ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে উত্তেজনা চলছেই, নীরব বিএনপি

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মানচিত্র

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে পদপ্রাপ্ত ও পদবঞ্চিত নেতাদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। গত এক মাসের ব্যবধানে ককটেল বিস্ফোরণ, গোলাগুলি ও ছয়বার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। তবে ছাত্রদলের দুই পক্ষের এসব সংঘর্ষসহ অপ্রীতিকর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জেলা বিএনপিসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য বা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেননি। বিএনপিসহ অঙ্গসংগঠনের নেতারা অনেকটা ‘নীরব হয়ে তামাশা’ দেখছেন।

এদিকে ছাত্রদলের নবগঠিত ও বহিষ্কৃত নেতা-কর্মীরা একে অপরকে ‘দেখে নেওয়ার’ হুংকার দিয়ে পৃথক পৃথক কর্মসূচির পালনের ঘোষণা দিয়েছেন।

জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হাফিজুর রহমান মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘যা হয়েছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকে। কিন্তু প্রতিহিংসা না থাকাই ভালো। এর একটা সমাধানের পথ খোঁজার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলকে বলব।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দু-একটি ঘটনার পর আর কোনো উচ্ছৃঙ্খল ঘটনা ঘটেনি। বিএনপি আগামী কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। বিষয়টি মাথায় আছে। তাঁরা দেখবেন।

সংঘাতের শুরু কমিটি গঠন নিয়ে

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৮ জুন রাতে শাহিনুর রহমানকে আহ্বায়ক, সমীর চক্রবর্তীকে সদস্যসচিব ও পাঁচজনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে জেলা ছাত্রদলের আংশিক কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। এর মধ্যে সমীর চক্রবর্তী আগের কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। নবগঠিত কমিটিতে পদ পাওয়া ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রহমান ওরফে সানির বড় ভাই কবির আহমেদ ভূঁইয়ার অনুসারী হিসেবে পরিচিত। সদর উপজেলার বরিশল গ্রামের বাসিন্দা কবির আহমেদ আখাউড়া ছাত্রলীগের সাবেক সহসাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন।

আরও পড়ুন

এর আগে ২০২২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন রুবেল চৌধুরী ও সদস্যসচিব ছিলেন মহসিন মিয়া। নতুন কমিটিতে নতুন করে পদ না পাওয়ায় তাঁরা ক্ষুব্ধ।

স্থানীয় বাসিন্দা ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঘোষণার পরদিন গত ৯ জুন সকালে জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক আবু শামীম মো. আরিফের কান্দিপাড়ার বাসায় নতুন নেতাদের শুভেচ্ছা জানানো হয়। বিষয়টি জানতে পেরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সাবেক আহ্বায়ক রুবেল চৌধুরী ও সাবেক সদস্যসচিব মহসিন মিয়ার নেতৃত্বে সেখানে হামলা চালানো হয়। একই দিন বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে রুবেল চৌধুরীর নেতৃত্বে কান্দিপাড়ায় আহ্বায়ক শাহিনুর রহমান এবং জেলা কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক পৌর কাউন্সিলর কাউসার মিয়ার বাড়িতে হামলা চালান ছাত্রদলের পদবঞ্চিত নেতারা। পরদিন ১০ জুন বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তাঁরা সদস্যসচিব সমীর চক্রবর্তীর পাইকপাড়ার বাসা ঘেরাও করেন। পরে রাত পৌনে ১০টার দিকে ফুজায়েল চৌধুরীর নেতৃত্বে পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা কৃষক দল ও ছাত্রদলের নেতাদের বাড়িতে হামলা চালান। এ সময় ২০ থেকে ২৫টি ককটেল বিস্ফোরণ, গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

আরও পড়ুন

এরপর আহ্বায়ক কমিটি গঠন নিয়ে গত ১২ জুন বেলা ১১টার দিকে শহরের বিরাসার বাসস্ট্যান্ড এলাকার কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে এবং খয়াসার-বিরাসার সড়ক এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

ছাত্রদলের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করেছে। একটি মামলায় ৩৫ জন, আরেকটি মামলায় ৪৯ এবং অন্য মামলায় ৩৩ জনকে আসামি করা হয়েছে।

ছাত্রদলের আহ্বায়কের ওপর হামলা ও সাবেকেরা বহিষ্কৃত

ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা বলেন, গত শুক্রবার বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর-বিজয়নগর উপজেলার মধ্যে নবনির্মিত সীমনা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের তিতাস নদীর শিমরাইলকান্দি এলাকায় নবগঠিত কমিটির আহ্বায়ক শাহিনুর রহমান, ছাত্রদলের কর্মী মো. বিশালসহ আরও কয়েকজন ঘুরতে যান। সেখানে সাবেক আহ্বায়ক রুবেল চৌধুরী, সাবেক সদস্যসচিব মহসিন মিয়াসহ পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক শাহিনুরসহ তাঁর সঙ্গে থাকা নেতা-কর্মীদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা করেন। শাহিনুর একপর্যায়ে তিতাস নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মরক্ষা করেন। তবে তাঁর সঙ্গে থাকা ছাত্রদল কর্মী বিশালকে পিটিয়ে আহত করেন পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা।

আরও পড়ুন

এ ঘটনার জেরে শুক্রবার রাতে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানান, সংগঠনের শৃঙ্খলাপরিপন্থী কার্যকলাপে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে জেলা ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক রুবেল চৌধুরী এবং সাবেক সদস্যসচিব ও সদর উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মহসিন মিয়াকে ছাত্রদলের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ তাঁদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন।

এবার হামলা হলে ‘প্রতিবাদ ও মোকাবিলা’ হবে

সংঘর্ষের বিষয়টি পুরোটাই সাংগঠনিকভাবে মোকাবিলা করে গেছেন বলে দাবি করেন জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক শাহিনুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কোনো ঝামেলায় জড়াইনি। শুক্রবার ব্যক্তিগতভাবে আমার ওপর হামলা হলে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলকে অবগত করি। ফলে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করে। এখন তারা ছাত্রদলের কেউ না। এখন যদি তারা হামলা করে, সেটি সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারীদের হামলা হবে। কারণ, তারা দলের কেউ না। এখন অবশ্যই প্রতিবাদ ও মোকাবিলা করব। ছাত্রদলসহ পুরো বিএনপি পরিবার থেকে প্রতিবাদ করা হবে।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের খয়াসার-বিরাসার সড়ক এলাকায় গত ১২ জুন ছাত্রদলের দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

সদ্য বহিষ্কৃত সাবেক আহ্বায়ক রুবেল চৌধুরী বলেন, জেলা বিএনপি, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারা কেউ ছাত্রদলের দুই পক্ষের কারও পক্ষেই নেই। বিষয়টি হলো ছাত্রদল বনাম ছাত্রদল। তাদের কেউই এখন পর্যন্ত এসব বিষয়ে তাঁদের কোনো কিছু বলেননি। তিনি অভিযোগ করেন, ‘তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রহমান সানির বড় ভাই কবির আহমেদের প্রভাবের কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলার রাজনীতি এ রকম হয়েছে। আমরা তাঁর লোক ও অনুসারী না বলে আমাদের দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তিনি বিএনপির কোনো পদপদবিতে নেই। কিন্তু তিনি নিজেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিএনপির অভিভাবক হিসেবে দাবি করে। তাঁর আপন ভাই আবদুর রহমান ওরফে সানি দেশনায়ক তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী। তাই তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিএনপির রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেন।’

কবির আহমেদ ভূঁইয়া বর্তমানে দেশে নেই। বক্তব্যের জন্য তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে কল দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।

আরও পড়ুন

এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক ছাত্রদল নেতা রুবেল চৌধুরী বলেন, ‘আগামী দিনে দেশনায়ক তারেক রহমান আন্দোলন-সংগ্রামের যে নির্দেশনা দেবেন, সে মোতাবেক আমরা পৃথকভাবে সকল কর্মসূচি পালন করব। কারণ, আমাদের নেতা তারেক রহমান। সরকারবিরোধী সব আন্দোলনে আমরা রাজপথে থাকব।’ নতুন কমিটিকে মানতে না পারার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, শাহিনুর চিহ্নিত মাদক ও ইয়াবা ব্যবসায়ী। সমীর চক্রবর্তীর বাড়ি কিশোরগঞ্জে। শহরের পৌর এলাকায় ভাড়া থাকেন তিনি। নবগঠিত এই কমিটি দিয়ে জেলার রাজনীতি চলা অসম্ভব বলে দাবি তাঁর।

ছাত্রদলের সংঘাত ও বিএনপি নেতাদের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে জেলার সচেতন মহলের অন্তত পাঁচজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। তাঁরা বলেছেন, যে মুহূর্তে ছাত্রদলসহ বিএনপির মধ্যে ঐক্যের সুর থাকা প্রয়োজন, ঠিক সেই সময়ে দেখা দিয়েছে অনৈক্য। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে জেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন জেলার একটি নির্দিষ্ট গণ্ডি দক্ষিণ মৌড়াইল, পাওয়ার হাউস রোড, ফুলবাড়িয়া ছাড়া কোথাও দলীয় কর্মসূচি পালন করতে পারছে না। সেখানে তারা নিজের মধ্যে বিভক্ত হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বই এর প্রধান কারণ।