গ্রীষ্মের এ সময়টাতে নন্দিনীর জোন্স বিচটাকে মনে হয় বাংলাদেশের মধুমতি নদী। নিউইয়র্ক সিটির কিছুটা বাইরে। আটলান্টিক মহাসাগরমুখী জ্যাকস বে’তে মিলে যাওয়া এই সমুদ্র সিকটি নন্দিনীর বড় আপন। তাই মন খারাপের দিনে খুব কাজের চাপ না থাকলে ও জোন্স বিচে চলে আসে। এখানে নীল জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে চমৎকার লাগে নন্দিনীর।
পায়ের কাছ দিয়ে এই মাত্র একটি কচ্ছপ চলে গেল। নন্দিনী অবাক হয়ে ভাবে, একটা কচ্ছপকে মানুষের চেয়ে বেশি আয়ু দিয়েছেন ঈশ্বর। কী দরকার ছিল একটা কচ্ছপের ৫০০ বছর আয়ু দেওয়ার? এই সুন্দর পৃথিবীতে ওদের কোনো কন্ট্রিবিউশন কি আছে? হয়তো আছে।
শুভংকরের ধর্মবিশ্বাস ভিন্ন। একদিন বলেছিল, মানুষই জন্ম দিয়েছে ঈশ্বরের। তাই ঈশ্বর মানুষকে বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখে না।
নন্দিনী একা একাই হেসে ফেলে। এ জীবনে বোধ হয় তার আর শুভংকরকে ভুলে থাকা হবে না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তাকে বহু দূর ড্রাইভ করে যেতে হবে। সেই লং আইল্যান্ড থেকে ব্রঙ্কস। কমপক্ষে দুই ঘণ্টার ড্রাইভ। কোন দিকে না তাকিয়ে নন্দিনী গাড়ি স্টার্ট দেয়।
এখন একটা গান হলে মন্দ হয় না। গাড়ির ড্যাশ বোল্টে সব শুভংকরের পছন্দের গান। বাটন প্রেস করতেই সঞ্জীব চৌধুরীর—
‘আমি তোমাকেই বলে দেব
কি যে একা দীর্ঘ রাত
আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে
আমি তোমাকেই বলে দেব
সেই ভুলে ভরা গল্প...’
এই গানটার সঙ্গে নন্দিনীর কষ্টের কোথায় যেন একটা মিল আছে। শুভংকর নন্দিনীর সঙ্গে ঝগড়া করলে এই গানটি সবচেয়ে বেশি শুনত। শুভংকরের প্রথম চিঠি আজও নন্দিনীর দাগ কেটে আছে। নন্দিনী বোধ হয় একমাত্র প্রেমিকা, যে কিনা একটা চিঠি ১০০০ বার পড়েছিল। কি চমৎকার লেখনী।
প্রিয় নন্দি,
লিখতে গিয়ে থমকে যাচ্ছি একটা বিষয়ে। সেটা হলো প্রেম। কখনো ভাবিনি আমি কারও প্রেমে পড়ব। রোমান্স হবে। মান অভিমান হবে। ঝগড়া–ঝাঁটি করে অবিরাম কাঁদতে থাকব।
তোমাকে বলছি, প্রেমে পড়ার আগে আমি কেঁদেছি সর্বসাকল্যে তিনবার। এক. দিদির যখন বিয়ে হল। দুই. বাবা যখন চলে গেল। তিন. মাও যখন চলে গেছে।
এরপর আমি কাঁদছি তোমার মাঝে বইতে গিয়ে। নাহ, এই কান্না অবশ্য বিষাদের নয়। অর্জনের কান্না। তোমাকে অর্জন। তোমার মন, মনস্তাত্ত্বিক অথবা অনুভূতি দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কান্না। এক কথায় সুখের কান্না বলা যায়। তোমার অনুভূতির অংশীদার হতে পারার সাফল্যর কান্না।
জানো তো, আমি আড়ালে ছাড়া কাঁদতে পারি না। যখন তুমি কষ্ট দাও, ভুল বোঝো অথবা হুট করে লাপাত্তা হয়ে যাও। তখন অঝোরে জল ঝরতে থাকে, যেটা কেউই দেখে না। দেখে না বলা ভুল হবে, বলা যায় দেখাই না।
আচ্ছা লাপাত্তা হয়ে যাওয়াই কি সমাধান?
এই যে মা–বাবা লাপাত্তা হয়ে গেল। অগণিত আলো কিংবা জ্ঞানগর্ভ সংগ্রামীরা, মানবতাবাদীরা লাপাত্তা হয়ে গেল বা লাপাত্তা করে দেওয়া হল-ওনারা থেকে গেলেই কি পৃথিবী, প্রকৃতি, মানুষ ও সমাজ আরও সুন্দর হতো না? কি বলো?
সুন্দর শব্দটা আমার জন্য আপেক্ষিক নয়, বরং বলা যায় চিরস্থায়ী। ব্যক্তি মালিকানাধীন আর স্বাধীন নয়। এ কারণেই স্বাধীন নয়, তুমি ছাড়া আমার এই পৃথিবী নামক গ্রহটাকেই সুন্দর মনে হয় না।
পৃথিবী, পৃথিবীর কথা মনে হলেই বুক আঁতকে ওঠে। এখানে তুমি আমি বা আমাদের কোলাহল, কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী নয়। সব ক্ষণস্থায়ী! একদিন আমাদের পৃথিবী ছাড়তে হবে, এই কথা বোধ হওয়ার পর থেকেই শুনছি। এত দিন আমলে নিইনি। ছাড়লে ছাড়ব, এমন একটা ড্যাম কেয়ার ভাব ছিল। কিন্তু আমার এখন পৃথিবী ছাড়তে ইচ্ছে করে না! কারণ, আমার সব ইচ্ছেই এখন তোমাকে কেন্দ্র করে। তোমাতেই বিরাজমান, ধাবমান। তথাপি বহমান।
চিরন্তন সত্য কেউ কি উপেক্ষা করতে পারে? পারে না। কিন্তু আশাবাদী হতে পারে। আমি আশাবাদী। তোমাকে দেখার সাধ, ছোঁয়ার তৃষ্ণা, শেষ অবধি ভালোবেসে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। এ জন্মে না হলে আমি পুনর্জন্ম চাই তোমার আর আমার। পুনরায় জন্ম চাই!
প্রতিদিন ভালোবাসা বাড়ছে, মায়া বাড়ছে, পাওয়ার তীব্রতা বাড়ছে।
আমার সব তীব্রতায় তুমিই আছ, তুমিই থাকবে, তোমাকেই চাই। তাই ভালোবাসি, ভালোবাসি আর ভালোবেসে যেতে চাই।
ইতি,
শুভংকর।
এই চিঠি আজ অনেকটাই মিথ্যে। শুভংকর ভীষণ ব্যস্ত। তার পাওয়ার তীব্রতা হয়তো কমেছে। নিজের মনে নন্দিনী বলে ওঠে, আমাদের বিচ্ছেদ হয়নি। হবেও না কোন কালে। এই যে ওর আমাকেই চাই। এই চাওয়া হয়তো অন্য কিছু। যেটার কোন নাম আমি জানি না।
সঞ্জীব গাইছেন,
‘কি যে একা দীর্ঘ রাত
আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে...’
নন্দিনীর গাড়ি এগিয়ে যায়। রিয়ার ভিউ মিররে সমুদ্রের নীল জলের দিকে চোখ যায় এক পলক। নন্দিনীর গাড়িটি এগিয়ে যায় অজানা এক কোলাহলের নগরের দিকে।