যে কারণে কম সময়ে ছাড়া পেল এমভি আবদুল্লাহ

বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহছবি: সংগৃহীত

ছিনতাই হওয়ার পর প্রায় এক মাসের মাথায় মুক্তিপণ দিয়ে সোমালিয়ার উপকূল থেকে জিম্মি জাহাজ ছাড়িয়ে আনার নজির খুবই কম। সে তুলনায় এমভি আবদুল্লাহ দ্রুত সময়ে মুক্ত হয়েছে। জাহাজটির মালিকপক্ষ কেএসআরএম গ্রুপের আগের অভিজ্ঞতা ও দস্যুদের ওপর চাপ বাড়ায় সমঝোতার প্রক্রিয়া দ্রুত হয়েছে বলে মনে করেন সমঝোতার প্রক্রিয়ায় থাকা কর্মকর্তারা।

সোমালিয়ার দস্যুরা ভারত মহাসাগর থেকে এমভি আবদুল্লাহ জিম্মি করে ১২ মার্চ। মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজটি ছাড়া পায় শনিবার দিবাগত রাত ১২টা ৮ মিনিটে, অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল প্রথম প্রহরে। এ হিসাবে জিম্মি করার ৩২ দিন পর জাহাজটি মুক্তি পেয়েছে।
এর আগে ২০১০ সালে কেএসআরএম গ্রুপের আরেকটি জাহাজ এমভি জাহান মণি ছিনতাই করেছিল সোমালিয়ার দস্যুরা। ওই জাহাজ উদ্ধার করতে ৯৯ দিন সময় লেগেছিল।

এমভি আবদুল্লাহর আগে সর্বশেষ মুক্তিপণ ছাড়াই বুলগেরিয়ার জাহাজ এমভি রুয়েনকে উদ্ধার করা হয়। এমভি রুয়েন কমান্ডো অভিযান চালিয়ে ভারতীয় নৌবাহিনী উদ্ধার করে গত ১৬ মার্চ। তিন মাস জিম্মিদশায় ছিল জাহাজটি। এর আগে ইসরায়েলের একটি জাহাজ ছিনতাই করলেও সফল হয়নি দস্যুরা। এক দিনের মাথায় আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী জাহাজটি উদ্ধার করে।

সোমালিয়ার উপকূলে দস্যুতা চরমে ওঠে ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত। ২০১২ সালের পর দস্যুতা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। ২০১৭ সালে দুটি জাহাজ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও উদ্ধার করা হয়। দস্যুতার হার যখন বেশি ছিল, তখনো গড়ে প্রতিটি জাহাজ উদ্ধারে কয়েক মাস সময় লেগেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ওয়ান আর্থ ফিউচার ফাউন্ডেশন এক দশক আগে ‘ওশান্স বিয়ন্ড পাইরেসি’ প্রকল্পের আওতায় সোমালিয়া উপকূলে দস্যুতা নিয়ে সমীক্ষা চালায়। সংস্থাটির ‘দ্য ইকোনমিক কস্ট অব সোমালি পাইরেসি ২০১২’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালে ৩১টি জাহাজ মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছিল। প্রতিটি জাহাজ ছাড়া পেতে গড় সময় লেগেছে ১৭৮ দিন। ২০১২ সালে আটটি জাহাজ মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে গড়ে সময় লেগেছে ৩১৬ দিন।

আরও পড়ুন

কীভাবে এত দ্রুত জাহাজটি মুক্ত করা সম্ভব হলো-জানতে চাইলে কেএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমভি আবদুল্লাহ ছিনতাইয়ের পর প্রথম দিন থেকেই আমরা কাজ শুরু করি। নাবিকদের দ্রুত নিরাপদে ফেরানোই ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য। আগের অভিজ্ঞতা থাকায় দস্যুদের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি সমঝোতার প্রক্রিয়াগুলোও আমরা গুছিয়ে এনেছিলাম। সোমালিয়ার উপকূলে দস্যুতার প্রবণতা বাড়ার পর আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর তৎপরতা বাড়ায় দস্যুরাও চাপে ছিল। সরকারও নাবিকদের উদ্ধারে আমাদের সব রকমের সহযোগিতা করেছে। এতে খুব দ্রুত উদ্ধার সম্ভব হয়েছে।’

