজে ভেসে ভেসে তার অন্তরে জন্ম নেয় না–বলতে পারা গল্প রাশি, ঝোড়ো হাওয়ার গল্প, দ্বীপবাসীর গল্প, জল দস্যুদের গল্প—আরও কত গল্প। নাবিকের সেই গল্প আর বলা হয় না তার ভালোবাসার মানুষটির কাছে। নাবিক আর ফিরে আসে না। তার পরনের বস্ত্র, কোমরের তলোয়ার-ছুরি নিয়ে ফিরে আসে তার সফর সঙ্গীরা। তারা ফিরে আসে এক যুগ পার করে। যৌবনের পরিপুষ্ট সময় পার করা নাবিকের বউ তাদের মুখে শুনে নাবিকের গল্প, তার অসীম সাহসিকতার গল্প, ভরা জ্যোৎস্নায় চাঁদের দিকে তাকিয়ে তার বউয়ের স্মৃতি রোমন্থন করার গল্প। নাবিকের ঔরসে জন্ম নেওয়া ছেলেকে জড়িয়ে ধরে নাবিকের বউ নিভৃতে কাঁদে। তৈল চিত্রে আঁকা ঝোড়ো সমুদ্রের বুক চিরে আঁধার রাতে চলমান জাহাজের দিকে তাকিয়ে সে কল্পনায় দেখে তার স্বামীকে, খুঁজে বেড়ায় সফর সঙ্গীদের বলা গল্পের বাস্তবতাকে। নাবিকের কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে তার বউ তাকে উপলব্ধি করে। তাকে ফিরে পায় আত্মার বাঁধনে। তার শৌর্যের গৌরব টের পায় তার তলোয়ারের শাণিত ধারে। তার কিছুদিন পরে, নাবিকের বউয়ের জমাট বাঁধা কষ্ট যখন আর চোখের পানি হয়ে গলে বের হয় না, তখন সে তার ছেলেকে শোনায় তার বীরপুরুষ বাবার গল্প। ভুল কিছু না। একেবারে অবিকল ঘটে যাওয়া ঘটনাপুঞ্জ। সফর সঙ্গীদের কাছে শোনা আর কল্পনায় দেখা হুবহু বাস্তবতার মিশেলে এক সত্যি কাহিনি। ছেলে বেড়ে উঠে বাবার সাহসিকতাকে বুকে ধারণ করে, লালন করে। যৌবনে পা দেওয়া ছেলেকে দেখে নাবিকের বউ ভুলে যায় স্বামীকে না–পাওয়ার বেদনা। সে দেখতে পায় তার স্বামীর দেহের গড়ন, মুখের অবয়ব। এভাবেই সেই নাবিক আর সত্যিকারভাবে হারিয়ে যায় না, হারিয়ে যায় না তার না–বলা গল্পগুলো।
দুই.
পাঁচ বছর অতিক্রম করল রাশেদের প্রবাস জীবন। যুগের হিসেবে ছোট, কিন্তু বছরের হিসেবে দীর্ঘ এই প্রবাসজীবনে সে বড্ড হাঁপিয়ে উঠেছে। একদিন সে তার এই হতাশার কথা বাবা-মাকে জানায়। শুনে মা-বাবার আক্কেলগুড়ুম। বলে কী ছেলে, এই অল্প সময়ে এত অধৈর্য হয়ে পড়েছে ? নিশ্চয় বউয়ের পরামর্শে এমন করছে। বাবা-মা অভিমান করে বলে—
-তোমাকে আমাদের জন্য কিছু করতে হবে না, কিন্তু তুমি দেশে এসো না। এখানে এসে তুমি কিছু করতে পারবে না।
রাশেদের স্ত্রী ফারজানা বাবার বাড়ি থাকে। শ্বশুর বাড়িতে তার কোন স্বাধীনতা থাকে না। এখানে তার চার বছরের ছেলেকে মায়ের কাছে রেখে সে একটু নিজের মতো চলতে পারে। অবসর সময়ে টিভি সিরিয়াল দেখা, ফেসবুকে বসা, বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলা, রাশেদের সঙ্গে নিয়ম করে স্কাইপে বসা, আর সময় পেলে বাইরে বেড়ানো। রাশেদকে সে পরিষ্কার বলে দিয়েছে–—
-আমার জন্য তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তোমার যেখানে ভালো লাগে তুমি সেখানে থাকো। শুধু তোমার ছেলের খরচ পাঠিও।
