স্বাস্থ্যকর পরিবেশে আপনি বুকভরে নিশ্বাস নিতে পারেন, নদীর পাড়ে কফিমগ হাতে বন্ধুর সঙ্গে অনায়াসে দুই ঘণ্টা গল্প করে কাটিয়ে দেওয়ার মতো আপনার সময় আছে, যেখানে গণপরিবহন একেবারে ঘড়ির কাঁটা মেনে চলে, আপনি সম্পূর্ণ নিরাপদ বোধ করেন, আছে নাগরিক সব সুযোগ-সুবিধা। এমন একটি শহরে বসবাসের স্বপ্ন সব মানুষই দেখে। কারণ, শহর মানে শুধু উঁচু ইমারত আর ইট-পাথরের জঞ্জালই নয়।
প্রতিবছর দ্য ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) গ্লোবাল লাইভেবিলিটি ইনডেক্স বা বসবাসের জন্য সেরা শহরগুলোর তালিকা প্রকাশ করে। ইআইইউ পাঁচটি মূল সূচকের ওপর ভিত্তি করে ১৭৩টি শহরের তালিকা করে থাকে। সেগুলো হলো স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো। ২০২৫ সালে বসবাসের জন্য কোন কোন শহর সেরা ১০–এ জায়গা করে নিয়েছে, তা দেখে নেওয়া যাক।
সবচেয়ে সুখী মানুষের শহরের তালিকায় প্রথম স্থান দখল করা কোপেনহেগেন এবার লাইভেবিলিটি ইনডেক্সে বা বসবাসের জন্য সেরা শহরের সূচকেও শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে সুখ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন কতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এ বছর অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাকে সরিয়ে কোপেনহেগেন লাইভেবিলিটি সূচকে ১ নম্বরে উঠে এসেছে। সেখানকার বাসিন্দা টমাস ফ্রাঙ্কলিন বলেন, ‘এখানে যদি ট্রেন ১২টা ১৬ মিনিটে আসার কথা থাকে, তবে সেটা ঠিক ১২টা ১৬ মিনিটেই আসে। আপনি যদি স্নিকার্স পরে কোনো বিলাসবহুল রেস্তোরাঁয় যান, কেউ সেদিকে তাকাবেই না। কোপেনহেগেনের শান্ত পরিবেশ আমাকে প্রতিবারই মুগ্ধ করে। রাস্তাগুলো প্রশস্ত, বাইসাইকেলের সংখ্যা গাড়ির চেয়ে বেশি আর গোটা শহর চলে সাধারণ বুদ্ধির ভিত্তিতে।’
শহরে সামাজিক বন্ধন অত্যন্ত দৃঢ়। এখানে কেউ চাপে বা তাড়াহুড়াতে নেই। খোলাবাজার আর পার্কে শিশুদের ছুটাছুটি আর কোলাহল দেখে সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। ফ্রাঙ্কলিন বলেন, এ শহর কখনো নিজেকে জাহির করে না, কিন্তু সব সময়ই প্রত্যাশা পূরণ করে।
টানা তিন বছর লাইভেবিলিটি সূচকে সবার ওপরে থাকা ভিয়েনা এবার এক ধাপ পিছিয়ে দ্বিতীয় স্থানে নেমে এসেছে। তার মানে এ নয় যে ভিয়েনায় জীবনযাপনের মান খানিকটা পড়ে গেছে; বরং কোপেনহেগেন নিজেদের আরও উন্নত করে ভিয়েনাকে ছাড়িয়ে গেছে।
অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা স্বাস্থ্যসেবায় নিখুঁত স্কোর ধরে রেখেছে, যা এখনো অন্য সব শহরের চেয়ে এগিয়ে। পাশাপাশি শিক্ষা ও অবকাঠামোতে এটি পূর্ণ নম্বর পেয়েছে। ফলাফল—এমন একটি শহর, যাকে নিয়ে বাসিন্দারা প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
ভিয়েনার বাসিন্দা ন্যাটালি ও’কনেল বলেন, ‘আমি নিউইয়র্কে জন্মেছি। তবে প্রায় চার বছর আগে জীবনধারার কারণে ভিয়েনায় চলে এসেছি এবং ফেরার কোনো পরিকল্পনা আমার নেই।’
