মুক্তিপণের জন্য ৩ যুবককে টেকনাফের পাহাড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়

কক্সবাজার জেলার মানচিত্র

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার দমদমিয়ার পাহাড়ের ঝিরি থেকে তিন যুবকের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেপ্তার দুই রোহিঙ্গা শফি আলম ও আরাফাত কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, মুক্তিপণের জন্য তিন যুবককে ডেকে এনে টেকনাফের পাহাড়ে হত্যা করা হয়। পরে লাশগুলো পাহাড়ের ঝিরিতে ফেলে দেওয়া হয়।

গত শনিবার বিকেলে দুজনের জবানবন্দি গ্রহণ করেন আদালতের বিচারক শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গ্যা। এই দুই রোহিঙ্গা টেকনাফের মোচনী রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দা। মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র প্রথম আলোকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।

পুলিশ জানায়, গত ১৩ মে শফি আলম ও আরাফাতকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় শফির কাছ থেকে নিহত জমির হোসেনের মুঠোফোন উদ্ধার করা হয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার টেকনাফ থানার পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই রোহিঙ্গা শফি আলম ও আরাফাতকে জেলা কারাগার থেকে টেকনাফ থানায় নিয়ে আসে। আদালত এই দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন।

রিমান্ড দুই দিনে শেষ করার কথা জানিয়ে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার দুই রোহিঙ্গা আদালতে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। স্বীকারোক্তিতে কেন এই হত্যাকাণ্ড, হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত ছিল—এ সম্পর্কে কিছু বলেননি তাঁরা। তবে রিমান্ডের আগে দুই রোহিঙ্গা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য একজন তরুণীর মাধ্যমে নিহত তিন যুবককে কক্সবাজার থেকে টেকনাফে ডেকে আনা হয়েছিল। মুক্তিপণ না পেয়ে টেকনাফের পাহাড়ে হত্যার পর লাশ ঝিরিতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

পুলিশ জানায়, গত ২৪ মে সন্ধ্যায় র‍্যাব ও পুলিশ টেকনাফের দমদমিয়ার গহিন পাহাড়ে যৌথ অভিযান চালিয়ে তিন ব্যক্তির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে। পরের দিন লাশের পরিচয় শনাক্ত করেন স্বজনেরা।

আরও পড়ুন

নিহত যুবকেরা হলেন কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার জালালাবাদ ইউনিয়নের সওদাগরপাড়ার (বর্তমান কক্সবাজার শহরের মধ্য বাহারছড়া) কবির আহমদের ছেলে মোহাম্মদ ইউসুফ (৩৫), চৌফলদণ্ডী ইউনিয়নের উত্তরপাড়ার মোহাম্মদ আলমের ছেলে জমির হোসেন রুবেল (৩৫) ও কক্সবাজার শহরের উত্তর নুনিয়াছটার মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ছেলে মোহাম্মদ ইমরান (২৭)।

পুলিশ জানায়, গত ২৮ এপ্রিল টেকনাফের রাজারছড়া এলাকার কোহিনূর নামের এক তরুণী নিহত তিন যুবককে কক্সবাজার থেকে নিজের বাড়িতে ডেকে আনেন। এরপর তিনজনকে আটকে রাখা হয়।

গত ১০ মে নিহত জমির হোসেনের বড় বোন মিনু আরা বেগম বাদী হয়ে টেকনাফ মডেল থানায় কোহিনূর, জাহাঙ্গীর, কালু, বাবুল, হামিদ, ইসমাইল, মিনাকে এজাহারনামীয় আসামি করে অজ্ঞাতনামা আরও ছয় থেকে সাতজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে। আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টা পর্যন্ত আসামিদের কেউ গ্রেপ্তার হননি।

