শুধু খননকাজ করছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, গবেষণায় পিছিয়ে

লালবাগ কেল্লার হাম্মামখানা সংস্কারের সময় রং বদলানোর অভিযোগ ওঠে
প্রথম আলো ফাইল ছবি

দেশের পুরাকীর্তির সন্ধান করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এসব পুরাকীর্তি সংরক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরা অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তবে সংরক্ষণের অব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি গবেষণায়ও পিছিয়ে রয়েছে দেড় শ বছরে পুরোনো এ অধিদপ্তর। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মূলত খননকাজেই সীমাবদ্ধ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকাণ্ড।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় আছে দেশের ৫১৭টি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। সারা দেশে মোট ২২টি জাদুঘর পরিচালিত হয় এ অধিদপ্তর থেকে। প্রতিদিন সেসব জাদুঘর ঘুরে দেখেন শত শত দর্শনার্থী। তাঁরা জাদুঘরে সংরক্ষিত নানা প্রত্নবস্তু ও এ-সংক্রান্ত তথ্য দেখে ইতিহাসের ধারণা পান। এই ইতিহাস যথাযথভাবে তুলে ধরার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অধিদপ্তরের।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে সম্প্রতি কথা হয় বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন জেলার দর্শনার্থীদের সঙ্গে। তাতে উঠে এসেছে গবেষণার ঘাটতির কারণে প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ না হওয়ার তথ্য। প্রদর্শনের দুর্বলতা ও সংরক্ষণের অব্যবস্থাপনা আছে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোয়। কিছু জায়গা বেদখল হওয়ার অভিযোগ আছে।

তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের লোকবলের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া প্রচারের কাজে পর্যটন করপোরেশনকেও এগিয়ে আসতে হবে। দপ্তরের জনবলের অধিকাংশ খননকাজের সঙ্গে যুক্ত রাখতে হয়।

অধিদপ্তরের কাজ শুধু বড় বড় স্থাপত্যের জন্য খনন নয়। খনন করে পাওয়া মৃৎপাত্র, দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্রের মতো প্রত্নবস্তুগুলো নিয়ে তাদের গবেষণা করতে হবে। সেই সময়ের সাধারণ মানুষের জীবনযাপন ও সভ্যতা সম্পর্কে জানতে এটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
জয়ন্ত সিংহ রয়, চেয়ারম্যান, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্রদর্শন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ

ধারণা করা হয়, বরেন্দ্র রাজ্যের পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল ৭৮১ থেকে ৮২১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তৈরি করেছিলেন পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার। অর্থাৎ বিহারটি ১ হাজার ২০০ বছরে পুরোনো। বগুড়ার মহাস্থানগড় অবশ্য আরও পুরোনো। উত্তরাঞ্চলের এ দুটি স্থানই এই ভূখণ্ডের প্রাচীনকালের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। এর মধ্যে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে ১৯৮৫ সালে।

প্রতিদিন শত শত পর্যটক উপস্থিত হন এসব স্থানে। সেখানে কী দেখেন, কী জানতে পারছেন, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল কয়েক দর্শনার্থীর কাছে। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাজশাহীর বিভিন্ন জাদুঘর ঘুরে দেখেন বুলবুল ললিতকলার শিক্ষক ও লেখক সাফিয়া খন্দকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন ‘বহু শতাব্দীর পুরোনো ইতিহাস দেখতেই গিয়েছিলাম। মহাস্থানগড় জাদুঘরের ভেতরের ভাঙাচোরা মূর্তির খণ্ডাংশগুলো আগ্রহ বাড়িয়েছে, আবার হতাশও করেছে। কোনো তথ্য নেই।’

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মোগল স্থাপত্য বড় কাটরার একটি অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি মহাস্থানগড় ও পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ঘুরে দেখেন বগুড়ার বাসিন্দা কবি ও প্রাবন্ধিক বজলুল করিম বাহার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘মহাস্থানগড়ের কয়েকটি জায়গায় সীমানা বেদখল হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। জমি কর্তৃপক্ষ সহজে ফেরত নিতে পারছে না তথ্য–প্রমাণের অভাবে। এখানকার দর্শনীয় সবকিছু আছে জাদুঘরে। তবে সেখানকার অবস্থা করুণ।’

তুলনামূলকভাবে নওগাঁর পাহাড়পুরের অবস্থা ভালো। পাহাড়পুর বিহার জাদুঘরের কিউরেটর মো. ফজলুল করিম প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, প্রতিদিন গড়ে পাঁচ শতাধিক দর্শনার্থী আসেন। ছুটির দিনে তা হাজার অতিক্রম করে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এখান থেকে টিকিট বিক্রি করে আয় হয়েছে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ টাকা।

