ইসি কি ডিসি-এসপিদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল
ফাইল ছবি

একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দেশের সংবিধান ও আইন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হাতে প্রচুর ক্ষমতা দিয়েছে।

ইসির ক্ষমতার ব্যাপকতা বোঝাতে কেউ কেউ বলে থাকেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনে সবকিছু করতে পারে।

বাস্তবতা হলো, ইসির এই ক্ষমতার অনেকটাই প্রয়োগ করেন ভোটের মাঠে তাদের প্রতিনিধি বা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ ক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, পুলিশ-প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।

সাধারণত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকেন জেলা প্রশাসকেরা। নির্বাচনের পরিবেশ কতটুকু অনুকূলে থাকবে, তার অনেকটাই নির্ভর করে প্রশাসন ও পুলিশের ওপর। কারণ, মাঠের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকেন তাঁরা। আর তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করে নির্বাচন কমিশন।

যদি কেউ ইসির নিয়ন্ত্রণে না থাকেন, ইসির নির্দেশ অমান্য করেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আইনি সুযোগ আছে।

আরও পড়ুন

কিন্তু অন্তত গত দুটি নির্বাচন কমিশনের আমলে দেখা গেছে, ভোটের মাঠে পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর ইসির কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।

অবশ্য ইসি পুলিশ ও প্রশাসনকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে আদৌ ইচ্ছুক ছিল কি না, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। কারণ, ইসির তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

পুলিশ ও প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা নির্বাচনী অপরাধ করেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই বললে চলে।

ফলে নানাভাবে নির্বাচনী অপরাধে জড়িত হওয়া বা অপরাধে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সহায়তা করা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে অনেকটা ‘স্বাভাবিক’ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরখানেকের বেশি সময় আগে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন পুলিশ ও প্রশাসনকে একটি কঠোর বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বলা যায়, শুরুতেই তারা হোঁচট খেয়েছে।

আরও পড়ুন

জেলা পরিষদ নির্বাচন ও অন্যান্য নির্বাচন সামনে রেখে সব জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের (এসপি) ৮ অক্টোবরের ঢাকায় ডেকেছিল হাবিবুল আউয়াল কমিশন।

ইসি যে বার্তাটি দিতে চেয়েছে, সেটি হলো নির্বাচনের মাঠে দলীয় কর্মী হিসেবে নয়, সরকারি কর্মচারী হিসেবে প্রশাসন ও পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

বৈঠকে ডিসিদের নিরপেক্ষতা ও আর্থিক সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বক্তব্য রেখেছিলেন নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান। তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদে ডিসিরা হইচই করেছিলেন। এমনকি তাঁরা আনিছুর রহমানের বক্তব্য শুনতেও রাজি ছিলেন না। যে কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি আর বক্তব্যই দেননি।

তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, ইসি কি ডিসিদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে?

বিব্রতকর ঘটনাটির মাত্র তিন দিন পর ১২ অক্টোবর ছিল গাইবান্ধা-৫ আসনে উপনির্বাচন। সেখানে ভোটের গোপনীয়তা রক্ষা করা যায়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে পুরো উপনির্বাচনই বন্ধ করে দেয় ইসি।

নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়াটা ছিল ইসির ‘শেষ অস্ত্র’। কিন্তু ইসিকে কেন শেষ অস্ত্রটিই ব্যবহার করতে হলো?

আরও পড়ুন

আইন বলছে, নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ইসির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থেকে কাজ করবেন।

কিন্তু গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে কি পুলিশ ও প্রশাসন ইসির নিয়ন্ত্রণে ছিল? তারা কি কমিশনের নির্দেশ মেনে চলেছে?

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) বক্তব্যে ইসির অসহায়ত্বই ফুটে ওঠে। ভোটের দিনের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে গত বৃহস্পতিবার কাজী হাবিবুল আউয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রিটার্নিং অফিসার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সঙ্গে টেলিফোনে তিনি ও নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা কথা বলেছেন। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।

গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে পুলিশ ও প্রশাসন ইসির কতটুকু নিয়ন্ত্রণে ছিল, তা সিইসির এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায়। এটি ছিল একটি আসনের উপনির্বাচন। সেখানেই এই অবস্থা! জাতীয় নির্বাচনে একই দিনে ভোট হবে ৩০০ সংসদীয় আসনে। তাহলে তখন ইসি কী করবে?

আরও পড়ুন

এমনিতে পুলিশ ও প্রশাসন সরাসরি সরকারের অধীন, নির্বাচন কমিশনের নয়। তবে সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারী প্রয়োজন হবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করলে রাষ্ট্রপতি সেরূপ কর্মচারীর ব্যবস্থা করবেন। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য।

জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন যেকোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় যেকোনো দায়িত্ব পালন বা সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দিতে পারবে।

সংবিধান ও আইনে এসব কথা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। তা সবশেষ গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনেও দেখা গেল।

গাইবান্ধার ডিসি এই নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন না। কিন্তু ডিসি-এসপিসহ সবার সাংবিধানিক কর্তব্য ইসিকে সহায়তা করা। তবে ইসি তাঁদের কাছ থেকে কতটুকু সহায়তা পেয়েছে, তা সিইসির বক্তব্য থেকে আঁচ করা যায়।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত জুলাইয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিল নির্বাচন কমিশন। সেখানে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়েই বেশির ভাগ দলের উদ্বেগ ছিল। বেশির ভাগ দল নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থায় কোনো না কোনো পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দিয়েছিল।

আরও পড়ুন

সংলাপে ১০টি দল নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ বা সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দেয়। আর ১২টি দল নির্বাচনকালে সরকারের ক্ষমতা সীমিত করে ইসির ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেছিল। তারা নির্বাচনের সময় জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু মন্ত্রণালয় সরাসরি ইসির অধীন নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও সাম্যবাদী দলও এ ধরনের প্রস্তাব দিয়েছিল। অবশ্য ইসি চাইলেও এটি করতে পারবে না। কারণ, এটি করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। ইসিও পরিষ্কার করে বলেছে, সংবিধান–সম্পর্কিত বিষয়ে তাদের কিছু করার নেই।

এখন দেখার বিষয় হলো, শুরুতে হোঁচট খেয়ে ইসি কী করে! তারা কি পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নিয়ে একটি বার্তা দেবে? জাতীয় নির্বাচনের সময় গুরুত্বপূর্ণ কিছু মন্ত্রণালয় সরাসরি ইসির অধীন আনার প্রস্তাব দেবে? নাকি পুলিশ-প্রশাসনকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল কী হবে, তা পরিষ্কার করবে।

আরও পড়ুন