
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি অস্থায়ীভাবে ওয়াশিংটন ডিসির পুলিশ বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছেন। শহরটিতে ৮০০ জন ন্যাশনাল গার্ড সেনা মোতায়েন করারও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
ট্রাম্প বলছেন, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির প্রবণতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিকে রক্ষা করতে এমন পদক্ষেপ জরুরি ছিল।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, ২০২৩ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে সহিংস অপরাধের ঘটনা বৃদ্ধি পেলেও তার পর থেকে তা দ্রুত কমছে।
ট্রাম্প কেন শহরটিতে ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যদের মোতায়েন করলেন, তাঁদের কাজ কী, সেখানে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েনের প্রয়োজন ছিল কি না, এ বিষয়গুলো জেনে নেওয়া যাক।
৭৮ মিনিটের এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ক্রমবর্ধমান অপরাধ মোকাবিলার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া (ডিসি) মেট্রোপলিটন পুলিশ বিভাগকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নেবে।
ট্রাম্প বলেন, ‘আমি আমাদের দেশের রাজধানীকে অপরাধ, রক্তপাত, বিশৃঙ্খলা, অসচ্ছলতা—এমনকি তার চেয়ে খারাপ অবস্থা থেকে রক্ষা করার জন্য এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপের ঘোষণা দিচ্ছি।’
ওই সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডিও উপস্থিত ছিলেন। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে শহরের পুলিশ বাহিনীকে পরিচালনা করবেন।
টাইটেল থার্টি টু স্ট্যাটাস অনুসারে ন্যাশনাল গার্ড পরিচালিত হয়; অর্থাৎ তারা স্থানীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হবে, তবে তাদের তহবিল জোগাবে কেন্দ্রীয় সরকার। এ ক্ষেত্রে তারা পসি কমিট্যাটাস আইন মেনে চলতে বাধ্য। এ আইনে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে যুক্ত হওয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ট্রাম্প বলেন, ‘এটা ডিসির স্বাধীনতা দিবস। আমরা আমাদের রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে যাচ্ছি। আমরা এটিকে ফিরে পাচ্ছি।’
ট্রাম্প আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার যে ক্ষমতা আছে, তার আওতায় আমি ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া হোম রুল অ্যাক্টের ৭৪০ ধারা ব্যবহার করে ডিসি মেট্রোপলিটন এবং পুলিশ বিভাগকে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছি।’
ট্রাম্প ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করারও ঘোষণা দিয়েছেন।
ট্রাম্প বলেন, ‘আমি ওয়াশিংটন ডিসিতে আইন, শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করছি এবং তাদের যথাযথভাবে কাজ করার অনুমতি দিতে যাচ্ছি।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তিনি রাজধানীর গৃহহীন মানুষকে সরানোর পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু কীভাবে এটা করা হবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেননি।
১৯৭৩ সালের হোম রুল অ্যাক্ট হলো এমন একটি মার্কিন আইন, যা প্রথমবারের মতো ওয়াশিংটন ডিসিকে স্বায়ত্তশাসনে চলার সুযোগ দিয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের একটি আসন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র শহর, যেটি ৫০টি অঙ্গরাজ্যের কোনোটিরই অন্তর্ভুক্ত নয়। আর এ কারণে মার্কিন কংগ্রেসে ওয়াশিংটন ডিসির কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধিত্ব নেই।
১৯৭৩ সালের আগপর্যন্ত প্রায় ১০০ বছর ধরে শহরটি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন প্রেসিডেন্টের নিয়োগকৃত তিনজন কমিশনার। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন হোম রুল অ্যাক্ট নামক আইনে স্বাক্ষর করেন। এর মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটন ডিসির বাসিন্দারা নিজেদের মেয়র আর নগর পরিষদ নির্বাচিত করার সুযোগ পেলেন।