তবে এখানেও আছে প্রত্নতত্ত্বের সঙ্গে তথ্য না থাকার অভিযোগ। প্রথম আলোর নওগাঁ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, প্রত্নতত্ত্বগুলোর পরিচিতিতে ইংরেজিতে ইতিহাস লেখা নেই। এ কারণে বিদেশি পর্যটকদের জন্য বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত এই প্রত্নস্থান সম্পর্কে জানাবোঝা কঠিন। কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানেই এ পর্যন্ত গাইডের ব্যবস্থা করা হয়নি।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় আছে দেশের ৫১৭টি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। সারা দেশে মোট ২২টি জাদুঘর পরিচালিত হয় এ অধিদপ্তর থেকে। প্রতিদিন সেসব জাদুঘর ঘুরে দেখেন শত শত দর্শনার্থী। তাঁরা জাদুঘরে সংরক্ষিত নানা প্রত্নবস্তু ও এ-সংক্রান্ত তথ্য দেখে ইতিহাসের ধারণা পান। এই ইতিহাস যথাযথভাবে তুলে ধরার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অধিদপ্তরের।

শ্রমিক দিয়ে চলে খননকাজ

জনশ্রুতি আছে, চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে দেয়াঙ পাহাড়ের বিশ্বমুড়া নামক জায়গায় আরাকান রাজা বিক্রমের বাড়ি ছিল। সেখানে মেঝে খুঁড়ে পাওয়া গেছে হাজার বছর আগের ইটের গাঁথুনিতে তৈরি দেয়াল ও মেঝে। চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ‘পণ্ডিতের ভিটা’ নামক প্রত্নতত্ত্ব খননের কাজ।

এখানকার খননকাজের দায়িত্বে রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক কার্যালয়।

খননকাজে দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘হ্যারিসমেটিক (ছয় বর্গফুট করে খনন) পদ্ধতিতে খননকাজ চলছে। ১০ দক্ষ শ্রমিকসহ মোট ২৫ জন এখানে কাজ করছেন। দক্ষ শ্রমিকেরা মহাস্থানগড়ের খননকাজেও যুক্ত ছিলেন। অন্যরা সাধারণ শ্রমিক।’

বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে মোট ১০ থেকে ১২টি খননকাজ চলে অধিদপ্তরের। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রত্নতত্ত্ব খনন ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান পরিদর্শনকাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তবে দেশের কোনো স্থানের খননকাজেই এ পর্যন্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীদের যুক্ত করতে পারেনি অধিদপ্তর।

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারিতে তোলা
প্রথম আলো ফাইল ছবি

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, খননের সময় শুধু নির্দিষ্ট প্রত্নবস্তুটি লক্ষ্য করে খনন শেষ হয়। ইকোলজিক্যাল (পারিপার্শ্বিক নমুনা) সংগ্রহ হয় না। যেমন মাটির তলায় প্রত্নবস্তুর পাওয়ার আগেই সেখানকার কার্বন পরীক্ষা, সেখান থেকে পাওয়া শস্য বা প্রত্নবস্তুর নমুনা সংগ্রহ হয় না। খননকাজে প্রয়োজনীয় সেন্সর মেশিন পর্যন্ত নেই এই অধিদপ্তরের। উদ্ধার করা প্রত্নবস্তুগুলো থেকে যাচ্ছে বিভিন্ন জাদুঘরের সংরক্ষণকক্ষে, যেগুলো নিয়ে না হচ্ছে গবেষণা, না জানতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

জানতে চাইলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক চন্দন কুমার দে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের প্রত্নতত্ত্ব ব্যবস্থাপনা গত ১৫ বছরে অনেকটা উন্নত হয়েছে। কিন্তু অধিদপ্তরে জনবল খুবই কম।

পরিচালকের পদই তৈরি হয়নি। একই ব্যক্তিকে খননকাজের তদারকি, সংরক্ষণ, সংস্কারের দেখাশোনা করতে হয়। তাঁকেই প্রতিবেদন লিখতে হয়। ফলে গবেষণার কাজ যেভাবে হওয়া উচিত ছিল তেমন হচ্ছে না, এটা সত্যি। খননকাজ যাঁরা করেন, তাঁরা দক্ষ শ্রমিক। বহু বছর ধরে তাঁরা বিভিন্ন স্থানে খননকাজ করে আসছেন।’

চন্দন কুমার দে আরও বলেন, ইন্টার্নশিপ নীতিমালার আলোকে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত করা হবে। সেই প্রক্রিয়া চলছে।

সংস্কারে ‘গাফিলতি’, জায়গা দখলের অভিযোগ

অধিদপ্তর বছরজুড়েই নানা জায়গায় যৌথভাবে অথবা নিজস্ব দায়িত্বে সংস্কারের কাজ করে থাকে।

বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ তৈরির স্থাপত্যে তুঘলক স্থাপত্যের বিশেষ প্রভাব পেয়েছেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। এটি বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে ১৯৮৫ সালে। কয়েক স্তরে সংস্কার করা হয়েছে এই স্থাপত্যের। এই মসজিদকে ভার্চ্যুয়াল মিউজিয়াম তৃতীয় মাত্রার (থ্রিডি) ভার্চ্যুয়াল রিয়্যালিটিতে তৈরি করেছেন। ফলে, দর্শনার্থীরা চাইলে ঘরে বসেও দেখতে পারবেন। তবু সেখানে সশরীর পর্যটক আসায় ভাটা পড়েনি। চলতি বছরে সেখানকার প্রবেশমূল্য বাড়ানো হয়েছে।

তবে ষাটগম্বুজ মসজিদের সংস্কারের মান নিয়ে অভিযোগ আছে। বাগেরহাটের লেখক ও অনুবাদক মোরশেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মসজিদের পশ্চিম মিনারে সত্তরের দশকে পাথরে খোদাই করা কাজ স্পষ্ট দেখেছি, যা এখন নেই। সংস্কারের পর দেখা যাচ্ছে, নিচে এক ফুট পুরোনো ইট রেখে ওপরে সব নতুন ইট ব্যবহার করে সংস্কার হয়েছে। খুলনা-বাগেরহাট সংযোগ সড়কটা নিদর্শনের গা ঘেঁষে যাওয়ায় বড় কোনো বাহন গেলেই মসজিদ কেঁপে ওঠে।’

কয়েক বছর ধরে খননকাজ শুরু হয়েছে মসজিদের কাছে খানজাহান আলীর বসতভিটায়। প্রথম আলোর বাগেরহাট প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কোনো বেড়া বা সীমানা নির্ধারণ না করে দেওয়ায় উন্মুক্ত অবস্থায় থাকে। স্থানীয় ব্যক্তিদের কেউ কেউ সেখানকার ইট খুলে নিয়ে যায়। খননস্থান ঢেকে না রাখায় বৃষ্টি এলে মাটি ধুয়ে যায়।

বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে মোট ১০ থেকে ১২টি খননকাজ চলে অধিদপ্তরের। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রত্নতত্ত্ব খনন ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান পরিদর্শনকাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তবে দেশের কোনো স্থানের খননকাজেই এ পর্যন্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীদের যুক্ত করতে পারেনি অধিদপ্তর।

এদিকে পুরান ঢাকায় অবস্থিত লালবাগ কেল্লার হাম্মামখানা সংস্কারের সময় রং বদলানোর অভিযোগ ওঠে। তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বলছে, মার্কিন দূতাবাসের সহযোগিতায় সম্পন্ন হওয়া এই সংস্কারকাজে যথাসম্ভব আগের ধারা রেখেই হয়েছে। চুন-সুরকি ব্যবহার করা হয়নি শেওলা জমবে বলে। নতুন কোনো রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়নি। ইটের রঙের জন্যই চকচকে দেখাচ্ছে।

এ ছাড়া মুঘল স্থাপত্য বড় কাটরা ও ছোট কাটরার অবৈধ জমি দখল নিয়ে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দুই স্থাপনার চারপাশেই বেড়ে চলেছে দোকান ও বসতির সংখ্যা, যা সহজে উদ্ধার করতে পারছে না অধিদপ্তর।

পুরান ঢাকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণ নিয়ে অবহেলার অভিযোগ পুরোনো হলেও নতুন প্রশ্ন এখন ঐতিহাসিক স্থাপনার প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে। এ নিয়ে মামলা চলছে পাঁচ বছর। বেসরকারি সংস্থা আরবান স্টাডি গ্রুপ ২ হাজার ২০০ বাড়িকে প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ উল্লেখ করে আদালতে তালিকা দিলেও মাঠপর্যায়ের জরিপ শেষে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দাবি, এমন বাড়ির চূড়ান্ত সংখ্যা হতে পারে ২০ থেকে ২২টি।

আরবান স্টাডি গ্রুপের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে পুরান ঢাকার ২ হাজার ২০০ বাড়ি অক্ষত রেখে বাড়িগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য নির্ণয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে আদেশ দেন হাইকোর্ট। এখনো চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে পারেনি অধিদপ্তর।

এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক চন্দন কুমার দে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরান ঢাকার ২ হাজার ২০০ বাড়ির অনেকগুলোরই বাস্তব অস্তিত্ব নেই। কিছু ভবন আছে, যেগুলো কোনো সূত্রেই ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার উপযুক্ত নয়।’ তিনি আরও বলেন, তাঁরা কমিটি করে তিন মাস পরপর প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। শিগগিরই চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

