যানজটের চন্দ্রায় আর 'বইস্যা থাকা লাগে না'

চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকার উড়ালসড়কটি খুলে দেওয়া হয়েছে। যানবাহন বেছে নিয়েছে এই সড়ক। ছবি: মাসুদ রানা
চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকার উড়ালসড়কটি খুলে দেওয়া হয়েছে। যানবাহন বেছে নিয়েছে এই সড়ক। ছবি: মাসুদ রানা

গাজীপুরের চন্দ্রা ত্রিমোড়। এখানে এসে গাড়ির জটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকা যাত্রীদের কাছে এটি পরিচিত হয়ে উঠেছিল ‘যানজটের চন্দ্রা’নামে। উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার এটি। কোনো ঈদে বাড়িমুখী মানুষ চন্দ্রা ত্রিমোড়ে যানজটে আটকা পড়ে নাজেহাল হননি, এমন ঘটনা প্রায় বিরল। শুধু ঈদের সময় নয়, বছরের প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো সময় এ মোড়ে জট লেগে থাকত।

চন্দ্র মোড়ের ‘দুর্নাম’ বুঝি ঘুচতে চলল। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা মোড় আগের চেয়ে অনেক প্রশস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া গতকাল শনিবার চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকার উড়ালসড়কটি খুলে দেওয়া হয়েছে। এর কারণে এর সুফল পেতে শুরু করেছে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ও কালিয়াকৈর-নবীনগর সড়কের চলাচলকারীরা।
সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্পের আওতায় জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা মহাসড়কের গাজীপুর অংশে নির্মিত কোনাবাড়ী ও চন্দ্রা উড়াল সড়ক, দুটি সেতু ও একটি আন্ডারপাস উদ্বোধন করা হয়েছে। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এসবের উদ্বোধন করেন।

আজ রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় ছিলেন এ প্রতিবেদক। আগের চিরচেনা জটের চেহারা পাল্টেছে এখানে, দেখা গেল কয়েক ঘণ্টা জায়গাটাতে থেকে। উত্তরবঙ্গের যাত্রীবাহী বাস, ট্রাকসহ ভারী যানবাহন চন্দ্রা ত্রিমোড়ে এসে থেমে যেত। কিন্তু এখন আর সেগুলো থামছে না। টাঙ্গাইলের দিক থেকে যে পরিবাহন গাজীপুরের দিকে যাবে এবং গাজীপুরের দিক থেকে যে পরিবাহন টাঙ্গাইল বা উত্তরবঙ্গের দিকে যাবে, তারা উড়ালসড়ক ব্যবহার করে চলে যাচ্ছে। কোথাও তাদের থামতে হচ্ছে না। অন্যদিকে যে যানগুলো সাভারের নবীনগর হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করবে, সেগুলোও উড়াল সড়কের নিচে মাঝখান দিয়ে বের হয়ে চলে যাচ্ছে। আর যে পরিবহনগুলো নবীনগর থেকে উত্তরবঙ্গে দিকে যাবে, সেগুলোও উড়াল সড়কে না উঠে বাম দিক দিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে চলে স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পারছে। এলাকায় নতুন উড়ালসড়ক। তাই দেখার জন্য শনিবার থেকেই আশপাশের বাসিন্দারা ওপরে উঠে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

চন্দ্রা এলাকায় কাউন্টার থেকে যাত্রী উঠাচ্ছে শ্যামলী পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস। ওই বাসের চালক আসলাম হোসেন বলেন, ‘ভাই জীবনে যত দিন ধইরা রাস্তায় গাড়ি চালাইতেছি এর মধ্যে চন্দ্রার যানজটের কারণে রাস্তায় বইসা থাকা লাগছে বেশি। উড়াল সড়ক এবং সড়কটি চার লেন হওয়ার কারণে এখন আর যানজটে বইসা থাকা লাগব না।’

সোনার তরী পরিবহনের সহযোগী (হেলপার) আকবর হোসেন বলেন, ‘চন্দ্রা এহন এত বড় হয়েছে আবার ফ্লাইওভারও (উড়ালসড়ক) হইছে। এখন আর অযথা জামে পড়তে হইতেছে না।’

প্রায় ফাঁকা একসময়ের যানজটের চন্দ্রা। ছবি: প্রথম আলো
প্রায় ফাঁকা একসময়ের যানজটের চন্দ্রা। ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় সূত্র জানায়, উত্তরবঙ্গের ২৩টি জেলার ১১৭টি রুটের পরিবহন চলাচল করে গাজীপুর জেলার ওপর দিয়ে। এ কারণে বিশেষ করে প্রতিবছর ঈদযাত্রায় ঘরমুখী লাখ লাখ মানুষের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় গাজীপুরের যানজট। গাজীপুরের কোনাবাড়ী, কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড় ও বাইপাস এলাকায় যানজট নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কালিয়াকৈর বাজার থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার যেতে আগে সময় লাগত কমপক্ষে দেড় ঘণ্টা। কখনো কখনো তিন ঘণ্টাও আটকা পড়ে থাকতে হয়েছে। কোনাবাড়ী এলাকায় গত তিন থেকে চার বছর ধরে দুই পাশেই যানজট ছিল না, এমন কোনো দিন নেই। গাজীপুর শহরে বা আদালতে কাজ থাকলে কালিয়াকৈর থেকে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য ভোরে রওনা দিতেন অনেকে। সেই চেষ্টা অনেক সময় বিফলে যেত। অথচ গত শনিবার ও আজ রোববার কালিয়াকৈর থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত লোকাল বাসে যেতে সময় লাগছে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট।