ন্যাটালি জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থায় (ইউএনআইডিও) যোগাযোগ পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখানে এমন এক জীবনমান খুঁজে পেয়েছি, যা বিশ্বের কোনো বড় রাজধানী শহরে পাওয়া সম্ভব হবে বলে আমি কখনো কল্পনাও করি না।’
অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও অবকাঠামোতে জুরিখের জুড়ি মেলা ভার। গ্লোবাল লাইভেবিলিটি র্যাঙ্কিংয়ে জুরিখ শিক্ষায় ১০০–তে ১০০ নম্বর পেয়েছে। সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বাসিন্দারা রীতিমতো গর্ব করেন। তাঁদেরই একজন রোজামুন্ড ট্যাগেল।
রোজামুন্ড ট্যাগেল বলেন, ‘এখানকার সরকারি স্কুলগুলো অসাধারণ। যদি আমি এখনো যুক্তরাজ্যে থাকতাম, তবে নিঃসন্দেহে আমার সন্তানদের প্রাইভেট স্কুলে দিতাম, কিন্তু সুইজারল্যান্ডে সেটার একেবারেই প্রয়োজন নেই।’
রোজামুন্ড আরও বলেন, ‘আমাদের স্থানীয় স্কুলটা এতটাই আন্তর্জাতিক মানের যে আমার সন্তানেরা চারটি ভাষায় কথা বলে। আর এটা এখানে মোটামুটি স্বাভাবিক ব্যাপার। ওদের সব বন্ধুই অন্তত দুটি ভাষায় কথা বলতে পারে। আর বেশির ভাগই তিন বা চারটি ভাষায় বলে। এটি এক বিশাল সুবিধা।’
সূচকে চতুর্থ অবস্থানে থাকা মেলবোর্ন স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় সেরা নম্বর পেয়েছে। সেই সঙ্গে সংস্কৃতি ও পরিবেশে উচ্চ নম্বরের কারণে অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য শহরের তুলনায় বসবাসের জন্য সেরা শহরের তালিকায় মেলবোর্ন খানিকটা এগিয়ে গেছে। এ নিয়ে টানা তিন বছর মেলবোর্ন বসবাসের জন্য সেরা পাঁচ শহরের তালিকায় জায়গা পেল। গত বছরও এটি চতুর্থ স্থানে ছিল, এর আগের বছর ৩ নম্বরে।
অবকাঠামোতেও ভালো নম্বর পেয়েছে মেলবোর্ন। শহরটির আইনজীবী অলিভার মরিসি বলেন, একজন আইনজীবী হিসেবে কাজ করার জন্য তিনি এ শহরকে বেছে নিয়েছেন। কারণ, এখানে সামগ্রিকভাবে যেসব সুযোগ-সুবিধা আছে, তা অন্য অনেক বড় শহরেই পাওয়া যায় না।
মরিসি আরও বলেন, ‘আমি সুপ্রিম কোর্ট থেকে ১৫ মিনিটের কম সময়ের মধ্যে হেঁটে কলিন্স স্ট্রিটের কাছে একজন মক্কেলের সঙ্গে সহজে দেখা করতে পারি। আর ভালোভাবে দিনের কাজ করে স্কুল শেষে মেয়েকে নিয়ে পার্কে বেড়াতে যেতে পারি। আমার কাছে এটাই লাইভেবিলিটি বা বসবাসের মানে। এটা শুধু জীবনধারা নয়; বরং জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর মধ্যে সহজ গতিশীলতার বিষয়ও।’
জনকল্যাণমূলক নীতি ও সুশৃঙ্খল অবকাঠামোর কারণে সুইজারল্যান্ড ধারাবাহিকভাবে জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে প্রথম সারির দেশ। দেশটির দুটি শহর বসবাসের জন্য সবচেয়ে ভালো শহরের তালিকায় প্রথম পাঁচে স্থান পেয়েছে। ৩ নম্বরে জুরিখের পর ৫ নম্বরে জেনেভা।
স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামোয় জেনেভা নিখুঁত স্কোর করেছে। পাশাপাশি শহরটি পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও সহজে চলাচলের উপযোগী। তবে জেনেভার বাসিন্দারা মনে করেন, তাঁদের শহরের পরিবেশ অন্যান্য শহর থেকে একটু আলাদা। এটি আয়তনে ছোট ও ঘনিষ্ঠভাবে বিন্যস্ত। এখানে নির্ঝঞ্ঝাট থাকা যায় এবং একটি বৈশ্বিক কেন্দ্রে যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকে এর সবই রয়েছে এ শহরে।
