স্বর্গে মায়ের কোলে বসে তনুজা হয়তো বলছে, ‘বাবা, তোমাকে ভালোবাসি’

অনাগত তনুজাকে নিয়ে তন্ময় মজুমদার ও পূজা সরকারের প্রথম সেলফি
ছবি: সংগৃহীত

বিজ্ঞানী পূজা সরকারের পেটে স্টেথিসকোপ দিয়ে অনাগত সন্তান তনুজার হৃৎস্পন্দন শুনতেন চিকিৎসক বাবা তন্ময় মজুমদার। যখন শেষ হৃৎস্পন্দন শুনেছিলেন, তখন মায়ের পেটে থাকা তনুজার বয়স ছিল ছয় মাস। শেষ আলট্রাসাউন্ড রিপোর্টে তার হাত, পা, মাথা স্পষ্টই ছিল। তনুজার বয়স এখন হতো সাড়ে আট মাসের মতো। কিন্তু তনুজার তো জন্মই হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনায় মা ও মেয়ে একসঙ্গেই মারা গেছে।
তবে তন্ময় মজুমদার কল্পনা করেন, স্বর্গে মায়ের কোলে বসে তনুজা হয়তো বলছে, ‘বাবা, তোমাকে ভালোবাসি।’

পূজার গর্ভে ছয় মাস বয়সী যে মানবশিশু ছিল, সে ছেলে না মেয়ে ছিল, তা নিশ্চিত হওয়ার আগেই পৃথিবী থেকে চলে গেছে। তবে শুরু থেকেই পূজা ও তন্ময়ের কল্পনায় অনাগত সেই সন্তান ছিল মেয়ে, যার নাম তাঁরা রেখেছিলেন ‘তনুজা’। তনুজাকে দুজন কুটু নামেও ডাকতেন। তনুজা বা কুটুকে নিয়ে স্বপ্নগুলো মাত্র ডানা মেলতে শুরু করেছিল।

স্বপ্নগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে। ২০২২ সালের ৫ জুন ঢাকার অদূরে সাভারের বলিয়ারপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানী পূজা সরকারসহ মোট ছয়জন (দুই চালকসহ) মারা যান। মৃত্যুর সময় পূজা ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।
তন্ময় মজুমদার আক্ষেপ করে বলেন, ‘মৃত্যুর হিসাবেও তনুজা বাদ পড়েছে। সবার কাছে সেই দিনের দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া সংখ্যাটি ছয়, কিন্তু আমার তনুজাকে নিয়ে সংখ্যাটি হবে সাত।’

প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্ব বাবা দিবস পালিত হচ্ছে। সেই হিসাবে বাংলাদেশেও বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় আজ রোববার বাবা দিবস পালিত হচ্ছে। তনুজা বেঁচে থাকলে তন্ময় মজুমদারও হয়তো মেয়ের পক্ষ থেকে উপহার পেতেন। বাবা–মেয়ে মিলে দিনটি উদ্‌যাপন করতেন। কিন্তু তন্ময় মজুমদার তো এখন তনুজার কাল্পনিক বাবা, কল্পনায় মেয়েকে বড় হতে দেখছেন, মেয়ের সঙ্গে কথা বলছেন।

কবি তারিক সুজাত ‘জন্মের আগেই আমি মৃত্যুকে করেছি আলিঙ্গন’ কবিতায় লিখেছেন—
‘এই ছোট হাতে, নরম আঙুলে,
আঁকড়ে ধরার মতো কিছুই পেলাম না,
আমার না ফোটা চোখ—
মৃত্যুর মহাযজ্ঞে, রক্তের স্রোতে’
তন্ময় মজুমদারের তনুজার জীবনেও ঘটেছে এমনই ঘটনা। বাস্তবিক বাবা হতে না পারা তন্ময় মজুমদারের আক্ষেপ, ‘মর্গে গিয়ে রক্তে ভেসে যাওয়া স্ত্রীকে দেখলাম। ততক্ষণে আমাদের মেয়েটাও আর নেই। আমি চিকিৎসক হয়েও ওদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না।’

আরও পড়ুন

বাবা দিবসের আগের দিন শনিবার প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে তনুজার মুখটা দেখতে না পারা, তনুজার মুখে ‘বাবা’ ডাক শুনতে না পাওয়া এই বাবা তন্ময় মজুমদার বলছিলেন, মা ও মেয়ের মৃত্যুর এক বছর পার হয়েছে। কিন্তু এখনো তিনি মেয়ের হৃৎস্পন্দনের শব্দ ভুলতে পারেন না। ঘুমানোর আগে স্ত্রীর পেটে থাকা অনাগত সন্তানকে আদর করার স্মৃতি ভুলতে পারেন না। তিনি অপেক্ষায় আছেন, একদিন হয়তো স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে দেখা হবে। কিন্তু পরক্ষণেই এই বাবা কল্পনার রাজ্যে চলে গেলেন। যখন দেখা হবে, তখনো কি তনুজা ছোটই থাকবে, না কিশোরী হবে, নাকি বয়সটা আর একটু বেশি হবে। মেয়ে দেখতে নিশ্চয়ই তার মায়ের মতোই হয়েছে। বেঁচে থাকলে মায়ের মতোই চঞ্চল হতো।