কেএসআরএম গ্রুপ ও বাণিজ্যিক জাহাজের দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমভি জাহান মণির জিম্মির ঘটনার সময় দস্যুদের হাতে অনেকগুলো জাহাজ ছিল। সে সময় একের পর এক জাহাজ মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া হচ্ছিল। দস্যুদের হাতে নগদ অর্থের প্রবাহ ছিল। ফলে মুক্তিপণের সমঝোতায় খুব তাড়া ছিল না দস্যুদের। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। দস্যুদের হাতে নগদ অর্থ নেই। গত নভেম্বর থেকে বাণিজ্যিক জাহাজ ছিনতাই করলেও মুক্তিপণ ছাড়াই দুটি উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ শুধু বাংলাদেশি এমভি আবদুল্লাহ জিম্মি ছিল। ফলে দস্যুরাও যত দ্রুত সম্ভব নগদ অর্থ পাওয়ার চেষ্টায় ছিল। এ কারণে মালিকপক্ষ ও দস্যু-দুই পক্ষের বোঝাপড়া দ্রুত হয়েছে।

আরও পড়ুন

সোমালিয়ায় জিম্মি বাণিজ্যিক জাহাজের নাবিকদের দীর্ঘ সময় জিম্মি থাকার ঘটনা এমভি আলবেদো জাহাজের। মালয়েশিয়ার এই জাহাজের নাবিকদের ২০১০ সালের ২৬ নভেম্বর ছিনতাই করেছিল দস্যুরা। ২০১৩ সালের ৭ জুলাই জাহাজটি ডুবে যায়। ধাপে ধাপে নাবিকেরা সর্বশেষ মুক্তি পেয়েছিল ২০১৪ সালের ৭ জুন। অর্থাৎ এই জাহাজের নাবিকেরা মুক্তি পেতে ১ হাজার ২৮০ দিন বা সাড়ে ৩ বছর সময় লেগেছিল।

বাণিজ্যিক জাহাজ ছাড়া দীর্ঘ সময় জিম্মি রাখার ঘটনা ঘটেছিল একটি মাছ ধরার জাহাজের। মাছ ধরার জাহাজটির নাম এফবি প্রান্তলয়-১২। জাতিসংঘের মাদক এবং অপরাধবিষয়ক সংস্থা (ইউএনওডিসি) ২০১৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, সোমালিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে জিম্মি রাখার ঘটনা এটি। ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল ছিনতাই হওয়া মাছ ধরার জাহাজটি মুক্ত হয়েছিল ২০১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। জাহাজটির ২৪ জন নাবিকের মধ্যে ৬ জন নানা পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে মারা যান। মিয়ানমারের ১৪ জন নাবিক মুক্তি পান ২০১১ সালে। সর্বশেষ ৪ জন মুক্তি পান ২০১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ এই ৪ জন মুক্তি পেয়েছেন ৪ বছর ৩১৩ দিনে বা ১ হাজার ৭৭৪ দিনে।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এক দশক আগের চেয়ে এখনকার সোমালিয়ার উপকূলের পরিস্থিতি ভিন্ন। জলদস্যুদের হাতে ছিনতাই হওয়া জাহাজের সংখ্যা ছিল কম। দস্যুদের অর্থের প্রয়োজন ছিল বেশি। আবার জাহাজটির মালিকপক্ষ কেএসআরএম গ্রুপও দ্রুত সমঝোতা করতে চেয়েছিল। ফলে আগের ঘটনাগুলোর চেয়ে কম সময়ে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিকদের মুক্ত করে আনা সম্ভব হয়।

আরও পড়ুন