ফারজানা তার স্বামীকে বোঝাতে চায়, সে তার স্বামীর জন্য কোন বোঝা না। রাশেদ তার স্ত্রীকে বোঝাতে ব্যর্থ হয় তার প্রবাস জীবনের যন্ত্রণা। প্রতিদিন প্রায় ১০ ঘণ্টার মতো অফিস ডিউটি। নিজের রান্না-বান্নাসহ অন্যান্য কাজ সামাল দেওয়ার পর সে একা। মাঝে মাঝে শুধু বন্ধের দিন দুই-চারজন বাঙালি প্রবাসী বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার ছবি ফেসবুকে দেখে সবাই ভাবে কত ভালো সময় রাশেদ কাটাচ্ছে। প্রতিদিন স্কাইপে বসে স্ত্রীর কাছে একই কথা শুনতে শুনতে আর বলতে বলতে সে ক্লান্ত। অথচ কলেজে পড়ার সময় নাবিলাকে সে কত রোমান্টিক কথা শোনাত। নির্ঘুম রাত কাটাত ফোনে কথা বলে। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই তার সঙ্গে নাবিলার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যখন সে জানতে পারে রাশেদ অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছে। রাশেদ বড় শূন্যতায় ভোগে এই ভেবে—একজন মেয়েও সে আজও খুঁজে পেল না, যাকে সে তীব্রভাবে অনুভব করে।
দেশে থাকার সময় ফেসবুকে তার এক বন্ধুর ফ্রেন্ডলিস্টে ফারজানার ছবি দেখে সে তার প্রতি আগ্রহী হয়। ফেসবুকে কথা বলতে বলতে তারা একে অন্যের প্রতি আবিষ্ট হয়ে পড়ে। রাশেদ ফারজানাকে বিয়ে করতে চায়। ফারজানার পরিবার রাজি হয়। বিয়ের ছয় মাসের মধ্যে রাশেদ বিদেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু, স্ত্রীকে আনতে ব্যর্থ হয়। রাশেদ একটা জিনিস আজও বুঝে উঠতে পারে না, সে কি সত্যি ফারজানাকে ভালোবেসেছিল? নাকি, ফারজানার একটা সেলফি দেখে ক্ষণিকের ভালো লাগা তৈরি হয়েছিল? সে খুঁজে বেড়ায় এমন কোন ছোট বা বড় ঘটনা, যেটা মনে করলে ফারজানার প্রতি তার তীব্র ভালোবাসা জেগে উঠে। কিন্তু, সে খুঁজে পায় না। এমন সব উত্তরবিহীন প্রশ্নমালা নিয়ে ভাবতে ভাবতে যখন সে বিক্ষিপ্ত, তখন হঠাৎ একদিন সে দেখে ফারজানার ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিস্টে তার আগের প্রেমিক খালেদের ছবি, যার কথা ফারজানা আগেই রাশেদকে বলেছিল। রাশেদ আরও অস্থির হয়ে পড়ে, তার অবর্তমানে ফারজানা আবার তার পুরোনো প্রেমিকের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ল না তো?
প্রজ্ঞাবান কবি হিসেবে খালেদ এখন কবি মহলে বেশ পরিচিত। বিভিন্ন টেলিভিশন টক শোতে তার সরব উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। অথচ এই তো সেদিনের কথা। কলেজজীবন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত সে মেয়েদের কবিতার ছন্দে এসএমএস করত বলে বন্ধুরা তাকে নিয়ে কত ব্যঙ্গ করত। কিন্তু খালেদ তাতে দমেনি। কারণ, যেই মেয়ে বন্ধুদেরকে সে এসএমএস করত, তারা তাকে পুরোপুরি উৎসাহ দিয়ে গিয়েছে। প্রতিদানে খালেদ তাদের প্রতি উদার ভালোবাসা ব্যক্ত করেছে কবিতার ফুলঝুরি দিয়ে। অবশ্য খালেদ এখন কিছুটা বোঝে, মেয়েগুলো তাকে পছন্দ করত। কারণ দেশকে খালেদ অপরূপা, সুনয়না, সুকণ্ঠী, সুমনা ইত্যাদি সম্বোধন করে কবিতা লিখত বলে। খালেদের কবিতায় তারা তাদের প্রশংসা শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে খালেদকে খুব কাছের বন্ধু মনে করত। কিন্তু, তারা খালেদকে কখনো ভালোবাসেনি।
খালেদ একমাত্র সত্যিকারের ভালোবাসা খুঁজে পায় ফারজানার ভেতরে। এমনও হয়েছে, খালেদের কবিতা মোবাইলের ভাইবারে পড়ে ফারজানা এক দৌড়ে ছুটে এসে খালেদকে জড়িয়ে ধরেছে। খালেদ-ফারজানার প্রেমের পরিণতি বিয়ে পর্যন্ত আর গড়াল না। বাঁধ সাধল ফারজানার বাবা-মা। তারা মেয়েকে বোঝাতে সক্ষম হয়, এই ছেলের কোন ভবিষ্যৎ নেই। তা ছাড়া তত দিনে একই প্রেমের কবিতার ভ্যানভ্যানানি শুনতে শুনতে ফারজানারও কেমন জানি খালেদের প্রতি একটা একঘেয়েমি চলে আসছে।
