রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের হল থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো পুলিশ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের ১১টি আবাসিক হল থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এক পুলিশ সদস্য নিজের বেডিংপত্র নিয়ে যাচ্ছেন
ছবি: সংগৃহীত

ক্যাম্পাসে ট্রাকচাপায় শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবিব হিমেলের মৃত্যুর জেরে পুলিশমুক্ত হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের হলগুলো। ১১টি হলের নিরাপত্তায় চারজন করে পুলিশ সদস্য বিভিন্ন পালায় দায়িত্বে থাকতেন। ঘটনার রাত থেকেই হলগুলো থেকে পুলিশ প্রত্যাহার শুরু হয়। সবশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে বেডিংপত্রসহ ক্যাম্পাস থেকে বের হতে দেখা যায়। তাঁরা এখন থেকে ক্যাম্পাসের পুলিশ ফাঁড়িতে অবস্থান করবেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘটনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তাঁরা বলছেন, হলগুলোতে ছাত্রদের পাহারা দেওয়ার জন্য পুলিশ থাকাটা বেমানান। সেখানে পুলিশ দেখে শিক্ষার্থীরা অস্বস্তিতে থাকেন। পুলিশও একধরনের অস্বস্তিতে থাকেন। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে পুলিশ থাকতে পারে না। তাঁরা অনেকে ক্যাম্পাসেই পুলিশের অবস্থান দেখতে চান না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট হল ১৭টি। এর মধ্যে ছেলেদের ১১টি হলের প্রবেশদ্বারে বছরের পর বছর পুলিশের অবস্থান থাকলেও আগে থেকেই পুলিশমুক্ত ছিল মেয়েদের ছয়টি হল।

নগরের মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার আলী প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার রাতে শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁরা ক্যাম্পাস থেকে পুলিশ প্রত্যাহারের দাবি তোলেন। তাঁদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ছেলেদের ১১টি হল থেকে আপাতত পুলিশ সদস্যদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পুলিশ বক্স ও বিভিন্ন এলাকায় কাজ করবেন। হলগুলোতে পুলিশের প্রয়োজন হলে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাইলে তাঁরা পরবর্তী সময়ে আবার দেবেন।

আরও পড়ুন

গত মঙ্গলবার রাত পৌনে ৯টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হলের সামনে ট্রাকচাপায় মারা যান কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী হিমেল। নির্মাণসামগ্রী বহনকারী ট্রাকের চাপায় তাঁর মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

দুর্ঘটনার পরপরই শিক্ষার্থী পাঁচটি ট্রাক, নির্মাণশ্রমিকদের থাকার জায়গাতে আগুন ধরিয়ে দেন। একপর্যায়ে ক্যাম্পাসের পুলিশের ওপরও চড়াও হন শিক্ষার্থীরা। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয় উপাচার্যের বাসভবনের সামনে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে প্রধান ফটকসহ সব জায়গায় বিপুল পরিমাণ পুলিশ মোতায়েন করা হয়

অতিরিক্ত পুলিশের অবস্থান দেখেও শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তোপের মুখে পড়ে ঘটনার রাত ১১টার দিকে পুলিশ সেখান থেকে কাজলা গেটের দিকে চলে যায়। পরে রাত তিনটা পর্যন্ত পুলিশ সেখানেই অবস্থান করে। এর পর থেকে ক্যাম্পাসে পুলিশ কমাতে থাকে মহানগর পুলিশ।

আরও পড়ুন

হল থেকে পুলিশ সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক আজ শুক্রবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, হল থেকে পুলিশ স্থানান্তর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পুলিশ বক্স ও বিভিন্ন স্থানে তাদের রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে পুলিশ সেসব জায়গায় কাজ করা শুরু করে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই চেয়েছিলেন বিভিন্ন প্রবেশদ্বারে যেন পুলিশকে রাখা হয়।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে কোনো ছিনতাই ও অন্যান্য অপরাধ ঘটে না, তাই তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধপ্রবণ এলাকায় রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিতের স্বার্থে ক্যাম্পাসের যে পয়েন্টগুলো দিয়ে বহিরাগতদের প্রবেশের সুযোগ রয়েছে, সেই পয়েন্টগুলোতে অস্থায়ী পুলিশ বক্সের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

হল থেকে পুলিশ প্রত্যাহার ইতিবাচক

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে পুলিশ প্রত্যাহারের বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ছাত্রসংগঠনের নেতারা। তাঁরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে পুলিশ থাকাটা বেমানান। বছরের পর বছর মূলত বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া রাজনৈতিক সমস্যা নিরসনে পুলিশ ক্যাম্পাসে রাখা হয়েছে।সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সমস্যার সমাধানে পুলিশ ছাড়াই প্রশাসন ভালো সমাধান করে দেখিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বখতিয়ার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রাপ্তবয়স্ক এবং পুলিশি তৎপরতা ছাড়াই এটা পরিচালিত হওয়া উচিত। এখানে ছাত্র সংসদ সচল হলে পুলিশের দরকারও নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিজেরাই বসে অনেক কিছু সমাধান করতে পারবেন। আর পুলিশ সদস্যরাও এখানে থাকতে বোধ হয় খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। কারণ, শিক্ষার্থীরা তাঁদেরকে দীর্ঘদিন ধরে চান না।

অধ্যাপক বখতিয়ারের মতে, এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব সহিংসতার জন্য পুলিশি উপস্থিতি দেখা গেছে, সেগুলোর বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা না। এগুলো জাতীয় রাজনীতি থেকে আসা সহিংসতা। সহিংসতাগুলো রাজনৈতিকভাবে ঘটিয়েছে ছাত্রসংগঠনগুলো দিয়ে। এগুলো বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া সমস্যা। আর এই সমস্যাগুলো সমাধান হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের দরকার পড়ে না।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বখতিয়ার বলেন, হিমেলের ঘটনাটির পর শিক্ষার্থীরা পুলিশকে চলে যেতে বলে। পুলিশ চলে আসে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একরকম পুলিশি হস্তক্ষেপ ছাড়াই বিষয়টি সুন্দরভাবে সমাধান করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি শাকিলা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে পুলিশের থাকা উচিত নয়। হল থেকে পুলিশ প্রত্যাহারের বিষয়টি খুবই ইতিবাচক। এখন ক্যাম্পাসের ভেতরে পুলিশ বক্স থাকবে কি না, সেটা নিয়েও আলোচনা হওয়া দরকার। তাঁরা চান, ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হোক। আর এই ধরনের সম্পর্ক তৈরি করা গেলে পুলিশের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কতটুকু এ বিষয়ে করতে পারবে, সেটা দেখার বিষয়।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ মনে করেন, হলগুলোতে পুলিশ রাখা ঠিক না। বর্তমান পরিস্থিতি আগের মতো নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করতে পারেন।

আরও পড়ুন