কনসার্ট চলাকালে স্টেডিয়ামের বিশাল পর্দায় হঠাৎ এক নারী ও এক পুরুষের ছবি ভেসে ওঠে। তাঁরা আলিঙ্গনরত অবস্থায় দাঁড়িয়ে গানের তালে তালে দুলছিলেন
কনসার্ট চলাকালে স্টেডিয়ামের বিশাল পর্দায় হঠাৎ এক নারী ও এক পুরুষের ছবি ভেসে ওঠে। তাঁরা আলিঙ্গনরত অবস্থায় দাঁড়িয়ে গানের তালে তালে দুলছিলেন

কনসার্টে আলিঙ্গনের দৃশ্য ভাইরাল

‘কিস ক্যাম’ কী, এই ক্যামেরা কাদের দেখায়

যুক্তরাষ্ট্রে কোল্ডপ্লের এক কনসার্টে দর্শকেরা গান শুনছিলেন, আর বিশাল পর্দা দর্শকদের মাঝে খুঁজছিল ‘স্পটলাইট জুটি’ (আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকা জুটি)। হঠাৎ পর্দায় ভেসে উঠল একজন নারী ও একজন পুরুষ—দুজনেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে গানের তালে দুলছিলেন। মুহূর্তেই গোটা স্টেডিয়ামের চোখ তাঁদের দিকে। আর তখনই বোঝা গেল—এটা ‘কিস ক্যাম’!

ম্যাসাচুসেটসের ফক্সবোরোর জিলেট স্টেডিয়ামে গত বুধবারের এ দৃশ্য ভাইরাল হতে দেরি হয়নি একটুও।

ভিডিওতে দেখানো পুরুষটি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রোনোমার প্রধান নির্বাহী (সিইও) অ্যান্ডি বাইরন। আর ওই নারী অ্যাস্ট্রোনোমারের প্রধান জনসম্পদ কর্মকর্তা ক্রিস্টিন ক্যাবট। বড় পর্দায় দেখা যাওয়া তাঁদের আলিঙ্গনের দৃশ্য ভাইরাল হওয়ার পর অ্যাস্ট্রোনোমার বাইরনকে প্রথমে ছুটিতে পাঠায়। গতকাল শনিবার কোম্পানির পক্ষ থেকে বাইরনের পদত্যাগের খবর জানানো হয়।

‘কিস ক্যাম’ কী

‘কিস ক্যাম’ হলো একটি জনপ্রিয় সামাজিক বিনোদনের অংশ—ক্যামেরা সেগমেন্ট (বিশেষ ক্যামেরা–ঝলক)। এটি সাধারণত স্টেডিয়াম, বড় কোনো উৎসব, কনসার্ট বা অন্যান্য জনসমাগম অনুষ্ঠানে বড় পর্দায় দেখা যায়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এটি বেশ জনপ্রিয়। এটা মূলত ‘ফান ট্র্যাডিশন’ হিসেবে পরিচিত।

খেলার বিরতি বা টাইমআউটের সময় একটি ক্যামেরা দর্শকদের স্ক্যান করে কোনো জুটিকে বেছে নেয়। তাঁদের ছবি বা ভিডিও স্টেডিয়ামের বিশাল পর্দায় দেখানো হয়। প্রেমের সুর বা ঘোষকের কোনো হাস্যরসাত্মক ঘোষণার মধ্য দিয়ে এ জুটিকে বিশেষ কোনো দৃশ্যে নিজেদের তুলে ধরতে উৎসাহ দেওয়া হয়। কিস ক্যাম মাঝেমধ্যে এমন কিছু মুহূর্ত ধরে ফেলে, যা দেখে দর্শক হাসেন, চিৎকার করেন আর ওই জুটি লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলেন।