অবশ্য ওই আইনে বলা আছে, বিশেষ বা জরুরি পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট চাইলে শহরের পুলিশ বাহিনীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবেন।
২০২০ সালে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে বিক্ষোভ চলার সময় ট্রাম্প এমন পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়োজনে ওয়াশিংটন ডিসির পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করা যায়।
প্রেসিডেন্ট চাইলে ওয়াশিংটন ডিসির পুলিশ বাহিনীকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারেন। আর যদি তিনি কংগ্রেসকে জানান, তাহলে ৩০ দিন পর্যন্ত পুলিশকে ব্যবহার করা যায়।
ট্রাম্প বলেছেন, তিনি প্রথম ৪৮ ঘণ্টার পরও ডিসি পুলিশকে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে ব্যবহার করতে চান এবং এ ব্যাপারে তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাবেন।
সিএনএনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মোতায়েন হওয়া সেনারা রাস্তায় টহল দেওয়ার সময় প্রকাশ্যে রাইফেল বহন করবেন না বলে মনে করা হচ্ছে। সম্ভবত, তাঁরা কাছাকাছি কোথাও তাঁদের অস্ত্র রাখবেন। যেমন তাঁরা তাঁদের ট্রাকে অস্ত্রগুলো রাখতে পারেন, যেন প্রয়োজন হলেই আত্মরক্ষার কাজে সেগুলো ব্যবহার করা যায়।
ওয়াশিংটন ডিসির মেয়র মিউরিয়েল বাউসার বলছেন, পুলিশ এখনো নগর প্রশাসনের অধীনেই কাজ করছে। তিনি বলেন, ‘স্পষ্ট করে বলছি, পামেলা স্মিথ মেট্রোপলিটন পুলিশ বিভাগের প্রধান এবং তাঁর নির্দেশনায় ৩ হাজার ১০০ পুলিশ সদস্য কাজ করেন।’
বাউসার আরও বলেন, ‘আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। নির্বাহী আদেশেও আলাদা কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।’
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম পলিটিকোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কেন্দ্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন ভবন ও জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে সুরক্ষার কাজ করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর বিবৃতি অনুযায়ী, যেকোনো মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য ১০০-২০০ ন্যাশনাল গার্ড সেনা প্রস্তুত থাকবে। প্রশাসনিক কাজ, জিনিসপত্র সরবরাহ এবং মাঠে উপস্থিত থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতাসহ বিভিন্ন কাজ করবে তারা।
টাইটেল থার্টি টু স্ট্যাটাস অনুসারে ন্যাশনাল গার্ড পরিচালিত হয়; অর্থাৎ তারা স্থানীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হবে। তবে তাদের তহবিল জোগাবে কেন্দ্রীয় সরকার। এ ক্ষেত্রে তারা পসি কমিট্যাটাস আইন মেনে চলতে বাধ্য। এ আইনে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে যুক্ত হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেছেন, চলতি সপ্তাহে ন্যাশনাল গার্ডের সেনারা ওয়াশিংটন ডিসিতে যাওয়া শুরু করবেন।
সিএনএনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মোতায়েন হওয়া সেনারা রাস্তায় টহল দেওয়ার সময় প্রকাশ্যে রাইফেল বহন করবেন না বলে মনে করা হচ্ছে। সম্ভবত, তাঁরা কাছাকাছি কোথাও তাঁদের অস্ত্র রাখবেন। যেমন তাঁরা তাঁদের ট্রাকে অস্ত্রগুলো রাখতে পারেন, যেন প্রয়োজন হলেই আত্মরক্ষার কাজে সেগুলো ব্যবহার করা যায়।
হেগসেথ বলেছেন, পেন্টাগন আরও কিছু ন্যাশনাল গার্ড ইউনিট ও অন্য বিশেষ ইউনিটকে আনতে প্রস্তুত রয়েছে। তবে তিনি এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলেননি।
শহর থেকে গৃহহীনদের সরানোর জন্য সেনারা সাহায্য করবেন কি না, জানতে চাইলে হেগসেথ বলেন, সেনারা স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করবেন।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের কাজ হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশে থাকা।’