গাজীপুরের জজকোর্টের আইনজীবী ফজলুল হক বলেন, যানজটের ভয়ে আগে সেই কাকডাকা ভোরে রওনা দিতাম। কিন্তু আজ সকাল ৯টায় রওনা দিয়ে পৌনে ১০টায় আদালতের চেম্বারে পৌঁছে গেছি।
কালিয়াকৈর পরিবহনের চালক হেলাল উদ্দিন বলেন, চন্দ্রা ও কোনাবাড়ী এলাকার ফ্লাইওভার খুলে দেওয়ার পর নিচ দিয়েও যানজট ছিল না। তবে কোনাবাড়ী এলাকায় নিচের রাস্তার কাজ এখনো অনেক বাকি, যার কারণে সেখানে একটু ধীরগতিতে চলতে হয়েছে।

আজ সকালে চন্দ্রা ত্রিমোড় দিয়ে অনেক গাড়ি চলাচল করলেও কোথাও যানজট চোখে পড়েনি। চন্দ্রা উড়ালসড়ক চালু হলেও দুই পাশে যে বিশাল জায়গাজুড়ে সড়ক প্রশস্ত করা হয়েছে, সেটির কার্পেটিং বা আরসিসি ঢালাইয়ের কাজ শেষ করা হয়নি। আজ মোড় এলাকায় সড়ক সংস্কারের কাজ করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া এরই মধ্যে গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশ ও জেলা পুলিশের সদস্যরা সড়কে দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন। সড়কে তিন চাকার কোনো হুইলার চলতে দেওয়া হচ্ছে না। কেউ উঠলেই সেগুলির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মো. গোলাম সবুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ থেকেই সড়কে ঘুরে বেড়াচ্ছি এবং সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করার চেষ্টা করছি। তবে দুটি উড়ালসড়ক খুলে দেওয়ার পর ম্যাজিকের মতো যানজট দূর হয়ে গেছে। তা ছাড়া ঈদ উপলক্ষে মহাসড়কে রাতে ও দিনে পালা করে এক হাজার অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হবে।’
কালিয়াকৈর পরিবহন শ্রমিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন কবীর খান বলেন, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক চার লেন এবং চন্দ্রা ত্রিমোড় ও কোনাবাড়ী এলাকার উড়ালসড়ক খুলে দেওয়ার কারণে সড়কে যানজট নেই। আশা করছি ঈদেও চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় মানুষ যানজটে পড়বে না।

সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প-১-এর কর্মকর্তারা জানান, চার লেনবিশিষ্ট ৪০টি স্প্যানের কোনাবাড়ী উড়াল সড়কের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৬৪৫ মিটার ও প্রস্থ ১৮ দশমিক ২০ মিটার। এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ২১০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। অন্যদিকে সাতটি স্প্যানের কালিয়াকৈরের চন্দ্রায় নির্মিত উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য ২৮৮ মিটার এবং প্রস্থ ১৮ দশমিক ২০ মিটার। মহাসড়কের গাজীপুরের কড্ডায় দুই লেন সেতুর পাশে নির্মিত সেতুটির দৈর্ঘ্য ৭০ মিটার ও প্রস্থ ১৪ দশমিক ৭১৫ মিটার এবং ২টি স্প্যান বিশিষ্ট।

এ ছাড়া মহাসড়কের গাজীপুরের বাইপাইল এলাকায় বিদ্যমান দুই লেন সেতুর পাশে নির্মিত সেতুটির দৈর্ঘ্য ১২১ মিটার ও প্রস্থ ১৪ দশমিক ৭১৫ মিটার এবং এটি ৫টি স্প্যানের। অপর দিকে কালিয়াকৈর বাইপাস এলাকায় সংযোগ সড়কসহ আন্ডারপাসটির দৈর্ঘ্য ৪২০ মিটার।

সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প-১-এর ডেপুটি প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী এ বি এম সেরতাজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চন্দ্রা এলাকায় আরও কিছু কাজ বাকি আছে, তা দ্রুত শেষ করা হচ্ছে।
চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় কথা হয় গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এস এম বদরুল আলমের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উড়ালসড়ক খুলে দেওয়ার পর চন্দ্রায় আর কোনো যানজট নেই। তার পরও ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখী মানুষের নির্বিঘ্নে যাতায়াতের জন্য জেলা পুলিশের পাশাপাশি তাঁদের ২৫০ জন সদস্য বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হবে।