যুক্তির পর যুক্তি, তারপর প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করা। কোনো পক্ষই ছাড় দিচ্ছে না। বিজয়ী হতে হবে যে! অবশেষে তর্ক-বিতর্ক আর যুক্তির বাহাসে জিতে যায় কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের দলটি। এক গাল হেসে এর দলনেতা জিলা স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আবিদ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলে, ‘প্রায় ছয় মাস লাগল বিজয়ী হতে। আঞ্চলিক পর্বে যখন অংশ নিই, তখন ভেবেছিলাম ভালো করব। তবে চ্যাম্পিয়ন হব, ভাবিনি। অনেক ভালো লাগছে।’ প্রতিযোগিতায় সেরা বিতার্কিকও হয় আবিদ।
আজ শুক্রবার রাজধানীর বেইলি রোডের ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে ছিল ‘পুষ্টি-প্রথম আলো স্কুল বিতর্ক’ উৎসবের চূড়ান্ত পর্ব। দিনব্যাপী এই উৎসবে এবারের বিজয়ী কুষ্টিয়া জিলা স্কুল দল। আবিদসহ দলটির ইশফাক আলম ও সায়েম আহমেদ পেয়েছে সনদ, মেডেল ও ৪০ হাজার টাকা। আর রানার্সআপ হয়েছে জামালপুর জিলা স্কুলের তৌহিদুল ইসলাম, নাসিফুল ইসলাম ও মুহতাসিন মুসান্না। তারা পেয়েছে সনদ, মেডেল ও ২০ হাজার টাকা।
উৎসবে কুইজ প্রতিযোগিতায় জুনিয়র ক্যাটাগরিতে জয়ী হয়েছে সামছুল হক খান স্কুলের শিক্ষার্থী রিতু, পটুয়াখালী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের মাহি আলম, অন্নদা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের আহনাফ তাহমিদ, যশোর কালেক্টরেট স্কুলের পুষ্পিতা রায়, রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিক্রমজিৎ সরকার। আর কুইজের সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে জয়ী হয়েছে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের আহনাফ হাসান, ইবনে তাসলিমা নাসির স্কুল অ্যান্ড কলেজের শাহরীয়ার হোসেন, প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শেখ মারুফা, পিরোজপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের নুসরাত জাহান রিয়াজী, কাজী মহিউদ্দিন মডেল হাইস্কুলের শিক্ষার্থী নিয়াজ মাহমুদ।

দেশজুড়ে বিতর্ক উৎসব ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে টি কে গ্রুপ। এ আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছে প্রথম আলো বন্ধুসভা এবং সম্প্রচার সহায়তায় ছিল নাগরিক টিভি।
‘যোগ দাও যুক্তির মেলায়’ স্লোগানে ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর শুরু হয়েছিল এই উৎসব। ঢাকাসহ ৪০টি জেলা শহরে হয় ৪০টি আঞ্চলিক উৎসব। আঞ্চলিক পর্বের ৩৪টি বিজয়ী দল আজ চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেয়।
কাকডাকা ভোর থেকে উৎসবস্থলে শিক্ষার্থীরা আসতে থাকে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনেক অভিভাবক এবং শিক্ষকও এসেছিলেন। যশোর থেকে দুই মেয়েকে নিয়ে বিতর্ক উৎসবে এসেছেন গৌরাঙ্গ কুমার রায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু সার্টিফিকেট অর্জন করলেই তো চলবে না। পড়ালেখার পাশাপাশি বিতর্ক, গান, নাচ, গণিতে অলিম্পিয়াডে শিক্ষার্থীদের অংশ নিতে হবে। বিতর্ক করলে তো আত্মবিশ্বাস বাড়ে।’ কুমিল্লা থেকে চার শিক্ষার্থীকে সঙ্গে করে উৎসবে এসেছেন জিলা স্কুলের শিক্ষক নাজমুল আবেদীন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা এই উৎসবের জন্য বাড়তি পড়ালেখা করল, অনেক কিছু শিখল, আরও জানার উৎসাহ পেল। নিয়মিত এই আয়োজন হওয়া উচিত।

সকাল ১০টার দিকে জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে উৎসব শুরু হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফেরদৌসী বেগম। এরপর ফেনীর সোনাগাজীর অগ্নিদগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান হত্যাকাণ্ডের নিন্দায় বিতর্ক উৎসবে অংশ নেওয়া বিতার্কিক শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে দুই হাত ওপরে তোলেন।
প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘বিতর্ক প্রতিপক্ষকে শুধু পরাস্ত করার জন্য নয়। আমরা বিতর্ক করব, গান গাইব, লিখব। কারণ, আমরা সত্য জানতে চাই, যুক্তি জানতে চাই। আবার হৃদয়ের কথাও শুনতে চাই। বিতর্কে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠছে।’
অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘বিতর্ক মানে যুক্তির বিরুদ্ধে ইতিবাচক যুদ্ধ। দেশে অনেক সমস্যা আছে। তোমরাই যৌক্তিকভাবে দেশটাকে চালাবে।’ অভিনেতা সিয়াম বলেন, বিতার্কিকদের জীবনে পথ চলতে সুবিধা হয়। জীবনে কমনসেন্স দিয়ে সব কথা সহজেই বলা যায়। অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘তোমরাই দেশের ভবিষ্যৎ। তোমরা পরিবর্তন আনবে যুক্তি দিয়ে। গায়ক ইমরান ‘পোড়ামন ২’ চলচ্চিত্র থেকে তাঁর গাওয়া একটি গান গেয়ে শোনান। টেন মিনিটস স্কুলের আয়মান সাদিক বলেন, ‘তোমরা বিতর্ক করো। কিন্তু তর্ক কোরো না। তর্ক থেকে দূরে থাকো।’