আজ খালেদ কিছুটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে তার কর্মসম্ভার তুলে ধরছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ইন্টারনেটে খালেদ নাম দিয়ে অনুসন্ধান করলেই বেরিয়ে আসে খালেদের কর্মযজ্ঞ। ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার সব জায়গায় খালেদ পোস্ট দেয় তার কবিতা, কবিতার বইয়ের লিংক, তার কবিতার আবৃত্তি, টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকার, আরও কত কি! সে তার পুরোনো বন্ধু ও ছেড়ে যাওয়া বান্ধবীদের বুঝিয়ে দিতে চায়, আজ সে কোথায়, আর তারা কোথায়। সে মনে মনে ভাবে, ফারজানা বোধহয় তাকে ঠিকই অনুসরণ করছে। দুই একটা কবিতা সে এখনো ফারজানার উদ্দেশ্যে লিখে। আশা করতে থাকে ফেসবুকে ওই কবিতাগুলো যখন পড়বে, তখন সে আর ঠিক থাকতে পারবে না। হয় নিজের অজান্তেই ওই কবিতাগুলোতে লাইক দেবে বা খলেদকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে নিজেই বিস্তারিত প্রশংসার কথা জানাবে। কিন্তু, ফারজানার কাছ থেকে এমন কিছু সে দেখতে না পেয়ে নিজেই একদিন ফারজানাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিল। সে ভাবল, অতীতে তাকে অবজ্ঞা করার কারণে ফারজানা আজ নিজেকেই হেয় মনে করছে। তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে সে লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু সে তো কবি! তাকে উদার হতেই হবে। একজন নারী মা-বাবার প্ররোচনায় ভুল করেছে। নিশ্চয় তাকে ক্ষমা করা উচিত। তা ছাড়া ফারজানা হয়তো এখনো তাকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। চোখ বন্ধ করলে এখনো হয়তো সে তাকেই দেখতে পায়।
খালেদের পাঠানো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ফারজানা গ্রহণ করে। কিন্তু, ফারজানা তাকে কখনো কোন আলাপে আহ্বান জানায় না। খালেদ ভাবে, ফারজানা হয়তো কোনোভাবেই লজ্জার খোলস থেকে বের হতে পারছে না। সে একটা দীর্ঘ কবিতা লিখে ফেলল ফারজানাকে নিয়ে। ফেসবুকে সেটা পোস্ট দিল ফারজানাকে সংযুক্তি করে। ভাবল, এবার ফারজানা ঠিকই বুঝবে। তার অতীত ভুলের জন্য আড়ষ্ট থাকার প্রয়োজন নেই। সে যত বড়ই হোক, ফারজানা আজীবন তার কাছে ফারজানা হয়েই বেঁচে থাকবে। কিন্তু, তাতে হিতে বিপরীত হল। হঠাৎ ফারজানা তাকে ম্যাসেজ বক্সে এসে কড়া নাড়ল। জানাল—
-এসব কি লিখছেন আপনি?
-মানে?
-মানে বোঝেন না? আপনি আমাকে বিরক্ত করছেন কেন? আপনি কি ভাবেন? আপনাকে এখনো আমি মনে ধরে রেখেছি?
-মনে রাখার মতো কিছুই কি নেই আমাদের ভেতর?
- হ্যাঁ আছে। কিন্তু সেটা এমন কোন বিষয় না। ছোটবেলায় পা পিছলে পেয়ারা গাছ থেকে পড়ে পা ভেঙেছিল। সেটাও আমার মনে আছে। কিন্তু, সেটা আমার জীবনের বড় কোন ঘটনা না। আপনি দয়া করে আমাকে আর ফলো করবেন না। আমি আপনাকে ব্লক করে দিচ্ছি। এরপরও যদি আপনি আমাকে অনুসরণ করেন, তাহলে আমি আপনাকে অপমান করব।
খালেদ অসাড় হয়ে পড়ে। আচমকা সে তার শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলে। কিছুটা সংবিৎ ফিরে পেলে সে প্রচণ্ড ক্ষোভে টেবিলের ওপর রাখা তার নিজের লেখা কবিতার পাণ্ডুলিপিগুলো ছুড়ে ফেলে। আবার সেগুলো কুড়িয়ে পাতা উল্টোতে থাকে। একের পর এক পাতা উল্টিয়ে সে খুঁজে বেড়ায় তার ভালোবাসার মানুষকে। কিন্তু, সে কাউকে খুঁজে পায় না।