রাসায়নিকের আগুন নেভানোর প্রশিক্ষণ ছিল না তাঁদের

রাসায়নিকের আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের আছে ‘হ্যাজম্যাট’ ইউনিট। এতে রয়েছে দেশ–বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১৫০ জন ফায়ারকর্মী।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্য মো. রানা মিয়া, মনিরুজ্জামান, আলাউদ্দিন, মো. শাকিল তরফদার, মিঠু দেওয়ান, রমজানুল ইসলাম, নিপন চাকমা, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মো. ইমরান হোসেন মজুমদার।
ছবি: ফায়ার সার্ভিস

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগার খবর পেয়ে নিকটস্থ দুটি ফায়ার স্টেশন থেকে ঘটনাস্থলে যে ফায়ারকর্মীরা গিয়েছিলেন, তাঁদের কারোরই রাসায়নিকের আগুন নেভানোর প্রশিক্ষণ ছিল না। রাসায়নিকের আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষিত ১৫০ জন ফায়ারকর্মী রয়েছেন। তাঁদের কাজের জন্য রয়েছে বিশেষ সরঞ্জামাদি ও পোশাক।

চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে এমন প্রশিক্ষিত ১১ জন ফায়ারকর্মী থাকলেও শিল্প এলাকা সীতাকুণ্ড ও পাশের কুমিরা ফায়ার স্টেশনে এ ধরনের প্রশিক্ষিত কেউ ছিলেন না। এ কারণেই এত হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা।

তাঁরা বলছেন, রাসায়নিকের আগুন নেভানোর জন্য বিদেশে প্রশিক্ষিত কর্মীদের নিয়ে ‘হ্যাজম্যাট’ নামের একটি ইউনিট রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের। এ ধরনের আগুনের ক্ষেত্রে ‘কেমিক্যাল প্রটেকশন স্যুট’ নামের বিশেষ পোশাক পরে কাজ করেন তাঁরা। সদর দপ্তরসহ বিভাগীয় শহরে রাখা হয় এই দলের সদস্যদের। নিয়ম অনুযায়ী, প্রথমে ঘটনাস্থলে গিয়ে নিকটস্থ ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা সাধারণ আগুন হলে নিজে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করবেন। তবে আগুন যদি রাসায়নিক হয়, তাহলে অবশ্যই প্রশিক্ষিত হ্যাজম্যাট ইউনিটকে খবর দেবেন।

আগুন নিয়ন্ত্রণের সময় নিখোঁজ হন ফায়ার সার্ভিসের সদস্য শফিউল ইসলাম, রবিউল ইসলাম ও ফরিদুজ্জামান
ছবি: সংগৃহীত

কর্মকর্তারা বলেন, সীতাকুণ্ডে ঘটেছে উল্টোটি। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের নিকটস্থ দুই স্টেশনের কর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। সাধারণ আগুন ভেবে খুব কাছে গিয়ে কাজ শুরু করেন। বিস্ফোরণের পর গণমাধ্যমে খবর পেয়ে সেখানে যান প্রশিক্ষিত হ্যাজম্যাট দলের সদস্যরা। অবশ্য ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, এমন তথ্য না জানানোর কারণে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে থাকা হ্যাজম্যাট দলকে খবর না দিয়ে সাধারণ আগুন নেভানোর সরঞ্জামাদি দিয়েই কাজ শুরু করেন ফায়ারকর্মীরা। আগুন নেভানোর ভুল কৌশল প্রয়োগের কারণে রাসায়নিক বিস্ফোরণ হয়। এতে একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এযাবৎকালের সবচেয়ে বেশি ফায়ারকর্মী মারা যান।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুনঃ

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, রাসায়নিকের আগুন নেভানোর যে ধরনের প্রশিক্ষণ থাকা দরকার, তা খুব অল্প ফায়ারকর্মীর রয়েছে। তাই সদর দপ্তরসহ বিভাগীয় শহরে রাখা হয় হ্যাজম্যাট দলের সদস্যদের। তবে এ ধরনের আগুনের ক্ষেত্রে খবর পেয়ে এসে কাজ শুরু করতে করতে বড় দুর্ঘটনা ঘটে যায়। তিনি বলেন, শিল্পকারখানার আশপাশ এলাকার সব ফায়ার স্টেশনে প্রশিক্ষিত লোকবল রাখতে পারলে আগুনে ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের সংখ্যা কমানো যাবে।

সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে শনিবার রাতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে ফায়ার সার্ভিসের ১২ জনসহ মোট ৪১ জনের মৃত্যু হয়।

আগুন নেভাতে বিশেষ ধরনের পোশাক পড়ে তৈরি হচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা
ছবি: জুয়েল শীল

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (প্রশিক্ষণ) মনির হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাসায়নিকের আগুন নেভানোর জন্য ১৫০ জন ফায়ারকর্মীকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে। তাঁরা জানেন, কোথাও আগুন লাগলে রাসায়নিক পদার্থ

শনাক্ত করে নিজেকে রক্ষা করে কীভাবে কাজ করতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যদি জানতে পারতাম এটি রাসায়নিকের আগুন, তাহলে আমাদের ফায়ারকর্মীরা এত কাছে গিয়ে এভাবে কাজ করত না।’

সব আগুন এক পদ্ধতিতে নেভানো যায় না উল্লেখ করে মনির হোসেন বলেন, বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুন লাগলে যেমন দ্রুত মেইন সুইচ বন্ধ করে দিতে হয়, তেমনি রাসায়নিক কোন পদার্থ থেকে আগুন লাগলে প্রথম চেষ্টা করতে হয় পানি দিয়ে সেটা ঠান্ডা রাখতে। এ ক্ষেত্রে পানি ছিটাতে হয় চারাগাছে পানি দেওয়ার মতো করে, যাতে ছিদ্র হয়ে ছড়িয়ে না পড়ে। পাশাপাশি সম্ভব হলে রাসায়নিক পদার্থ অন্য সবকিছু থেকে আলাদা করে ফেলতে হয়। তাহলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে না।