আবরারকে যেভাবে হত্যা করা হয়

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলের নিচতলায় ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন আবরার ফাহাদ। গত শনিবার বিকেল ৫টা ৩২ মিনিটে আবরার ফাহাদ ফেসবুকে যখন সর্বশেষ স্ট্যাটাস দেন, তখন তিনি ছিলেন কুষ্টিয়ায় বাড়িতে। পরদিন রোববার বিকেলে তিনি বাড়ি থেকে বুয়েটের হলে ফেরেন।

হলের শিক্ষার্থী ও একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হলে ফেরার কয়েক ঘণ্টার মাথায় রাত আটটার দিকে আবরারসহ দ্বিতীয় বর্ষের সাত-আটজন ছাত্রকে শেরেবাংলা হলের দোতলার ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে পাঠান তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাত-আটজন নেতা। তাঁরা আবরার ফাহাদের মুঠোফোন নিয়ে ফেসবুক ও মেসেঞ্জার ঘেঁটে দেখেন। এরপর ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আবরারকে পেটাতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আরও কয়েকজন নেতা-কর্মী আসেন। তাঁরা আরেক দফা পেটান আবরারকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম আলোকে বলেন, পেটানোর একপর্যায়ে আবরার নিস্তেজ হয়ে পড়েন। তখন ছাত্রলীগের নেতারা আবরারের হলের সহপাঠীদের ডেকে আনেন এবং তাঁদের দিয়ে নিথর দেহটি দোতলা ও নিচতলার মাঝামাঝি সিঁড়িতে নিয়ে রাখেন।

এরপর ছাত্রলীগের নেতারা বাইরে যান রাতের খাবার খেতে। পরে যখন নিশ্চিত হলো আবরার বেঁচে নেই, তখন সিঁড়ি থেকে লাশ নিয়ে রাখা হয় হলের ক্যানটিনে। গতকাল ভোরে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে।

বাড়িতে পরীক্ষার প্রস্তুতি ঠিকমতো হচ্ছিল না, তাই ছুটি শেষ হওয়ার আগেই রোববার বুয়েটে ফিরে এসেছিলেন আবরার। কিন্তু ওই রাতেই তাঁকে এমন নৃশংসভাবে জীবন হারাতে হবে তা তিনি ভাবতেও পারেননি। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে।  ছবি: প্রথম আলো (প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতিমালা অনুযায়ী সাধারণত মৃতদেহের ছবি ছাপা হয় না। কিন্তু ঘটনার ভয়াবহতা ও নৃশংসতার কথা বিবেচনা করে আবরারের মৃতদেহের ছবি প্রকাশ করা হলো)
বাড়িতে পরীক্ষার প্রস্তুতি ঠিকমতো হচ্ছিল না, তাই ছুটি শেষ হওয়ার আগেই রোববার বুয়েটে ফিরে এসেছিলেন আবরার। কিন্তু ওই রাতেই তাঁকে এমন নৃশংসভাবে জীবন হারাতে হবে তা তিনি ভাবতেও পারেননি। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। ছবি: প্রথম আলো (প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতিমালা অনুযায়ী সাধারণত মৃতদেহের ছবি ছাপা হয় না। কিন্তু ঘটনার ভয়াবহতা ও নৃশংসতার কথা বিবেচনা করে আবরারের মৃতদেহের ছবি প্রকাশ করা হলো)

হলের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ করা একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আবরারকে কয়েকজন ধরাধরি করে সিঁড়ির দিকে নিয়ে আসছেন। পেছনে আরও কয়েকজনকে দেখা যায়।

হলের প্রাধ্যক্ষ জাফর ইকবাল খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাত পৌনে তিনটার দিকে খবর পাই যে এক শিক্ষার্থী পড়ে আছে। তাৎক্ষণিকভাবে বুয়েটের চিকিৎসক দিয়ে তাকে পরীক্ষা করা হয়। চিকিৎসক জানান, সে বেঁচে নেই। পরে পুলিশকে খবর দিই। পুলিশ এসে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।’

আবরার ফাহাদ বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭ তম ব্যাচ) ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজেও ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন আবরার ফাহাদ। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা প্রকৌশলী হবেন। তাই মেডিকেলে কিছুদিন ক্লাস করার পর ভর্তি হন বুয়েটে। কিন্তু সেটা আর হলো না। আবরারকে গত রোববার রাতে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক কিছু চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে আবরারের কিছু স্ট্যাটাস এ হত্যার কারণ বলে গতকাল সোমবার দিনভর বুয়েটের ক্যাম্পাসে আলোচনা ছিল। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে। তাঁর সর্বশেষ স্ট্যাটাস ছিল শনিবার বিকেল ৫টা ৩২ মিনিটে। তাতে ভারতকে মোংলা বন্দর ব্যবহার ও গ্যাস রপ্তানির সমালোচনা ছিল। এর পরদিন রোববার রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা আবাসিক হলের নিজ কক্ষ থেকে আবরারকে ডেকে নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেন। এরপর রাতে হলে খবর ছড়ানো হয়, ‘শিবির’ সন্দেহে আবরারকে পেটানো হয়েছে। যদিও গতকাল খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুষ্টিয়ায় আবরারের পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।