ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ হত্যার ৭ বছর, মৃত্যুর আগে বিচার দেখে যেতে চান মা
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যার সাত বছর পূর্ণ হয়েছে আজ ২০ নভেম্বর। তবে এ হত্যা মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। ছেলে হত্যার সুষ্ঠু বিচারের আশায় প্রহর গুনছেন মা জাহেদা আমিন চৌধুরী। তিনি বলেন, মৃত্যুর আগপর্যন্ত সন্তান হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের জন্য লড়ে যাবেন।
জাহেদা চৌধুরীর দাবি, তাঁর ছেলে আত্মহত্যা করেননি; বরং দিয়াজকে রাজনৈতিক কারণে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন না হওয়া পর্যন্ত তিনি হাল ছাড়বেন না বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচার দূরে থাক, মামলার তদন্তও শেষ হয়নি এখনো। মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছেলে হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের জন্য লড়ে যাব। মৃত্যুর আগে যেন ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারি।’
বিচার দূরে থাক, মামলার তদন্ত শেষ হয়নি এখনো। মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছেলে হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের জন্য লড়ে যাব। মৃত্যুর আগে যেন ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারি।
২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকার বাসা থেকে দিয়াজের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে সময় বাসায় পরিবারের কেউ ছিলেন না।
এর ২২ দিন আগে দিয়াজসহ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের চার নেতার বাসায় তাণ্ডব চালানো হয়েছিল। ৯৫ কোটি টাকার দরপত্রের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতির অনুসারী নেতা-কর্মীরা ওই তাণ্ডব চালিয়েছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে।
কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে যাওয়ার আগে দিয়াজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আর মৃত্যুর আগপর্যন্ত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক ছিলেন তিনি।
চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় সিআইডি। প্রতিবেদনে আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, আলমগীর টিপু, জি কে শামীমসহ আসামিদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দিয়াজ খুন হননি।
দিয়াজের লাশ উদ্ধারের তিন দিন পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন চৌধুরীসহ ১০ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন মা জাহেদা চৌধুরী। মামলার অন্য আসামিরা হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন কমিটির সভাপতি আলমগীর টিপু, সহসভাপতি আবদুল মালেক, মনসুর আলম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু তোরাব, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আরমান, প্রচার সম্পাদক রাশেদুল আলম, আপ্যায়ন সম্পাদক মিজানুর রহমান, সদস্য আরিফুল হক ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জামশেদুল আলম চৌধুরী।
পরে এ মামলায় ক্যাসিনো-কাণ্ডে গ্রেপ্তার আলোচিত ঠিকাদার জি কে শামীমকেও আসামি করা হয়।
আত্মহত্যা নাকি হত্যা
২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, দিয়াজ ‘আত্মহত্যা’ করেছেন। পরিবার ও ছাত্রলীগের একাংশ (দিয়াজের অনুসারীরা) তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এরপর ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে দিয়াজের মরদেহের দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দিয়াজকে শ্বাসরোধে হত্যা করার আলামত পাওয়া গেছে।
২০১৯ সালের নভেম্বরে দিয়াজের পরিবার আদালতের মাধ্যমে আলোচিত ঠিকাদার জি কে শামীমকে মামলার আসামি করে। তখন মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত।
চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় সিআইডি। প্রতিবেদনে আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, আলমগীর টিপু, জি কে শামীমসহ আসামিদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দিয়াজ খুন হননি।
সিআইডির দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করেন মা জাহেদা চৌধুরী। গত ৩০ মার্চ আদালত নারাজি আবেদন গ্রহণ করেন এবং পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন।
জাহেদা চৌধুরীর অভিযোগ, দিয়াজ হত্যা মামলার সুষ্ঠু তদন্ত করেনি সিআইডি। প্রভাবিত হয়ে আসামিদের অব্যাহতির সুপারিশ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। জাহেদা চৌধুরী যুক্তি দেন, ঘটনার অন্যতম সাক্ষী তাঁদের বাসার নিচের এক দোকানদার। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি সিআইডি। অথচ ওই দোকানদার অনেক কিছু জানেন। সিআইডি এক নারীর জবানবন্দি নিয়েছে, তিনি সব মিথ্যা বলেছেন।
সিআইডির দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করেন মা জাহেদা চৌধুরী। গত ৩০ মার্চ আদালত নারাজি আবেদন গ্রহণ করেন এবং পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন।
অন্যদিকে, সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দিয়াজকে হত্যা করা হয়নি; বরং নারীঘটিত বিষয়ে জড়িয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনার দিন দিয়াজ তাঁর পরিচিত এক নারীকে বাসায় আসতে বলেন। ওই নারী না আসায় ক্ষোভে আত্মহত্যা করেন দিয়াজ।
তবে এ দাবি নাকচ করে দেন মা জাহেদা চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘দিয়াজের সঙ্গে বিয়ের আগে ওই নারী কেন বাসায় আসবে? সব পুলিশের সাজানো নাটক। ঘটনা সম্পর্কে জানেন—এমন অনেককে সাক্ষী না করে ওই নারীর জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে।’
তদন্ত শেষ হয়নি, প্রতিবাদ চলছে জাহেদার
২০২১ সালে জাহেদা চৌধুরী বলেছিলেন, ‘প্রকাশ্যে আসামিরা ঘুরলেও পুলিশ তাদের ধরছে না। শুধু বলছে, তদন্ত করছে। কিন্তু কী তদন্ত করছে, তা বলতে পারছে না। আসামিদের সম্পর্কে তথ্য দিলেও তা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। ছাত্রলীগ নেতারা আসামি, তাই তদন্ত এগোচ্ছে না।’
তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার তদন্তকাজ চলছে। তাই এখনই বেশি কিছু বলা যাবে না।’
মামলাটির তদন্তে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না থাকলেও আশাবাদী নিহত ছাত্রলীগ নেতার বোন জুবাঈদা সরওয়ার চৌধুরী। পেশায় আইনজীবী জুবাঈদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এর আগে পিবিআই অনেক সূত্রবিহীন মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করেছে। দিয়াজ হত্যায় অনেক সূত্র আছে। আশা করি তারা পারবে।
সুষ্ঠু তদন্ত শেষে হত্যার প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’
ছেলে হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চেয়ে সাত বছর ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন জাহেদা চৌধুরী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী তিনি। ২০১৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণি কর্মচারী সমিতির বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
মামলার তদন্তকাজ চলছে। তাই এখনই বেশি কিছু বলা যাবে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত ওই আয়োজনের সাময়িকীতে দিয়াজ হত্যা মামলার প্রধান আসামি আলমগীর টিপুর ছবিসংবলিত শুভেচ্ছাবাণী ছাপা হয়েছিল। এটা মেনে নিতে পারেননি জাহেদা চৌধুরী।
এর আগে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর ছেলের হত্যার বিচার চেয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন জাহেদা চৌধুরী। ২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা অনশন করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
বয়স হওয়ায় এখন জাহেদা চৌধুরী প্রায় সময়ই অসুস্থ থাকেন। এরপরও কখনো পিবিআই কার্যালয়ে, কখনো পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে ছুটে যান তিনি। তাঁদের কাছে দিয়াজ হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার পাওয়ার আশার কথা বলেন।