‘মন্ত্রী আসলে বলতে চেইছিলাম, ত্রাণ লাগব না, বাঁধ চাই’

সকাল থেকে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করে এলাকাবাসী। কিন্তু দুপুরে জোয়ারে পুনরায় বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে লোকালয়ে। আজ বুধবার খুলনার কয়রা উপজেলার দশালিয়া গ্রামেছবি: প্রথম আলো

কর্মসূচির ব্যানারে লেখা ‘ঘূর্ণিঝড় রেমালকবলিত এলাকা পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণ’। খুলনার কয়রা উপজেলায় এই কর্মসূচিতে গিয়ে কিছু মানুষের মধ্যে কেবল ত্রাণই বিতরণ করলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান। ‘ব্যস্ততার কারণে’ তিনি ঘূর্ণিঝড়দুর্গত কোনো এলাকা পরিদর্শন করতে পারেননি।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগছে কয়রার দশালিয়া গ্রামের মানুষ। আজ বুধবার দুপুরে এখানকার ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধের পাশে দাঁড়িয়ে গ্রামের বাসিন্দা নাজমা বেগম প্রতিমন্ত্রীর সফরের প্রসঙ্গে টেনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুনছি ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী আজ কয়রায় আইছিল মানষেরে ত্রাণের চাল-ডাল দিতে। কোই আমাগে তো দেয়নি। ভাঙা এলাকা দেকতি আসবে শুনছিলাম, তা-ও আসেনি। কয়রা সদরে আইসে আবার ওইখান থেকেই হেলিকপ্টারে চইলে গেছে।’

সরকারের ত্রাণ না পাওয়ায় কোনো আফসোস নেই নাজমা বেগমের। তবে নিজেদের কষ্টের কথা প্রতিমন্ত্রীকে না বলতে পারার ক্ষোভ আছে। তিনি বলেন, ‘যাক ভালো হইছে, ২-৪ কেজি চাল আর নুন-তেল দিয়ে কী হবে? আমরা আর ত্রাণের নামে ফটোক তোলা ভিক্ষা নিতে চাইনে। আমাগের নদীর বাঁধটায় একটু পাকা ব্লক বসাই মজবুত করি বান্দি দিলিই হবে, আমরা ঘরবাড়ি আর খেতকৃষিতে কাজ করে খাতি চাই।’

গ্রামের আরেক বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করি, তখনই ঝড় আঘাত হানে, আর আবারও নিঃস্ব হই। এ নিয়ে চারবার ঝড়ে আমার ঘর ভাঙল। এলাকা দিন দিন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। আজ মন্ত্রী বাঁধ দেখতি আসলে বলতে চেইছিলাম, আমাগের ত্রাণ লাগব না, আমরা টেকসই বাঁধ চাই।’

প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে কয়রার ১৭টি স্থান দিয়ে বাঁধ উপচে ও দুটি স্থান বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে লোনাপানি ঢোকে। এরই মধ্যে দশালিয়া বাদে সব স্থানের বাঁধ সংস্কার করে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে লোনাপানির প্রবেশ ঠেকিয়ে দেন এলাকাবাসী। তবে দুই দিন কেটে গেলেও দশালিয়া ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ মেরামত না হওয়ায় চরম দুর্ভোগে দিনাতিপাত করছেন পানিবন্দী ৬০টি পরিবার।

দশালিয়া গ্রামের নুরুন্নাহার বেগম বললেন, ‘প্রতিবছর আমরা এ রকম ঝড় আর নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হই। প্রতিবারই কয়েক দিন হইচই হয়। এরপর যেই-সেই। বাঁধ ভাঙলে অনেক বড় ব্যক্তিরা আসেন। পরিদর্শন করেন, নানা বড় বড় আশ্বাসও দেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। এবার মন্ত্রী আসতি চেয়েও আসেনি।’ ক্ষোভ ও হতাশা ভরা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘বারবার ঝড় আর নদীর বাঁধভাঙা বন্যায় আমরা এখন নিঃস্ব। কিন্তু আমাদের এই সমস্যা স্থায়ী সমাধানে কেউ উদ্যোগী হয় না। এভাবে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে সব ছেড়ে ভিক্ষায় নামতে হবে আমাদের।’

আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কয়রার দশালিয়াসহ কয়েকটি গ্রামে ঘুরে ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্ভোগ দেখা যায়। ঝড়ের সময় জোয়ারের পানির চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়ে এবং ঝড়ে অনেক ঘরবাড়ি ভেঙেছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, ঘেরের চিংড়ি ও ফসলি জমি। নষ্ট হয়েছে বাড়ির জিনিস।

ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান। আজ বুধবার দুপুরে খুলনার কয়রার কপোতাক্ষ কলেজে
ছবি: প্রথম আলো

দশালিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কোমরপানির মধ্য দিয়ে লোকজনকে বাড়িতে যাওয়া-আসা করতে হচ্ছে। প্রায় এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধের নদীর পাশের মাটি ধসে কঙ্কাল হয়ে গেছে। তিনটি স্থানে প্রায় ৭০ মিটারের মতো বেড়িবাঁধ ভাঙা। এর মধ্যে দুটি স্থান দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকছে লোকালয়ে। শত শত বিঘা চিংড়িঘের পানিতে প্লাবিত।
মহেশ্বরীপুর, শিকারিবাড়ী, বাবুরাবাদ, মদিনাবাদ, সুতিয়া বাজার, পাতরখালী, কালীবাড়ি, শিঙেরচর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামগুলোর প্রায় ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধজুড়ে মাটির দেয়াল তুলে জোয়ার ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

দশালিয়া গ্রামের জহির উদ্দিন, মিজানুর রহমান, আলমগীর হোসেন, মাহবুব আলম, কামরুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন জানান, দুই দিন ধরে ভাঙা বাঁধটি মেরামতের চেষ্টা করছেন তাঁরা। আজ সকালেও গ্রামের মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে চেষ্টা করেও পানি আটকাতে পারেনি। দুপুরের জোয়ারে পানির চাপে মেরামত করা অংশ আবারও ভেঙে গেছে।

আরও পড়ুন

বারবার দশালিয়া এলাকার একই স্থানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পেছনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গাফিলতিকেই দুষছেন স্থানীয় লোকজন। তাঁদের অভিযোগ, কয়েক মাস আগে এখানে বাঁধ সংস্কার করা হলেও সেটি রক্ষণাবেক্ষণ বা মজবুত করার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পাউবো কর্তৃপক্ষ। এতে দুর্বল বাঁধ আবারও ভেঙে গেছে।

জানতে চাইলে খুলনা পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী মশিউল আবেদীন বলেন, স্বাভাবিক জোয়ারের তুলনায় নদীর পানি অনেক বাড়ছে। এ কারণে বাঁধ ভেঙেছে। প্রকৃতির কাছে মানুষও তো অসহায়। তারপরও স্থানীয় বাসিন্দারা স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছিলেন। তাঁরা বস্তা, বাঁশসহ আনুষঙ্গিক সবকিছু নিয়ে সহযোগিতা করছিলেন। কিন্তু দুপুরে নদীতে প্রবল জোয়ার থাকায় আজও বাঁধ টেকেনি। এখন এই বাঁধ মেরামতে একটু সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছে। কারণ, বাঁধের ভাঙা অংশ অনেক গভীর হয়ে গেছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দশালিয়ায় বাঁধটি আটকাবেন।

কয়রা উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে দুর্গত মানুষের সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার। ঝড়ে বিধ্বস্ত বাড়ির সংখ্যা ৩০ হাজার। ২ হাজার ৮০০ হেক্টর জমির ফসল ও ৪ হাজার হেক্টর মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে।

আরও পড়ুন

উপজেলা প্রশাসন ও প্রতিমন্ত্রীর সফরসূচি সূত্রে জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমানের আজ সকাল ১০টায় কয়রার কপোতাক্ষ কলেজ মাঠে হেলিকপ্টারযোগে পৌঁছানোর কথা ছিল। এরপর ঘূর্ণিঝড়দুর্গত এলাকা পরিদর্শন ও ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের কথা ছিল। তবে প্রতিমন্ত্রী বেলা ১১টার পরে কয়রার কপোতাক্ষ কলেজ মাঠে পৌঁছান। এরপর কলেজ মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ৪০০ মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করে ফিরে যায়।

জানতে চাইলে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তারিক উজ জামান বলেন, দশালিয়া এলাকার যে বাঁধটি মেরামত করা হচ্ছিল, তা আবার ভেঙে গেছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে। আজ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী কয়রায় এসে কয়রাবাসীর দুঃখ-দুর্দশা অতি দ্রুত দূর করার আশ্বাস দিয়ে গেছেন। তবে ব্যস্ততার কারণে কয়রার দুর্গত এলাকায় গিয়ে পরিদর্শন করতে পারেননি। তিনি কয়রা উপজেলা সদরে এসে ৪০০ মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন।

আরও পড়ুন