ভাঙাচোরা সড়কে নালা উপচানো পানি, আটকে যায় যান

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আবদুল্লাহপুর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত বেহাল। খানাখন্দে ভরা এই সড়কে চলাচল করতে চরম দুর্ভোগে পড়ে মানুষ। যানবাহনের ধীরগতির কারণে বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয় যানজটের। গতকাল বেলা তিনটায় টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায়
ছবি: সাজিদ হোসেন

রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা মো. আনোয়ার হোসেন। গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকায় পোশাক কারখানা রয়েছে তাঁর। প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়ে কারখানায় যান, ফেরেন সন্ধ্যায়। কিন্তু এ যাওয়া–আসায় ভোগান্তি তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী।

গতকাল সোমবার ক্ষোভের সঙ্গে আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘৮-১০ বছর ধরে ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। রাস্তার বেহাল দশার কারণে কোনো দিনই সময়মতো কারখানায় যেতে পারি না, বাসায় ফিরতে পারি না।’ তিনি বলেন, ‘রাস্তার এ অবস্থা দেখে দেশি-বিদেশি বায়াররাও (ক্রেতা) কারখানায় আসতে চান না। শ্রমিকেরা চলাচল করতে গিয়ে তাঁদের কষ্টের কথা জানান।’

ভাঙাচোরা সড়ক আর অপরিষ্কার নালা—মূলত এ দুইয়ে আটকে গেছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের রাজধানীর আবদুল্লাহপুর থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত অংশ। ভাঙাচোরা সড়কে এমনিতেই গাড়ি চলে ধীরগতিতে। এর ওপর একটু বৃষ্টি হলেই নালার পানি উপচে দেখা দেয় অচলাবস্থা। ফলে দেখা দেয় যানজট। আনোয়ার হোসেনের মতো এ মহাসড়কে চলাচলকারী মানুষেরা ভোগান্তিতে পড়েন।

‘বৃষ্টি হলেই আমরা বেকায়দায় পড়ে যাই। তখন পানি আর ভাঙা সড়কে অচলাবস্থা দেখা দেয়। সাধ্যমতো চেষ্টা করেও অনেক সময় পেরে উঠি না।’
মো. সাজ্জাত হোসেন, আবদুল্লাহপুর পুলিশ বক্সের পরিদর্শক

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভাঙাচোরা সড়ক ও অপরিষ্কার নালা—এ দুটোরই দায় সড়কে চলমান বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প কর্তৃপক্ষের। প্রকল্পের কাজের অংশ হিসেবে সড়কটির বিভিন্ন অংশে খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়েছে। যেখানে–সেখানে ফেলে রাখা হয়েছে ইট, বালুসহ নানান নির্মাণসামগ্রী। এতে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক যান চলাচল। সড়কের দুপাশের নালাও অপরিচ্ছন্ন, অনেক জায়গায় তা ময়লা-আবর্জনায় প্রায় ভরাট হয়ে আছে। ফলে একটু বৃষ্টিতেই সড়কে পানি উপচে যান চলাচল থমকে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

এমনই এক ভোগান্তির দিন ছিল গত রোববার। ওই দিন ঢাকামুখী সড়কে গাজীপুরের বোর্ডবাজার থেকে বিমানবন্দর এবং ময়মনসিংহমুখী সড়কে রাজধানীর বনানী থেকে টঙ্গীর মিলগেট পর্যন্ত দেখা দেয় তীব্র যানজট। যানবাহনগুলো একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক ঘণ্টা। প্রায় ছয় ঘণ্টা স্থায়ী ওই যানজটে চরম ভোগান্তিতে পড়েন হাজারো মানুষ। অনেকে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে নিজেদের ক্ষোভ ঝাড়েন ফেসবুকে। হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছান অনেকে।

আরও পড়ুন

ঢাকায় প্রবেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ওই সড়কের বিভিন্ন স্থানে দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরাও যানজটের দায় চাপাচ্ছেন প্রকল্প কর্তৃপক্ষের ওপর। তাঁরা বলছেন, মিলগেট এলাকায় সড়কের মাঝ বরাবর চলছে প্রকল্পের পিলার স্থাপনের কাজ। এতে সেখানে সড়ক সরু হয়ে পড়েছে, আবার সড়ক ভাঙাচোরাও। ফলে গাড়ি চলে এক লেনে। বৃষ্টি হলে সড়কে পানি জমে। তখন গর্তে পড়ার ভয়ে কোনো গাড়ি স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। এতে লেগে যায় যানজট। একইভাবে বিমানবন্দর এলাকাতেও চলছে বিআরটি প্রকল্পের কাজ। সেখানেও একটু বৃষ্টি হলে পুরো সড়ক পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। ফলে গাড়িগুলো আটকে পড়ে।

‘এখানে আসলেই সব গাড়ির গতি কইম্যা যায়। হেললাইগ্যা স্যাররা (ট্রাফিক পুলিশ) একটু পরপর সিগন্যাল ফেলে গাড়ি ঠিক রাখে। আর বৃষ্টি হইল্যে তো কোনো কথাই নাই। তখন আর গাড়ি চলার উপায়ই থাকে না।’
মো. হাসিবুল, স্থানীয় চা–দোকানি