পুলিশ জানিয়েছে, আসামিদের অধিকাংশ মিয়ানমারে অবস্থান করছেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ২৮ এপ্রিল বিকেল ৪টার দিকে নিহত তিন বন্ধু অটোরিকশায় করে কোহিনূরের বাড়িতে পৌঁছালে আসামিরা তাঁদের জিম্মি করে রাখেন। পরদিন বেলা ১১টার দিকে জমিরের মুঠোফোন থেকে মিনুকে কল দিয়ে তিনজনকে অপহরণের কথা জানানো হয়। তখন মুক্তিপণ হিসেবে ৩০ লাখ টাকা চাওয়া হয়। এ সময় জমিরসহ অন্যদের নির্যাতনের ভিডিওচিত্র তাঁর মুঠোফোনে পাঠানো হয়। বলা হয়, মুক্তিপণের টাকা না পাঠালে তিনজনকে হত্যা করে লাশ গুম করা হবে।

মিনু আরা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, কোহিনূর লোকজন দিয়ে জমিরসহ তিন বন্ধুকে আটকে রেখে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিলেন। তাতে ব্যর্থ হলে কোহিনূরের লোকজন তিন বন্ধুকে অন্য একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন।

আরও পড়ুন

মিনু আরা আরও বলেন, কোহিনূরের সঙ্গে তাঁর ভাই জমিরের পূর্বপরিচয় ছিল। কোহিনূরের সঙ্গে জমিরের সাবেক স্ত্রী মিনার সুসম্পর্ক আছে। কক্সবাজার সদর মডেল থানার একটি মামলায় নিহত তিন বন্ধুর সঙ্গে মিনাও কারাগারে বন্দী ছিলেন। কারাগার থেকে বেরিয়ে চার লাখ টাকার পাওনা নিয়ে মিনার সঙ্গে জমিরের বিরোধ দেখা দেয়। এরপর মিনা জমিরকে তালাক দিয়ে আরেকজনকে বিয়ে করে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। মূলত, চার লাখ টাকা আদায়ের জন্য মিনার পরিকল্পনায় কোহিনূর জমিরসহ তিন বন্ধুকে টেকনাফ ডেকে নিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটান বলে অভিযোগ মামলার বাদী মিনু আরার।

পুলিশ জানায়, গত ২৪ মে র‍্যাব অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মোচনী আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দা সৈয়দ হোসেন ওরফে সোনালি ডাকাত ও টেকনাফ সদর ইউনিয়নের গোদারবিলের এমরুল করিম ওরফে ফইরাকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের দেওয়া তথ্যমতে ওই দিন সন্ধ্যায় দমদমিয়া পাহাড়ের ঝিরি থেকে তিন যুবকের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। সৈয়দ হোসেন ও এমরুল জেলা কারাগারে আছেন।

ওসি আবদুল হালিম বলেন, মামলার আসামি কোহিনূর ও মিনাকে গ্রেপ্তার করা গেলে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হতো।

পুলিশ জানায়, ২০২১ সালের ১৪ আগস্ট কক্সবাজার সদর মডেল থানায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে এজাহারনামীয় ১৭ জন ও অজ্ঞাতনামা আরও ৫ থেকে ৭ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়। মামলার বাদী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মোশারফ হোসেন। ওই মামলায় টেকনাফের পাহাড় থেকে উদ্ধার তিন বন্ধুর নাম রয়েছে। ১ নম্বরে জমির হোসেন রুবেল, ৬ নম্বরে মিনা, ৯ নম্বরে মোহাম্মদ ইমরান এবং ১৪ নম্বরে ইউসুফের নাম রয়েছে। ঘটনার সময় চৌফলদণ্ডীর উত্তরপাড়ার একটি বাড়ি থেকে পুলিশ ছয়জন যৌনকর্মীসহ এই তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছিল।

এ প্রসঙ্গে নিহত জমিরের বোন মিনু আরা বলেন, ওই মামলায় মিনাসহ নিহত তিন বন্ধু প্রায় সাত মাস কারাগারে ছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে মিনার সঙ্গে জমিরের বিরোধ দেখা দেয়।