এ-বাড়ি সে-বাড়ি করে শেষে আশ্রয়কেন্দ্রে বানভাসিরা

আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়া মানুষ ছবি শনিবার সন্ধ্যায় সিলেটের দক্ষিণ সুরমার মা মনি কমিউনিটি সেন্টারে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

ঘরে পানি উঠেছে। সেখানে থাকার উপায় নেই। পাশেই অন্য বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও বেড়ে গেল পানি। সরে গেছেন উঁচু বাড়িতে। সেখানেও পানির চোখরাঙানি। এ রকম এক-দুই জায়গা বদল করে শেষমেশ ঘরছাড়া বানভাসি মানুষ ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে।

গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মা-মণি কমিউনিটি সেন্টারের আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে এ রকম ২০ থেকে ২৫টি পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তাদের সবার ঘর পানিতে ডুবে গেছে। কারও কারও ঘরের বেড়াও পানিতে গেছে ভেসে। অনেকের পক্ষেই কোনো জিনিসপত্র নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। শুধু নিজেদের প্রাণ আর পরিবারের সদস্যদের নিয়েই তারা আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে।

সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার বিশ্বনাথ ইউনিয়নের ইলিমপুরের বাসিন্দা মিনতি রানী বিশ্বাস (৫০) প্রথম আলোকে বলেন, ‘খালি মানুষ আইছি। জিনিসপত্র সব রই গেছে। তিন দিন ধরি ঘরও পানি। কেউর ঘরও হাঁটুপানি, কেউর ঘর বুকসমান পানি। তিন দিন অইলো বাড়ি ছাড়ছি।’ পরিবারের চার সদস্য নিয়ে তিনি ওই আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। একই রকম কথা বললেন প্রতিভা রানী বিশ্বাসও (৬৫)।

গীতা রানী বিশ্বাস বলেন, ‘আমার কাঁচা ঘর। পড়ি (পড়ে) গেছে। খালি সামনের বেড়াখান খাড়া থুইয়া আইছি। পানির যে¯স্রোত। এত সময়ে যাওয়ারগির (ভেসে যাওয়ার) কথা।’ পরিবারের পাঁচজন এসে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। একেকটি পরিবার একেক সময়ে এসেছে। এলাকার ইউপি সদস্য, সবাই যাঁকে মামুন মেম্বার বলেই জানেন, তিনিই এ আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:

সজল বিশ্বাস নামের একজন জানান, তিন দিন আগে তিনি বাড়ি ছেড়েছেন। তাঁদের মতো কয়েকটি পরিবার গ্রামের আরেকটি বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল। সে বাড়িতে পানি ওঠার পর ওই পরিবারের সদস্যরা আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন। এমন পরিস্থিতি প্রায় সবারই। প্রথমে পাশের বাড়িটিকেই নিরাপদ মনে করে সেখানে উঠেছেন। কিন্তু পানি ছাড় দেয়নি; তাঁদের প্রথমে ঘরছাড়া, পরে গ্রামছাড়া করেছে।

খালি মানুষ আইছি। জিনিসপত্র সব রই গেছে। তিন দিন ধরি ঘরও পানি। কেউর ঘরও হাঁটুপানি, কেউর ঘর বুকসমান পানি। তিন দিন অইলো বাড়ি ছাড়ছি।
মিনতি রানী বিশ্বাস (৫০), বিশ্বনাথ, সিলেট

ইলিমপুরের মিনা বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই জায়গা বদলাইয়া আইছি (এসেছি)। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে লইয়া কই যাইতাম (নিয়ে কোথায় যাব)। যাওয়ার তো জায়গা নাই।’

মণিকা বিশ্বাস নামের একজন বলেন, ‘আগে আরেক গ্রামে উঠছিলাম। এরপর মাইকিং করি খওয়ার (বলার) পর এখানো আইছি। নিরাশ্রয় যারা, তারার আশ্রয় দিছইন (দিয়েছেন)।’

এখানে আসার ক্ষেত্রে মা-মণি কমিউনিটি সেন্টারের মালিকেরও ভূমিকা আছে। আশ্রয়কেন্দ্রের পরিবারগুলো জানিয়েছে, সেন্টারের মালিক মাইকে ঘোষণা দিয়েছেন যাঁদের বাড়িঘরে পানি উঠেছে, তাঁদের এ সেন্টারে চলে আসতে। কেউ সরাসরি ঘোষণা শুনে এসেছেন। কেউ অন্যের কাছে শুনে এসেছেন।

গতকাল সন্ধ্যায় আশ্রয়কেন্দ্রটি যখন অন্ধকারে ডুবেছিল, কমিউনিটি সেন্টারের নিচতলায় গাট্টি-পোঁটলা নিয়ে অনেক পরিবারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। তারা যানবাহন খুঁজছিল, হয়তো কাছে বা দূরে কোনো আত্মীয়ের বাড়ি চলে যাবে। বন্যা তাদের ঘরের বাইরে ঠেলে দিয়েছে। কমিউনিটি সেন্টারের দোতলার বারান্দায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে ছিল কিছু পরিবার। তাদের কেউ মোমবাতি জ্বালিয়ে বসেছে, কেউ কেউ অন্ধকারে বসেই কথা বলছে।

মোক্তার হোসেনের বাড়ি সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে। থাকেন বিশ্বনাথের উত্তর মুর্শিদপুর গ্রামে। গত বৃহস্পতিবার থেকে বাড়িতে পানি উঠতে শুরু করে। গত শুক্রবার বিকেলের দিকে আশ্রয়কেন্দ্রে পরিবারের সাত সদস্যসহ এসে উঠেছেন। তিনি বলেন, ‘আজকে (শনিবার) কুনতা (কিচ্ছু) খাইছি না। কেউ কিছু দিছেও না।’

বাওনপুরের দবির মিয়া বলেন, ‘সেকেন্ডে সেকেন্ডে পানি বাড়ে। ঘরর মাঝে হাঁটুপানি। সবকিছু ওপরে তুলি আইছি। খাওয়াদাওয়ার কোনো ব্যবস্থা এখনো নাই।’ দবির মিয়া জানান, কমিউনিটি সেন্টারের মালিক ছুরুক মিয়া মাইকিং করার পর তাঁরা সেন্টারে এসে উঠেছেন।

জানাইয়া গ্রামের সুকিয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘরে কোমরপানি। কেথা (কাঁথা), বালিশ—সবতা (সবকিছু) ভাইসা গেছে। পানি যে আইছে (আসছে), কইতাম (বলতে) পারি না। ঘুমও আছলাম (ছিলাম)। উঠি দেখি ঘরও পানি। অন্যের মুখ থাকি শুনছি, তাইনে (সেন্টারের মালিক) জায়গা দিছইন।’

আশ্রয় নেওয়া এসব মানুষ জানান, এ আশ্রয়কেন্দ্রে গতকাল বিকেল পর্যন্ত ২০ থেকে ২৫টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তবে এ সংখ্যা বাড়ছে। কিছুক্ষণ পরপর ঘরডোবা মানুষগুলো আশ্রয়কেন্দ্রে এসে উঠছেন।