সুইজারল্যান্ডের অন্যতম বৈচিত্র্যপূর্ণ শহর জেনেভা। এখানে বাসিন্দাদের ৪০ শতাংশের বেশি বাসিন্দার জন্ম বিদেশে। জেনেভার বাসিন্দা জেমস এফ রয়্যাল বলেন, এ বৈচিত্র্যের সুফল ভোগ করেন এখানকার মানুষ। বিভিন্ন ধরনের খাবার থেকে শুরু করে নানা সাংস্কৃতিক পটভূমি থেকে আসা মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ এখানে মেলে।
লাইভেবিলিটি স্কোরে ৯৬ দশমিক ৬ নম্বর পেয়ে তালিকায় ৬ নম্বরে উঠে এসেছে সিডনি। গত বছর শহরটি ছিল ৭ নম্বরে। সিডনি স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় পূর্ণ ১০০ স্কোর পেয়েছে। পাশাপাশি স্থিতিশীলতায় ৯৫, অবকাঠামোয় ৯৬ দশমিক ৪ এবং সংস্কৃতি ও পরিবেশ বিভাগে ৯৪ দশমিক ৪ নম্বর পেয়েছে।
সূচকে শীর্ষ দশে স্থান পাওয়া একমাত্র এশীয় শহর জাপানের ওসাকা। ৭ নম্বরে থাকা ওসাকা স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় নিখুঁত স্কোর অর্জন করেছে। যদিও শহরটি প্রায়ই আলোঝলমলে রাজধানী টোকিওর ছায়ায় ঢাকা পড়ে। তবে ওসাকায় রয়েছে নিজস্ব ছন্দে চলা এক জীবনধারা এবং সেটাই এখানকার বাসিন্দাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়।
ওসাকায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করেন গ্রাহাম হিল। তিনি ‘ওসাকা সিটি’ নামের একটি রিভিউ ওয়েবসাইট চালান। তিনি বলেন, ওসাকা খুবই উন্নত ও দারুণ এক শহর। আকারে ছোট হলেও শহরটি নিজস্ব এক অনন্য বৈশিষ্ট্যে ভরপুর।
সূচকে ৯৬ নম্বর পেয়ে তালিকায় ৮ নম্বরে উঠে এসেছে অকল্যান্ড। অকল্যান্ড শিক্ষায় পূর্ণ ১০০ স্কোর পেয়েছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবায় ৯৫ দশমিক ৮, স্থিতিশীলতায় ৯৫, অবকাঠামোয় ৯২ দশমিক ৯ এবং সংস্কৃতি ও পরিবেশ বিভাগে ৯৭ দশমিক ৯ নম্বর পেয়েছে।
শীর্ষ ১০–এ স্থান পাওয়া অস্ট্রেলিয়ার তৃতীয় শহর অ্যাডিলেড। এ বছর শহরটি ৯৫ দশমিক ৯ নম্বর পেয়ে তালিকায় ৯ নম্বরে উঠে এসেছে, গত বছর ছিল ১১ নম্বরে। অ্যাডিলেড স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় পূর্ণ ১০০ স্কোর পেয়েছে। এ ছাড়া স্থিতিশীলতায় ৯৫, অবকাঠামোয় ৯৬ দশমিক ৪ এবং সংস্কৃতি ও পরিবেশ বিভাগে ৯১ দশমিক ৪ নম্বর পেয়েছে।
ইনডেক্সে শীর্ষ ১০–এ স্থান পাওয়া উত্তর আমেরিকার একমাত্র শহর কানাডার ভ্যাঙ্কুভার। কানাডার আরেক শহর ক্যালগেরির এ বছর বড় পতন হয়েছে। ২০২৪ সালে ক্যালগেরি পঞ্চম স্থানে ছিল। এ বছর নেমে গেছে ১৮তম স্থানে। মূলত স্বাস্থ্যসেবা সূচকে নম্বর কম পাওয়ায় ক্যালগেরির এ পতন।
তবে ৯৫ দশমিক ৮ নম্বর পেয়ে শীর্ষ ১০–এ স্থান করে নিয়েছে ভ্যাঙ্কুভার। কানাডার শহরটি শিক্ষায় পূর্ণ ১০০ স্কোর পেয়েছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবায় ৯৫ দশমিক ৮, স্থিতিশীলতায় ৯৫, অবকাঠামোয় ৯২ দশমিক ৯ এবং সংস্কৃতি ও পরিবেশ বিভাগে ৯৭ দশমিক ২ নম্বর পেয়েছে।