যেভাবে শুরু

কিস ক্যামের প্রচলন হয় ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে, ক্যালিফোর্নিয়ায়। পেশাদার বেসবল ম্যাচে নতুন যুক্ত করা বিশাল ভিডিও পর্দাগুলো বিরতির সময় ব্যবহার করে দর্শকদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে এটি চালু হয়। প্রথমে মজা করার জন্য শুরু হলেও ধীরে ধীরে খেলার মাঠে এটি একটি জনপ্রিয় রীতি হয়ে ওঠে। পরে তা বিভিন্ন খেলাধুলার লিগ ও ইভেন্টে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রথাটি সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বেসবল, বাস্কেটবল, আমেরিকান ফুটবল ও হকি ম্যাচগুলোয় বেশি দেখা যায়। তবে এটি কনসার্ট, উৎসব ও অন্যান্য বড় জনসমাগমস্থলেও ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিস ক্যাম শুধু রোমান্টিক জুটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; বরং এটি পারিবারিক বন্ধন, বন্ধুত্ব ও মাঝেমধ্যে মজার ছলে কৌতুকপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করতেও ব্যবহৃত হয়।

কিস ক্যামের উদ্দেশ্য

কিস ক্যামের মূল উদ্দেশ্য হলো দর্শকদের মধ্যে হাস্যরস ও রোমান্টিকতা সৃষ্টি করা। এটি কোনো খেলার বিরতিতে বা খেলার উত্তেজনা যখন কিছুটা কমে যায়, তখন দর্শকদের মাতিয়ে রাখার একটি উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনেক সময় প্রথাটি অপ্রত্যাশিত বা মজার মুহূর্ত তৈরি করে, যেমন যখন কোনো বন্ধুকে তার বন্ধুর সঙ্গে বা পরিবারের সদস্যকে পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে পর্দায় দেখানো হয় এবং তাঁরা মজার ছলে একে অপরের গালে চুম্বন করেন।

কীভাবে কাজ করে

একজন ক্যামেরা অপারেটর দর্শকদের মধ্য থেকে কোনো জুটিকে নির্বাচন করেন (প্রায়ই ধরে নেওয়া হয়, তাঁরা প্রেমিক-প্রেমিকা)। বড় পর্দায় ‘কিস ক্যাম’ অ্যানিমেশনের সঙ্গে ওই জুটির ছবি দেখানো হয়। দর্শকেরা করতালি, চিৎকার করে তাঁদের উৎসাহ দেন।

ওই জুটি পর্দার সামনে চুম্বন দিলে ব্যাপক করতালি পড়ে। আর যদি কেউ চুম্বন দিতে অস্বীকার করেন, তবে মজার ভঙ্গিতে চারদিকে ‘বু’ ধ্বনি শোনা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রে বেসবল খেলা চলাকালে গ্যালারি থেকে এভাবে এক জুটিকে কিস ক্যামে দেখানো হচ্ছে

এ ক্যামেরা কাদের দেখায়

সাধারণত স্টেডিয়ামে বসে থাকা কোনো জুটি বা দম্পতিকে এ ক্যামেরা দেখায়। অধিকাংশ সময় এ জুটি বন্ধু বা প্রেমিক-প্রেমিকা হন। তবে মাঝেমধ্যে ভুলে ভাইবোন বা অচেনা দুজনও ক্যামেরার চোখে পড়ে যান। তখন বিষয়টি হাস্যরসের উৎস হয়ে দাঁড়ায়।

যেমন ২০১২ সালের ১৬ জুলাই ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল জাতীয় পুরুষ দলের মধ্যে অলিম্পিক বাস্কেটবল খেলার সময় স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা। ওই দিন কিস ক্যাম পর্দায় ওবামা ও মিশেলকে চুম্বন করতে দেখা গেছে।

এসব মুহূর্ত অনেক সময় বিব্রতকর, হাস্যকর কিংবা একেবারে অভিনয় বলে মনে হয়। কখনো কখনো ইভেন্ট স্টাফ বা মাসকটদেরও ইচ্ছাকৃতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা পুরো বিষয়টিকে আরও মজার করে তোলে।

জনপ্রিয়তার কারণ

কিস ক্যাম একটি হালকা মেজাজের বিষয়। মূল খেলার মাঝে এটি দর্শকদের মজাদার বিরতি এনে দেয়। কখনো কখনো এটি দর্শকদের কৌতুকপূর্ণ মুহূর্ত, রোমান্টিক দৃশ্য, অসংলগ্ন ও অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া উপহার দেয়।

