বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা: ভুলে স্বামীর পরিবর্তে স্ত্রীর নাম, বাবার পরিবর্তে ছেলের

স্ত্রীর নামের পরিবর্তে স্বামীর নাম, স্বামীর নামের পরিবর্তে স্ত্রীর নাম, বাবার পরিবর্তে ছেলের নাম—এভাবে অনেকের নাম অনুমোদন করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তোলার সুপারিশ করা হয়েছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সভায়। আবার কারও ক্ষেত্রে দেখা গেছে মুক্তিযোদ্ধার নাম ও বাবার নাম পুরোটাই ভুল। এখন এসব সংশোধনের জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধা বা তাঁদের স্বজনদের।

কোন ভুলে এমনটি হয়েছে, নাকি জালিয়াতি করে অন্য কারও নাম বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ঢোকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জামুকার প্রায় প্রতি বৈঠকেই এসব নাম সংশোধনের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের স্বজনেরা। তাঁদের অভিযোগ, জামুকার এমন ভুলের কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই সরকারি স্বীকৃতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এমন একজন ভুক্তভোগী ঢাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোসলেম উদ্দিন। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী, তাঁর নাম মো. মোসলেম উদ্দিন, বাবার নাম জাবেদ আলী। কিন্তু গত বছর ১৯ জুলাই জামুকার ৮০তম সভায় এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম ‘ওমর ফারুক’ লেখা হয়েছে। অন্যদিকে ধামরাইয়ের আবদুল আলিমের বাবার নাম আবদুল হালিম খান। কিন্তু লেখা হয়েছে আব্দুল জলিল খান। গত ১৩ জুলাই অনুষ্ঠিত জামুকার ৮৬তম সভায় বলা হয়, জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত নাম মীর বাবুল। কিন্তু জামুকার সভার কার্যবিবরণীতে তাঁর নাম ‘মীর মোশাররফ হোসেন (বাবুল)’ লেখা হয়েছে। মীর বাবুল গত আগস্টে অনুষ্ঠিত জামুকার সভায় তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী নামে গেজেট প্রকাশে আবেদন করেছেন।

জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য এবং সরকার অনুমোদিত বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই করে ভাতাপ্রাপ্ত সব বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম ২০২০ সালের অক্টোবরে সরকার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) নামের একটি সফটওয়্যারে যুক্ত করা হয়। নাম অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয় ‘লাল মুক্তিবার্তা’, ‘ভারতীয় তালিকা’ ও ‘গেজেট’। বর্তমানে এই সমন্বিত তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৯২ হাজার। শুরুতে এমআইএসে তাঁদের নামসহ অন্যান্য তথ্য অন্তর্ভুক্ত করার পর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭১ হাজার।

আরও পড়ুন

সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, কোনো কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে মিলছে না। তবে সংখ্যাটা খুব বেশি নয়। আবার জামুকারও ভুল রয়েছে। তবে এসব সংশোধনের সুযোগ আছে। সে প্রক্রিয়াও চলছে। মন্ত্রী বলেন, ‘পুরো নাম আমরা পরিবর্তন করব না। বানান ভুল হলে বা প্রাথমিক ভুল হলে সংশোধন করা হচ্ছে। তবে অনিয়ম করে কারও নাম সংশোধন করার আবেদন করা হলে তা–ও আমরা বুঝতে পারব।’

পটুয়াখালীর বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজ খন্দকারের (বাবা: আসমত আলি খন্দকার) নাম গেজেটভুক্ত না করে তাঁর ছেলে মো. ইলিয়াসের নাম গেজেটভুক্ত করা হয়েছে জামুকার ৭৭তম সভায়। একইভাবে গত ১৭ জানুয়ারি জামুকার ৮৩তম সভায় বীর মুক্তিযোদ্ধা হাফিজউদ্দিনের নামের পরিবর্তে তাঁর ছেলে মহসীন আলীর নাম গেজেটভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

এ ছাড়া গত বছরের ২৪ অক্টোবর জামুকার ৮২তম সভায় বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী মো. সফিউল্লাহর নাম সফিকউল্লাহ এবং বাবার নাম গাজী মো. সানু মিয়ার জায়গায় চন্দ মিয়া হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়। এখন এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম গেজেটভুক্ত করতে সমস্যা হচ্ছে।

কোনো কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে মিলছে না। তবে সংখ্যাটা খুব বেশি নয়। আবার জামুকারও ভুল রয়েছে। তবে এসব সংশোধনের সুযোগ আছে। সে প্রক্রিয়াও চলছে।
আ ক ম মোজাম্মেল হক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী

স্বামীর পরিবর্তে স্ত্রীর নাম অনুমোদিত হয়েছে, যা সংশোধনের জন্য আবেদন আসে জামুকায়। বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম বরকত উল্লাহ মজনু হাওলাদার হলেও জামুকার ৭৭তম বৈঠকে তাঁর স্ত্রী রাশিদা বেগমের নাম গেজেটভুক্ত করার অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে গত ২৭ এপ্রিল ৮৫তম বৈঠকে তা সংশোধন করা হয়।

কুড়িগ্রামের রাজারহাটের আছিয়া বেগম জানান, তাঁর স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত নাম খোকা মাসুদ ও বাবার নাম মইনুদ্দিন। কিন্তু ভুলভাবে বাবার নাম (মইনুদ্দিন) বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে জামুকায়। এই ভুলের কারণে খোকা মাসুদের নাম গেজেটভুক্ত হয়নি।

আরও পড়ুন

এদিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের ত্রিপুরায় ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’ নির্মাণে প্রকৌশলী ও সহকারী এবং চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী মেডিকেল দলের চিকিৎসক, সেবিকার তালিকা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পান নেত্রকোনার উষা রানী রায়। কিন্তু তাঁর পরিবর্তে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম এসেছে তাঁর স্বামী বিজয় সাহার।

পটুয়াখালীর বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজ খন্দকারের (বাবা: আসমত আলি খন্দকার) নাম গেজেটভুক্ত না করে তাঁর ছেলে মো. ইলিয়াসের নাম গেজেটভুক্ত করা হয়েছে জামুকার ৭৭তম সভায়।

গেজেটভুক্ত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এখন মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা পান। এ ছাড়া দুই ঈদে ১০ হাজার টাকা করে ২০ হাজার টাকা, বিজয় দিবসে ৫ হাজার টাকা এবং বাংলা নববর্ষে ২ হাজার টাকা ভাতা পান। কিন্তু নামসহ নানা ভুলের কারণে গেজেটভুক্ত হতে না পারায় প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকে।

জামুকার সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে, বাবার নামে অনেক ভুল হয়েছে। অভিযোগ পেয়ে আমরা এসব সংশোধনের জন্য তদন্ত করতে উপজেলা পর্যায়ে পাঠাই। জামুকার প্রতিটি বৈঠকে এসব নিয়ে কাজ করতে হয়। সব মিলের ভুলগুলো সংশোধনে সময় বেশি লাগছে।’

আরও পড়ুন