
২০১৭ সালটি আমেরিকায় কেমন ছিল? এক কথায় উত্তর দেওয়া যায়, সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টুইট বার্তায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছেন। আর জনপ্রিয় টিভি লেট নাইট শোগুলো প্রেসিডেন্টকে নিয়ে নানা ধরনের কৌতুকে (বাংলাদেশে কোনো নেতা-নেত্রীকে নিয়ে সেটা কল্পনাও করা যায় না) পরিপূর্ণ ছিল। যদিও অবস্থার কোনো উন্নতি বা ব্যত্যয় এখনো দেখা যাচ্ছে না। তবুও নিউইয়র্কবাসী তাঁদের বর্ষবরণে সামান্যতম ঘাটতিও রাখেননি। তাই প্রেসিডেন্টের কথা নয়; বরং বলব নিউইয়র্কের বর্ষবরণ নিয়ে কিছু কথা।
পৃথিবীর রাজধানী বলে পরিচিত নিউইয়র্ক, যেখানে আছে ১৫০টি মিউজিয়াম, কয়েক শ আর্ট গ্যালারি, ৩৮টি ব্রডওয়ে থিয়েটার, ১২০টি অফ ব্রডওয়ে থিয়েটার, ১
হাজার ৮০০টির বেশি রেস্তোরাঁ, দুই হাজারের বেশি পানশালা, ১ হাজার ৭০০-এর মতো পার্ক, ১২ হাজারের বেশি ইয়েলো ট্যাক্সি এবং ৬০০ মাইলের বেশি লম্বা পাতালরেল বা সাবওয়ে। যেখানে সারা পৃথিবীর প্রতিটি দেশের কেউ না কেউ বাস করেন। যেখানে ৪৫ শতাংশ মানুষ ইংরেজি ছাড়া কমপক্ষে ১২০টি অন্য ভাষায় কথা বলেন, যেখানে বারো মাসে তেরো পার্বণ নয়, প্রতিদিনই কোনো না কোনো অনুষ্ঠান লেগেই থাকে।
‘থ্যাংকস গিভিং ডে’ পালনের পর থেকেই শুরু হয়ে যায় ক্রিসমাস ও নববর্ষ পালনের প্রস্তুতি। ৪৮ ও ৫১ স্ট্রিট এবং ফিফথ ও সিক্সথ অ্যাভিনিউর মাঝে রকফেলার সেন্টারের সামনে ক্রিসমাস ট্রি স্থাপনের মাধ্যমে শুরু হয় ক্রিসমাস ও নববর্ষ পালন উৎসব। এ বছর ক্রিসমাস গাছটি স্থাপন করা হয়েছে ২৯ নভেম্বর। ৭৫ ফুট লম্বা নরজিয়ান-স্প্রাউস জাতের গাছটি সংগ্রহ করা হয়েছে পেনসিলভানিয়া স্টেট কলেজ থেকে। গাছটির বয়স ৮০ বছর। গাছটিতে ৫০ হাজার বিভিন্ন রঙের এলইডি বাতি দিয়ে আলোক সজ্জা করা হয়েছে। আর গাছটিতে বাতিগুলো লাগাতে যে তার ব্যবহার করা হয়েছে তার দৈর্ঘ্য ৫ মাইল।
রকফেলার সেন্টার হলো ১২টি বিল্ডিংয়ের সমন্বয়ে একটি বিজনেস সেন্টার। এই ভূসম্পত্তির মালিক ও ব্যবসায়ী রকফেলারের নামানুসারে এর নাম রকফেলার সেন্টার। মূল বিল্ডিংটি হলো ৭০তলা এবং এর উচ্চতা ৮৫০ ফিট। এর ছাদ থেকে আশপাশের ৫০ মাইল পর্যন্ত দেখা যায়। এখানে পৃথিবীর বহু দেশের বাণিজ্যিক অফিস, অনেক রেডিও ও টেলিভিশন কেন্দ্রের অফিস অবস্থিত। রকফেলার সেন্টার শুধু একটি বিজনেস সেন্টার নয়, এটি হলো আমেরিকার আধুনিক স্থাপত্যের প্রতীক। এখানে স্থাপন করা হয়েছে পৃথিবীর নাম করা সব শিল্পীর গড়া শিল্পকর্ম। যেমন গ্রিক দেবতা প্রমিথিউসের ভাস্কর্য এবং ইতালিয়ান-আমেরিকান ভাস্কর্য শিল্পী এ্যটিরিও পিসিরিলির তৈরি বিভিন্ন ভাস্কর্য (ফিগার)। আছে বিশাল সব ম্যুরাল। আছে ৪৮ হাজার স্কয়ার ফুট বাগান, অত্যাধুনিক সব রেস্তোরাঁ। আছে নানা সুযোগ-সুবিধাসহ দুটি থিয়েটার হল। একটির নাম ‘রেডিও সিটি মিউজিক হল’। এর আসনসংখ্যা ৬ হাজার ২০০।
ক্রিসমাসের উৎসব চলতে চলতেই চলে আসে ইংরেজি নববর্ষের অনুষ্ঠান। সম্ভবত পৃথিবীজুড়ে বর্ষবরণের যতগুলো অনুষ্ঠান হয়, সেগুলোর মধ্যে নিউইয়র্কের প্রাণকেন্দ্র ম্যানহাটনের টাইমস স্কয়ারের অনুষ্ঠান যে অন্যতম তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