দৃশ্যের তাৎক্ষণিকতা ও লাইভ রিঅ্যাকশনগুলো একে একটি আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতায় পরিণত করে, তা মাঠে উপস্থিত দর্শকদের জন্য হোক কিংবা টিভি বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা দর্শকদের জন্য হোক।

দৃশ্য যখন ভাইরাল

কখনো কখনো কিস ক্যাম এমন কিছু দেখায়, যা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো, মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রোনোমারের সিইও অ্যান্ডি বাইরন ও প্রধান জনসম্পদ কর্মকর্তা ক্রিস্টিন ক্যাবটকে কনসার্টে একসঙ্গে পর্দায় দেখানো।

কনসার্ট চলাকালে স্টেডিয়ামের বিশাল পর্দায় (স্ক্রিন) হঠাৎ বাইরন ও ক্যাবটের ছবি ভেসে ওঠে। তাঁরা আলিঙ্গনবদ্ধ অবস্থায় দাঁড়িয়ে গানের তালে তালে দুলছিলেন। ক্যামেরায় ধরা পড়তে দেখে মুহূর্তের মধ্যে তাঁরা লজ্জায় মুখ লুকানোর চেষ্টা করেন। ক্যাবট ঘুরে গিয়ে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেন, বাইরন নিচু হয়ে বসে পড়েন। তাঁদের অস্বস্তিকর এ প্রত্যাখ্যান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার ঝড় তোলে। সম্মতি, গোপনীয়তা ও সময় নির্বাচনের বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

মুহূর্তটি ধারণ করা ভিডিও দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। টিকটকে পোস্ট করা প্রথম ভিডিওটি কয়েক লাখবার দেখা হয়। পরে ভিডিওটি অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে পড়ে, মিমে পরিণত হয়, টেলিভিশন শোতে হাস্যরসের উপকরণ হয়ে ওঠে।

পপ সংস্কৃতিতে প্রভাব

কিস ক্যাম এখন টিভি সিটকম (টেলিভিশন সিচুয়েশন কমেডি), সিনেমা ও কমেডি শোতেও ঠাঁই করে নিয়েছে, যা একে পপ সংস্কৃতির একটি অংশে পরিণত করেছে। এ ধরনের ক্লিপ প্রায়ই ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম রিল, এক্স থ্রেড ও টিকটকে দেখতে পাওয়া যায়।

এ ছাড়া অনেক সময় প্রেমের প্রস্তাব, জেন্ডার রিভিল (পারিবারিক বা সামাজিক আয়োজন, যেখানে এক দম্পতি তাঁদের অনাগত সন্তানের লিঙ্গ জনসমক্ষে প্রকাশ করে) কিংবা কৌতুকের (প্র্যাঙ্ক) অংশ হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়।

বিতর্ক ও উদ্বেগ

যদিও সাধারণভাবে এটি মজার বিষয় হিসেবে দেখা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিস ক্যাম কিছু সমালোচনার মুখে পড়েছে। অনেকে মনে করেন, এটি ব্যক্তিগত পরিসরে হস্তক্ষেপ করে এবং সবার জন্য আরামদায়ক নয়, অস্বস্তিকর।

অনেক সময় জুটি ভেবে অপ্রস্তুত বা অনিচ্ছুক সহকর্মী বা আত্মীয়কে দেখানো হয়। যেমনটা ঘটেছে অ্যান্ডি বাইরন ও ক্রিস্টিন ক্যাবটের ক্ষেত্রে। এ দৃশ্যের কারণে তাঁরা প্রতিষ্ঠান ও পারিবারিকভাবে হেয় বোধ করেছেন। প্রথমে বাইরনকে ছুটিতে পাঠানো হলেও তিনি পদত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

বর্তমানে অনেক স্টেডিয়ামে ক্যামেরা অপারেটরদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যেন তাঁরা বিতর্কিত জুটি এড়িয়ে চলেন এবং শুধু আগ্রহী দর্শকদেরই বেছে নেন।

তথ্যসূত্র: রয়টার্স, ইন্ডিয়া টুডে, দ্য ইকোনমিক টাইমস ও টাইমস অব ইন্ডিয়া।