তন্ময় মজুমদার জানান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন পূজা সরকার। তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। পূজা সরকারের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পরিচয় হয়েছিল ২০১২ সালে। তারপর একটু একটু করে কাছে আসার গল্প শুরু হয়। দুজনে মিলে সংসার করবেন—এ সিদ্ধান্তে আসার পরই দুজন সব সময় চেয়েছেন প্রথম সন্তান যাতে মেয়ে হয়। মেয়ের নাম তনুজা আর ছেলের নাম তপু—এটাও ঠিক করে রেখেছিলেন পূজা।

স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ফেসবুকে তন্ময় মজুমদার বিভিন্ন স্মৃতি লিখে রাখার চেষ্টা করছেন। সেই লেখায় উঁকি দেয় তনুজার গল্প। তনুজা আসছে—এ খুশির সংবাদের পর গত বছর নববর্ষে তিনজনে মিলে একটি সেলফি তুলেছিলেন, যদিও সেলফিতে শুধু পূজা ও তন্ময়ের ছবি আছে। কিন্তু তাঁরা তো জানতেন তনুজাও আছে। এ ছবিই তনুজা ও পূজার সঙ্গে তোলা শেষ ছবি।

পূজা সরকার মারা যাওয়ার পর ‘স্বপ্নের মৃত্যু’ শিরোনামে ছবিটি এঁকেছিলেন ফারজানা নিগার। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন
ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন

তন্ময় মজুমদার মানিকগঞ্জের কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকার বাসা থেকে কর্মস্থলে যান। পূজা আর তনুজা যে জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে, ওই জায়গা দিয়েই প্রতিদিন যাতায়াত করেন তিনি।

সব স্বপ্নের সমাপ্তি

তন্ময় মজুমদার বলেন, ২০২০ সালে বিয়ে হলো। কিন্তু বিয়ের সাত দিনের মাথায় তন্ময় পোস্টিং নিয়ে পিরোজপুর চলে যান। আর পূজা সাভারের আশুলিয়ায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের কোয়ার্টারে সংসার শুরু করেন। গত বছরের ১৭ মার্চ তন্ময় বদলি হয়ে মানিকগঞ্জে আসেন। তখন কোয়ার্টারে দুজনের সংসার শুরু হয়। তত দিনে তনুজা আসছে—এই সুখবরও চলে এসেছে। তবে এই দম্পতি সুখে সংসার করেন মাত্র কয়েক মাস। তারপরই তো সব স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটে।
তন্ময় জানান, পূজা মারা যান রোববার। শনিবার রাতে ঢাকার বাসায় বসে ঘণ্টাখানেক ধরে আলট্রাসাউন্ডের রিপোর্ট দেখছিলেন পূজা। তন্ময় ঘুমিয়ে গেলে আলট্রাসাউন্ড রিপোর্টের ছবি তুলে পূজা তা তন্ময়ের মেসেঞ্জারে পাঠিয়েছিলেন।
তন্ময় বলেন, ‘হয়তো পূজা বুঝতে পেরেছিল, সে তার মেয়েকে নিয়ে আমার জীবন থেকে চলে যাবে। তাই মেয়ের শেষ চিহ্ন আমাকে পাঠিয়ে রেখেছিল। পূজা মাত্র ছয় মাস বয়সে তার মাকে হারিয়েছিল। তাই সে কখনো চায়নি তার সন্তান কখনো তার মতো কষ্ট পাক। সব সময় তনুজাকে আঁকড়ে রাখবে বলেই হয়তো মেয়েকে একা রেখে যায়নি।’

আরও পড়ুন

গত বছরের ৫ জুন ঢাকায় বাসায় সাত দিন ছুটি কাটিয়ে পূজা অফিসে যাচ্ছিলেন। তনুজা পেটের মধ্যে ঠিক আছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্যই চিকিৎসক দেখানোর জন্য ছুটি নিয়েছিলেন। সেদিনই অফিসে গিয়ে পরের দিন থেকে মাতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়ার কথা ছিল।

তন্ময় মজুমদারের কণ্ঠে আক্ষেপ বাড়তে থাকে। বললেন, পূজার সেদিন অফিসে না গেলেও চলত। যেতে নিষেধও করা হয়েছিল। অফিসের যে বাসে নিয়মিত যান, সেটি নির্দিষ্ট স্টপেজ থেকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। পূজা চালককে ফোন করে বাস থামাতে বলে রিকশা নিয়ে বাসে চড়েছিলেন। পূজা কখনো বাসে ঘুমান না, সেই পূজাই সেদিন নাকি বাসের জানালায় মাথা হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। এ ঘটনাগুলো না ঘটলে হয়তো পূজা বেঁচে থাকতেন।