টাইমস স্কয়ার নামটি এসেছে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত আমেরিকার অন্যতম দৈনিক দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর অফিস একসময় এ এলাকায় ছিল বলে। এক শ বছর আগে ১৯০৪ সালে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এই চত্বরে অফিস স্থাপন করে এবং ১৯১৩ সালে সেখান থেকে অন্যত্র চলে গেলেও এ নামটি থেকে যায়। টাইমস স্কয়ারের অবস্থান হলো ব্রডওয়ে এবং ৪২ স্ট্রিটের সংযোগস্থল। তবে এর বিস্তার এখন আশপাশের কয়েক ব্লক পর্যন্ত। ধীরে ধীরে টাইমস স্কয়ার একটি ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে বিস্তৃতি লাভ করে। এ এলাকায় স্থাপিত হয় ডিজনি, ওয়ার্নার ব্রাদার্সসহ অসংখ্য ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, টিভি স্টুডিও এবং পৃথিবীর নামকরা সব রেস্তোরাঁ। বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিশাল সব নিয়ন সাইন, বিশাল বিশাল সব টিভি পর্দায় চলমান বিজ্ঞাপন, শত শত রঙিন আলোর ঝলকানি এই এলাকায় এক অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি করে।
টাইম স্কয়ারে প্রথম বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি হয় ১৯০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে। সেই থেকে ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব চলে আসছে। বছরের এই দিনটিতে সংগীতে নাচে-গানে, আনন্দ-উচ্ছ্বাসে নববর্ষকে বরণ করতে নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে সমবেত হন সারা বিশ্ব থেকে লাখ লাখ পর্যটক। রাত ঠিক ১২টা বাজার ১০ সেকেন্ড আগে থেকে কাউন্টডাউন শুরু হয়। টেন, নাইন, এইট...ঠিক ১২টায় ১ নং টাইমস স্কয়ারের টাওয়ার থেকে নেমে আসে বিশেষভাবে নির্মিত একটি আলোকোজ্জ্বল ক্রিস্টাল বল। এ বছর যে বলটি ব্যবহার করা হবে তার ব্যাস হলো ১২ ফুট এবং যেটির ওজন হলো ১১ হাজার ৮৭৫ পাউন্ড। ক্রিস্টালগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত আছে নানা রঙের ৩২ হাজার ২৫৬টি এলইডি বাতি, যা থেকে চারদিকে আলোক বিচ্ছুরিত হয়। প্রতিবছর একজন প্রথিতযশা ব্যক্তি বোতাম টিপে ওই বলটিকে নিচে নামান আর সঙ্গে চলতে থাকে কাউন্টডাউন। মিলেনিয়াম বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটিতে শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে খ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মুহাম্মদ আলী এই সুইচ টিপেছিলেন। ২০০২ সালে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই নিউইয়র্ক সিটির সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানি ভূতপূর্ব মেয়র মাইক ব্লুমবার্গকে শপথ করিয়ে ছিলেন। এ বছর টাইমস স্কয়ারে ওই বোতাম টিপবেন #MeToo আন্দোলন খ্যাত ‘তারানা বুইক’।
টাইমস স্কয়ারে ক্রিস্টাল বলটি নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনতার গগনবিদারি আনন্দ ধ্বনি, পরস্পরকে আলিঙ্গন ও চুম্বনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নতুন একটি বছর। অনুষ্ঠান চত্বরে সারা রাত ধরে চলে নাচ-গান। সারা বিশ্বের কোটি কোটি লোক সরাসরি টেলিভিশন সম্প্রচারের মাধ্যমে অবলোকন করেন এই অনুষ্ঠান। এক মুহূর্তের জন্য হলেও সবাই যেন ভুলে যায় পার্থিব সব ব্যথা-বেদনা, না-পাওয়া। সবাই উপভোগ করে একটি চমৎকার নতুন বছরের।
আর অল্প কয়েক দিন পরই ২০১৮ সালকে বরণ করব আমরা। এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আজকাল বাংলাদেশিরা পিছিয়ে থাকে না। আসুন, আমরাও সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলি হ্যা-পি-নি-উ-ইয়ার। আর আপনাদের সবাইকে জানাই ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা।
লেখক: আবদুল্লাহ জাহিদ. গল্পকার, ই-মেইল: myshathi@gmail.com