বিতর্ক উৎসবে পুষ্টির পক্ষ থেকে টি কে গ্রুপের পরিচালক (মার্কেটিং) মোহাম্মদ মোফাচ্ছেল হক বলেন, সব ভালো কাজের সঙ্গে পুষ্টি আছে, থাকবে। এমন একটি আয়োজনের স্বপ্ন দেখে পুষ্টি, যা সমগ্র দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে পড়বে।
এরপর বেলা ১১টার দিকে শুরু হয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা। চলে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত। বিচারক হিসেবে ছিলেন ৬৮ জন। প্রতিযোগিতার দুইটি ধাপ পেরিয়ে সব শেষে ছিল আটটি দল। তারপর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলে বিজয়ী হওয়া নিয়ে। একদিকে চলছিল প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে চলছিল স্কুলের মিলনায়তনের মূল মঞ্চে নানা আয়োজন। মূল পর্দায় দেখানো হয় প্রথম আলোর ‘আলোর পথযাত্রী’ প্রদর্শনী ও বিতর্ক উৎসব নিয়ে বানানো একটি তথ্যচিত্র।
এরপর শিক্ষার্থীরা একে একে মঞ্চে এসে বলছিল নিজেদের কথা। কেউ কবিতা আবৃত্তি করে, কেউ গান গেয়ে শোনায়, কেউবা নিজের স্বপ্নে কথা সবাইকে বলে। অনুষ্ঠানস্থলে আবেগঘন পরিবেশ হয় যখন শরীয়তপুরের ইবনে তাসলিমা নাসির স্কুলের শিক্ষার্থী সাবিকুন নাহার মঞ্চে এসে বলে, সে কখনো তার মা-বাবা ও শিক্ষককে ভালোবাসি কথাটি বলেনি। বড় মঞ্চ পেয়ে সে সবার সামনে কথাগুলো বলতে চায়। সে বলার সময় কেঁদে ফেলে। পরে বন্ধুসভার সভাপতি সাবিকুনের মা-বাবা ও শিক্ষককে মঞ্চে ডাকেন। এ সময় সবাই চিৎকার করে মা-বাবা ও শিক্ষককে ভালোবাসার কথা জানায়।
এরপর টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী শাতিল ও মোবাশ্বির মঞ্চে এসে মুখ দিয়ে বিট বক্সের আওয়াজ তুলে শোনায়। বিটের উন্মাদে মুগ্ধ হয়ে উল্লাস করে শিক্ষার্থীরা।
সাংস্কৃতিক পর্বে গান গেয়ে শোনায় ব্যান্ড দল জলের গান, শিল্পী দিনাত জাহান মুন্নী এবং শিশুশিল্পী প্রেরণা ও প্রতীক্ষা।
সন্ধ্যায় শুরু হয় উৎসবের সমাপনী পর্ব। এ সময় টি কে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার বলেন, বিতর্কের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকশিত হয়। শিক্ষার্থীদের জন্য ভবিষ্যতে এই ধরনের প্রতিযোগিতা আরও হবে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফেরদৌসী বেগম বলেন, বিতর্ক প্রাচীনতম সৃজনশীল ও সমাদৃত একটি শিল্প। এটি জ্ঞানের ভান্ডার বাড়ায়, শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে যোগ্য করে তোলে এবং সাহসের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা কথা বলতে শেখে।

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যারা সেরা হয়, তারাই বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে, আগামী দিনে দেশে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করবে। প্রথম আলোর লক্ষ্য একটাই, আমরা দেশের অগ্রগতি দেখতে চাই। আর এই অগ্রগতি আসবে তরুণদের হাত ধরে।’
সমাপনী পর্বে আগত অতিথিরা বিজয়ী শিক্ষার্থীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। দিনব্যাপী এই উৎসবে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর যুব কর্মসূচির সমন্বয়ক মুনির হাসান, অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক কবির বকুল, বন্ধুসভার জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সাইদুজ্জামান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির (ডিইউডিএস) সাবেক সভাপতি প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক রাশেদুল আলম রাসেল। উৎসবস্থলে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজের পক্ষ থেকে একটি চিকিৎসক দল ছিল।