বাগেরহাটের ঐতিহ্যবাহী ষাটগম্বুজ মসজিদ
ফাইল ছবি

শুধু খননের প্রতিবেদন

ক্যাটালগ, খনন প্রতিবেদনসহ মোট ২২টি বইয়ের সম্প্রতি ই-বুক তৈরি করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। যে কেউ অনলাইন থেকে বইগুলো পড়তে পারবেন। সম্প্রতি বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, দেশের এমন সম্ভাবনাময় সব প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের চূড়ান্ত তালিকা নিয়ে ‘আপডেটিং দ্য ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ টেনটেটিভ লিস্ট অব বাংলাদেশ টোয়েন্টি টোয়েন্টি ওয়ান’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছে তারা।

প্রত্নচর্চা নিয়ে এখান থেকে প্রকাশিত হয় ধারাবাহিক সাময়িকী। তবে ২০২৩ সালের জুনে প্রকাশিত সাময়িকীর সংখ্যা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২৮ পৃষ্ঠার সবটাই বিভিন্ন প্রকল্প, কর্মসূচি ও দিবস পালনের কার্যাবলির বিবরণ। গবেষণামূলক কোনো প্রতিবেদন নেই এতে।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতিবছর সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে গবেষণামূলক বই প্রকাশের একটি সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এ সংখ্যা চলতি বছরে কত, তা জানাতে পারেনি প্রকাশনা শাখা।

প্রকাশনা বিভাগের উপপরিচালক রাখী দাসের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন ‘প্রতিবছর বাজেট ও কাজ অনুযায়ী সংখ্যা পরিবর্তিত হয়। চলতি বছর কয়টি করে গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করার কথা, তা কাগজ দেখে বলতে হবে। গত পাঁচ থেকে ছয় বছরের মধ্যে ষাটগম্বুজ মসজিদ ও লালবাগ কেল্লা নিয়ে গবেষণামূলক বই প্রকাশিত হয়েছে। খননকাজের প্রতিবেদন ও দর্শনার্থীদের জন্য তৈরি ব্রোশিওর গবেষণাকাজেরই অংশ।’

আরও পড়ুন

গবেষণায় গুরুত্ব দিতে হবে

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তাঁর ‘বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইয়ের ভূমিকায় ১৯৮৪ সালে লিখেছিলেন, এ দেশের পুরাকীর্তি নিয়ে কিছু কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। কিন্তু বাংলা ভাষায় সমগ্র দেশের প্রত্নসম্পদ নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি, যা থেকে সাধারণ পাঠক মাতৃভাষার মাধ্যমে নিজের দেশের অতীত কীর্তি সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা করতে পারেন।’

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কার্যাবলিতে উল্লেখ আছে, ‘পুরাকীর্তির সংগ্রহ এবং তাদের অধ্যয়ন ও গবেষণা করা’ এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। এখান থেকে প্রথম গবেষণামূলক বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে—এফ এ খানের ‘ময়নামতি’। একে একে প্রকাশিত হয়েছে মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, লালবাগ দুর্গ ও জাদুঘর নিয়ে গবেষণামূলক মোট ৩৮টি বই। এর মধ্যে অবশ্য ‘ময়নামতি’সহ ১৫টি বইয়ের মুদ্রিত কপি এখন নেই। প্রতিষ্ঠানের ২০২১ সালে হালনাগাদ করা তালিকায় দেখা যায়, ২০০৫ সালে যশোরের খনন প্রতিবেদন প্রকাশের পর আর কোনো গবেষণামূলক কাজের তথ্যের উল্লেখ নেই।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সার্বিক বিষয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান জয়ন্ত সিংহ রয়ের কাছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অধিদপ্তরের কাজ শুধু বড় বড় স্থাপত্যের জন্য খনন নয়; খনন করে পাওয়া মৃৎপাত্র, দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্রের মতো প্রত্নবস্তুগুলো নিয়ে তাদের গবেষণা করতে হবে। সেই সময়ের সাধারণ মানুষের জীবনযাপন ও সভ্যতা সম্পর্কে জানতে এটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অধিদপ্তরে গবেষণার যোগ্য ব্যক্তি নেই। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দায়সারা খননের একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সংখ্যায় বেশি সম্ভব না হলে প্রতিবছর একটি-দুটি করে গবেষণাকাজ প্রকাশ করতে পারে। অধিদপ্তরকে গবেষণায় গুরুত্ব দিতে হবে।’

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন ওমর ফারুক, আনোয়ারা পারভেজ, মোহাম্মদ মোর্শেদ হুসেন ও সরদার ইনজামামুল হক)

আরও পড়ুন