আবদুল্লাহপুর পুলিশ বক্সের পরিদর্শক মো. সাজ্জাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই আমরা বেকায়দায় পড়ে যাই। তখন পানি আর ভাঙা সড়কে অচলাবস্থা দেখা দেয়। সাধ্যমতো চেষ্টা করেও অনেক সময় পেরে উঠি না।’

‘সড়ক বেহাল বা ভাঙাচোরা থাকলেও এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা। নালাগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার না করায় বৃষ্টি হলেই সড়কে পানি উঠে পড়ছে। আমরা অনেকবার পীড়াপীড়ি করার পর কয়েক জায়গায় একটু-আধটু ময়লা পরিষ্কার করছে।’
মো. নাজমুল, ট্রাফিক সার্জেন্ট

সরেজমিন

গতকাল সোমবার দুপুরে রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক। বিমানবন্দর থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত সড়কটিতে তেমন কোনো ভাঙা বা বড় গর্ত নেই। তবে আবদুল্লাহপুর থেকে টঙ্গী সেতু পার হয়ে গাজীপুরে ঢুকতেই সড়কে অসংখ্য ছোট-বড় গর্ত। বিশেষ করে টঙ্গী বাজার থেকে মিলগেট পর্যন্ত সড়ক ভাঙা, এবড়োখেবড়ো। এর মাঝে কোথাও কোথাও জমে আছে পানি।

আরও পড়ুন

সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মিলগেট এলাকায়। এখানে সড়কের মাঝ বরাবর চলছে প্রকল্পের পিলার স্থাপনের কাজ। এতে খোঁড়া হয়েছে বিশাল গর্ত। সড়ক সরু হয়ে গাড়ি চলছে এক লেনে। আছে খানাখন্দও। গাড়ি চলছে ধীরগতিতে। কখনো কখনো ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে আটকে যাচ্ছে যান।

বৃষ্টি কমলেই সড়কের ভাঙা বা এবড়োখেবড়ো অংশগুলো মেরামত করা হবে। তখন আর যান চলাচলে সমস্যা হবে না। আর এখনো নালা নির্মাণের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি।
মো. মহিরুল ইসলাম, প্রকল্পের পরিচালক

স্থানীয় চা–দোকানি মো. হাসিবুলের কথায়, ‘এখানে আসলেই সব গাড়ির গতি কইম্যা যায়। হেললাইগ্যা স্যাররা (ট্রাফিক পুলিশ) একটু পরপর সিগন্যাল ফেলে গাড়ি ঠিক রাখে। আর বৃষ্টি হইল্যে তো কোনো কথাই নাই। তখন আর গাড়ি চলার উপায়ই থাকে না।’

মিলগেট থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত মোটামুটি ভালো। সেভাবে বড় গর্ত নেই এ অংশে। তবে যেখানে সেখানে পড়ে আছে প্রকল্পের ইট, বালু, সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী। ফলে কোথাও কোথাও সড়ক সরু হয়ে যান চলছে ধীরগতিতে। ভোগরা বাইপাস ও চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় কয়েক জায়গায় সড়কের মাঝবরাবর গর্ত ও খানাখন্দ রয়েছে। এসব স্থানেও যানবাহনের ধীরগতি দেখা যায়।

নালা উপচে সড়কে পানি

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে জলাবদ্ধতার সমস্যা অনেক আগে থেকেই। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে প্রকল্পের কাজের অংশ হিসেবে পুরো সড়কের দুপাশে তৈরি করা হয়েছে বিশাল নালা। দেখা যায়, কোথাও নালার ঢাকনা খোলা, কোথাও ঢাকনা নেই। কোথাও ময়লা-আবর্জনা জমে বন্ধ হয়ে গেছে পানির চলাচল। এতে পানিতে সয়লাব সড়ক। যানবাহন চলছে এক লেনে।

বেশি খারাপ অবস্থা টঙ্গীর হোসেন মার্কেট, এরশাদ নগর, বোর্ডবাজার, মালেকের বাড়ি, তারগাছ, বাসন, সায়েদাবাদ ও ছয়দানা এলাকায়। এসব এলাকার সড়কের কিছু অংশে নালার পানি উপচে তৈরি হয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। এতে পথচারীও পড়েছেন বিপাকে।

বোর্ডবাজার এলাকায় কথা হয় কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্ট মো. নাজমুলের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সড়ক বেহাল বা ভাঙাচোরা থাকলেও এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা। নালাগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার না করায় বৃষ্টি হলেই সড়কে পানি উঠে পড়ছে। আমরা অনেকবার পীড়াপীড়ি করার পর কয়েক জায়গায় একটু-আধটু ময়লা পরিষ্কার করছে।’

যা বলছে বিআরটি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ

সার্বিক বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রকল্পের পরিচালক মো. মহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বৃষ্টি কমলেই সড়কের ভাঙা বা এবড়োখেবড়ো অংশগুলো মেরামত করা হবে। তখন আর যান চলাচলে সমস্যা হবে না। আর এখনো নালা নির্মাণের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি।

কিছু জায়গায় এখনো পাইপ বসানোর কাজ চলছে। পুরো কাজ শেষ হয়ে গেলে আর জলাবদ্ধতার সমস্যা থাকবে না।

ভোগান্তি নিরসনে দ্রুত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না, এমন প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আপাতত সেভাবে কোনো সমাধান নেই। তবে বৃষ্টি কমলে মেরামতের কাজ শুরু করব।’