ডোনাল্ড ট্রাম্পের আদেশে বলা হয়েছে, রাজধানী শহরে বাড়তে থাকা সহিংসতার ঘটনা এখন জরুরি পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তা সরকারি কর্মচারী, সাধারণ মানুষ এবং পর্যটকদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে, কেন্দ্রীয় সরকারের সুষ্ঠু কার্যক্রমে বাধা দিচ্ছে।
আদেশে আরও বলা হয়েছে, অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়মিত প্রেসিডেন্টকে ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ায় বিদ্যমান জরুরি পরিস্থিতি সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য দেবেন।
বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়াশিংটন ডিসিতে সাম্প্রতিক এক হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের সূত্রপাত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি দক্ষতা বিভাগের (ডিওজিই) সাবেক কর্মী এডওয়ার্ড কোরিস্টিনের ওপর এ হামলা হয়। কোরিস্টিন হলেন শীর্ষ ধনী ইলন মাস্কের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। মাস্ক একসময় ডিওজিইর নেতৃত্ব দিয়েছেন।
পুলিশ বলছে, ৩ আগস্ট ভোরে ১৯ বছর বয়সী কোরিস্টিন ও তাঁর সঙ্গীর ওপর ১০ কিশোর হামলা চালায়। পরে ১৫ বছর বয়সী দুই কিশোরকে গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
হামলার কয়েক দিন পর নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ ট্রাম্প লিখেছেন, ‘ডিসি যদি দ্রুত পরিস্থিতি সামাল না দেয়, তাহলে আমাদের আর কোনো উপায় থাকবে না। আমরা শহরটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসব এবং যেমনভাবে শহরটি চালানো উচিত, তেমনভাবে চালাব।’
ওই পোস্টের সঙ্গে ট্রাম্প কোরিস্টিনের একটি ছবিও যুক্ত করেন।
ওয়াশিংটন ডিসির মেয়র মিউরিয়েল বাউসার স্থানীয় আইন কার্যকরে ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদের মোতায়েনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর মতে, কৌঁসুলিদের জন্য বেশি তহবিল বরাদ্দ করা হলে আরও ফলপ্রসূ পরিবর্তন আসবে।
সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বাউসার বলেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে কোভিড পরিস্থিতি চলার সময় শহরটির যে পরিস্থিতি ছিল, তার ভিত্তিতেই পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছেন।
মিউরিয়েল বাউসার আরও বলেন, ‘এটা সত্যি যে তখন কিছু ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল। কোভিড-পরবর্তী সময়ে আমরা অপরাধ বাড়তে দেখেছি। তবে আমরা দ্রুত আইন ও কৌশল প্রণয়ন করে সহিংস অপরাধীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছি। আমাদের পুলিশকে আরও বেশি হাতিয়ার দিয়েছি।’
বাউসারের দাবি, বর্তমানে ওয়াশিংটন ডিসিতে সহিংস অপরাধ গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
ওয়াশিংটন ডিসির অপরাধের যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, অভিযোগ আছে, কিছু সংখ্যা বদলে পরিস্থিতি ভালো দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
বাউসার এসব তথ্য-উপাত্তের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ট্রাম্প যেভাবে ওয়াশিংটন ডিসিকে ‘আইনশৃঙ্খলা’ ভেঙে পড়া শহর হিসেবে বর্ণনা করছেন, তা ভুল।
গত জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ বলেছে, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে সহিংস অপরাধ ৩৫ শতাংশ কমেছে।
ওয়াশিংটন ডিসির মেট্রোপলিটন পুলিশ বিভাগের পরিসংখ্যানেও দেখা যায়, ওই সময়ে সহিংস অপরাধের হার কমেছে। ২০২৫ সালের প্রাথমিক তথ্য বলছে, এই ধারা এখনো বহাল আছে।
চলতি বছরের তথ্য অনুযায়ী, খুনের ঘটনা ১২ শতাংশ এবং বিপজ্জনক অস্ত্র দিয়ে হামলার ঘটনা ২০ শতাংশ কমেছে।
তবে মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো এফবিআই বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সহিংস অপরাধের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে।