যে পথে ইউক্রেন সীমান্ত পেরিয়ে ৬০০ বাংলাদেশি পোল্যান্ডে এলেন

ইউক্রেন পোল্যান্ড সীমান্তে বাংলাদেশিদের জন্য অপেক্ষা করছেন অনির্বাণ নিয়োগী।
ছবি–সংগৃহীত

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনের পাশের দেশ পোল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন ইউক্রেনে বসবাসরত বিভিন্ন দেশের প্রবাসীরা। অনেক কষ্ট করে সীমান্তে আসার পরও দুর্ভোগের শেষ ছিল না তাঁদের। পদে পদে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে তাঁদের। তবে পোল্যান্ডের বাংলাদেশ মিশন শুরু থেকেই প্রবাসী বাংলাদেশিদের সরিয়ে আনতে তৎপর ছিল।

২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ওয়ার শ দূতাবাস থেকে জানানো হয়, পোল্যান্ড-ইউক্রেন সীমান্ত প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা ছাড়া উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বৈধ পাসপোর্টধারীরা সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে পাসপোর্ট প্রদর্শন করে পোল্যান্ডে ঢুকতে পারবেন। যাঁদের পাসপোর্ট নেই, তাঁরা ট্রাভেল পাস নিয়ে পোল্যান্ডে ঢুকতে পারবেন। প্রত্যেক বাংলাদেশিকে ২ কপি পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি সঙ্গে রাখতে অনুরোধ করা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

ওয়ার শ দূতাবাসকে এই উদ্ধার অভিযানে ভলান্টিয়ার হিসেবে সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশি প্রবাসী প্রকৌশলী পার্থ প্রতীম মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্তের ইউক্রেন অংশে বাংলাদেশিদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছিল। এ সময় বাংলাদেশিদের সহায়তা করতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর অনির্বাণ নিয়োগী একজন সহকর্মীকে নিয়ে ইউক্রেনে প্রবেশ করেন। অনেক দেনদরবারের পর শেষমেশ তিনি ইউক্রেনে ঢুকতে পারেন। তবে সে জন্য সাধারণ নাগরিকদের মতো তাঁকেও অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে।

রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করলে পোল্যান্ড-ইউক্রেনে সীমান্তে মানবেতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ইউক্রেনে বসবাসরত বিশ্বে বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা পোল্যান্ডে প্রবেশের চেষ্টা করেন। ফলে বিভিন্ন সীমান্তে হাজার হাজার লোক জড়ো হন। এর মধ্যে আবার প্রচণ্ড শীত পড়েছে সেখানে। এমন এক অবস্থায় বাংলাদেশি নাগরিকেদের উদ্ধারে পোল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস বাংলাদেশি নাগরিকদের উদ্ধারে বিশেষ অভিযান শুরু করে। কিন্তু তখন কীভাবে কী করা হবে, তা নির্ধারণ করাই দুরূহ। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় সবাই হতবুদ্ধ।

আরও পড়ুন

পোল্যান্ড-ইউক্রেনের মধ্যে আটটি সীমান্ত, ৮০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে তাদের অবস্থান। তবে শেষমেশ দুটি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের আসার ব্যবস্থা করা হয়—মেডিকো আর বুদুমেশ। ওয়ার শ বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর অনির্বাণ নিয়োগীর নেতৃত্বে এই অভিযানের জন্য দল গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যের। ইউক্রেন থেকে যাঁরা পোল্যান্ডে এসেছেন, তাঁরাও পোল্যান্ডের বাংলাদেশ মিশনের প্রশংসা করেছেন।

বিদ্যুৎ সরকার নামের এক প্রবাসী সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, ‘অনেক কাল বাদে একজন ভদ্রলোক বাঙালি (অনির্বাণ নিয়োগী) দেখলাম, যিনি কথার চেয়ে কাজে বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন। সেই সঙ্গে ধন্যবাদ জানাই বাংলাদেশ দূতাবাসের সবাইকে, প্রচলিত প্রথা ভেঙে প্রবাসীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।’

প্রাক্‌-প্রস্তুতিও ছিল

ওয়ার শ দূতাবাস যুদ্ধ শুরুর আগেই রুশ সেনারা যখন ইউক্রেন সীমান্তে অবস্থান নেয়, তখনই সেখানকার বাংলাদেশি নাগরিকদের সরিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু তখন কেউ সাড়া দেননি। এরপর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ওয়ার শ দূতাবাস থেকে যোগাযোগের যে নম্বর দেওয়া হয়, সবাই সেখানে কল করতে শুরু করেন। এত কল গ্রহণ কর্মকর্তাদের পক্ষে অমানবিক হয়ে দাঁড়ায়। তারপরও দূতাবাসের কর্মকর্তারা যথাসাধ্য করার চেষ্টা করেছেন। আবার প্রথম দিকে সীমান্ত এলাকায় ইন্টারনেটও ছিল না। ইন্টারনেট সংযোগ পেতে ২০ কিলোমিটার দূরে যেতে হয়েছে। মেডিকা সীমান্তর ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি থাকেন না। ফলে স্বেচ্ছাসেবীও পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন

মূলত মেডিকা সীমান্ত দিয়েই বাংলাদেশিরা পোল্যান্ডে প্রবেশ করছেন। কিন্তু সেখানে চেকপোস্ট থেকে গাড়িতে উঠতে কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে হয়। এই শীতের মধ্যে যা অত্যন্ত কষ্টকর। ফলে যাঁরা এই কষ্ট স্বীকার করতে চান না, তাঁদের বুদুমেস সীমান্ত দিয়ে পোল্যান্ডে প্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে হাঁটতে হয় না, তল্লাশিচৌকি পেরোনোর পরই বাসে ওঠা যায়।

জানা যায়, এর মধ্যে পাসপোর্টবিহীন কিছু বাংলাদেশিকে পোল্যান্ড বর্ডার গার্ড আটক করলে বর্ডার গার্ড অফিসে গিয়ে প্রত্যেককে বাংলাদেশি নাগরিক বলে শনাক্ত করা হলে তবেই তাঁদের মুক্তির ব্যবস্থা হয়।

গন্তব্য কোথায়

আজ পর্যন্ত প্রায় ৬০০ বাংলাদেশি নাগরিক ইউক্রেন থেকে পোল্যান্ডে এসেছেন। তাঁরা সেখানে ওয়ার শর বাংলাদেশ দূতাবাসের আশ্রয়ে আছেন। পার্থ প্রতীম মজুমদার বলেন, বেশির ভাগ মানুষই দেশে ফিরতে চান না। ইউরোপ এখন সীমান্ত খুলে দিয়েছে। ফলে তাঁরা এখন ভাগ্যের সন্ধানে অন্যান্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আবার অনেকে চেষ্টা করছেন, পোল্যান্ডেই কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না। তবে ছাত্রদের মধ্যে দেশে ফেরার ইচ্ছা আছে।

পার্থ প্রতীম মজুমদার বলেন, এখন আর খুব বেশি বাংলাদেশি সীমান্তের ওপারে নেই। ওয়ার শর বাংলাদেশ দূতাবাস আশা করছে, শিগগিরই তাঁদের সবাইকে নিরাপদে বের করে আনা যাবে।