পূজাদের কথা সবাই ভুলে যাচ্ছেন

তন্ময় মজুমদারের আক্ষেপ অনেক কিছু নিয়ে। ওই দিনের দুর্ঘটনায় নিহত বিজ্ঞানী ড. মো. আরিফুজ্জামান, পূজা সরকার, ফারহানা নিপা এবং প্রকৌশলী কাওসার আহমেদ ছিলেন দেশের সম্পদ। তাঁদের সঙ্গে তনুজাও হারিয়ে গেল। অথচ তাঁদের স্মৃতিকে ধরে রাখতে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কমিশন চাইলেই প্রত্যেকের নামে একটি করে গবেষণাগারের নামকরণ করতে পারত। কমিশন প্রাঙ্গণে স্মারক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করতে পারত। দুর্ঘটনার শিকার বাসটি সেভাবেই রেখে দিত পারত। এতে অন্যরা সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতা এবং তাঁদের সম্পর্কে জানতে পারতেন। এ দাবি জানিয়ে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা মিলে সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় স্মারকলিপিও দিয়েছিলেন। কিন্তু গত এক বছরে কিছুই হয়নি। প্রথম দিকে ন্যায়বিচার চেয়ে পরিবার এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে যে আন্দোলন চলছিল, তা–ও থেমে গেছে।

আরও পড়ুন

তন্ময় মজুমদার বলেন, সবাই পূজাদের কথা ভুলে যাচ্ছেন। কিন্তু তিনি বা নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা তো ভুলতে পারছেন না। এ দুর্ঘটনায় সাভার হাইওয়ে থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. ফজলুল হক বাদী হয়ে ওই রাতেই সাভার মডেল থানায় বাসটির চালকের বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইনে মামলা করেছিলেন। তবে দুর্ঘটনা ঘটানো গাড়ির চালকের মৃত্যুর ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা পর হাইওয়ে পুলিশ চালকের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। বাসমালিকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। গত এক বছরে মামলার কোনো অগ্রগতি নেই।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে নিহত ব্যক্তিদের পরিবার যাতে কিছু টাকা পায়, সে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তন্ময় মজুমদার বললেন, ‘টাকা দিয়ে কী হবে? যে ক্ষতি হয়েছে, তা টাকা দিয়ে পূরণ হবে? এই বিজ্ঞানীরা ছিলেন দেশের সম্পদ। রাষ্ট্রকেই তো তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখতে উদ্যোগ নিতে হবে। মামলায় যাতে সুষ্ঠু বিচার পাওয়া যায়, তার নজরদারি করতে হবে। কিন্তু পরিবারগুলোর দায় ছাড়া আর যেন কারও কোনো দায় নেই। অথচ যে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল, তাতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায় ছিল।’

পূজাকে এই জায়গায় দাহ করা হয়েছিল। তন্ময় মজুমদার এ স্থানকে স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করতে চান
ছবি: সংগৃহীত

দুর্ঘটনা ঘটার পর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের বরাতে প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সেইফ লাইন নামের যে বাসের কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল, আট বছর ধরে সেটির সড়কে চলাচলের অনুমতি বা রুট পারমিট ছিল না। ট্যাক্সের মেয়াদ শেষ হয়েছিল সাত বছর আগে। বাসচালকের সহকারী জানিয়েছিলেন, দুর্ঘটনার আগের দিন সকালে গাবতলী থেকে ছেড়ে আবার রাতে ঝিনাইদহের শৈলকুপা হয়ে পরদিন ঢাকায় ফিরছিল বাসটি। চালক ক্লান্ত ছিলেন। ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া দুর্ঘটনার ভিডিওতেও চালকের অস্বাভাবিক আচরণ স্পষ্ট ছিল। বাসটি চলন্ত অবস্থায় উল্টো লেনের একটি ট্রাককে ধাক্কা দিয়ে সড়ক বিভাজক পেরিয়ে বিপরীত লেনে থাকা পরমাণু শক্তি কমিশনের বাসটিকে সজোরে ধাক্কা দেয়।

আরও পড়ুন

তনুজার নামে অন্য তনুজারা বড় হবে

তন্ময় মজুমদার আবার ফিরে গেলেন তনুজার গল্পে। বললেন, ‘পূজা চাইতেন তনুজা তার মতো বিজ্ঞানী হবে। তবে আমি সব সময় বলতাম, তনুজার যা হতে ইচ্ছা করবে, তা–ই হবে। তবে আমরা দুজনই ঠিক করে রেখেছিলাম, তনুজা ও ছেলে তপুকে নিয়ে আমরা বিশ্বভ্রমণে বের হব। তবে তা তো হলো না। মা ও মেয়ে আগেই ভ্রমণে বের হয়ে গেল।’

তন্ময় মজুমদার জানান, তিনি পূজার নামে একটি ট্রাস্ট করার চিন্তাভাবনা করছেন। এ ট্রাস্টের সহায়তায় নারীদের বিজ্ঞানী হতে সহায়তা করা হবে। আর তনুজার নামে একটি আশ্রয়কেন্দ্র করবেন, যেখানে মেধাবী এতিম বাচ্চাদের স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করা হবে। তনুজার নামেই অন্য তনুজারা বড় হবে।