চল্লিশোর্ধ্ব মায়া বেগম নদীভাঙনের শিকার হয়ে ১০ বার বাড়িঘর হারিয়েছেন। বছরের পর বছর বন্যা আসত, বাড়িঘরের পাশাপাশি গবাদিপশু আর ধান-চাল, কিছুই রক্ষা করতে পারতেন না। কিন্তু বিশেষ স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি ‘খুদি বাড়ি’র কল্যাণে গত বছর বন্যায় নিরাপদেই ছিলেন।
মায়া বেগমের মতো খোরশেদ আলমের জন্যও আশীর্বাদ হয়ে এসেছে খুদি বাড়ি। তাঁর কথায়, আগে ঘরে পানি উঠলে সন্তানদের নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাতে হতো। খুদি বাড়িতে উঠে বন্যার সময়ও ওপরের তলায় থাকতে পেরেছেন। আর মাথার ওপর এখন নিরাপদ ছাদও হয়েছে।
জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলায় যমুনা নদীর দুর্গম চরের বাসিন্দা মায়া বেগম ও খোরশেদ আলম। প্রতিবছর নদীভাঙন ও বন্যায় জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা আর ভিটেমাটি হারানোর ঝুঁকিতে থাকা তাঁদের মতো বহু মানুষের কথা ভেবেই খুদি বাড়ি উদ্ভাবন করেছেন স্থপতি মেরিনা তাবাশ্যুম। এই বাড়ির জন্য দ্বিতীয় দফায় স্থাপত্যদুনিয়ার সম্মানজনক স্বীকৃতি আগা খান পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান এই স্থপতি।
গতকাল বুধবার বিকেলে ইসলামপুরের শিলহদ এলাকায় যমুনা নদীর দুর্গম চরে গিয়ে দেখা গেল বেশ কিছু খুদি বাড়ি। চারপাশে যমুনা নদী। তারই মাঝখানে চর। দূর থেকে দেখে মনে হয় দ্বীপ। নৌকা থেকেই দেখা যাচ্ছিল অন্য বাড়ি থেকে একদম আলাদা নকশার খুদি বাড়িগুলো।
বিশেষ স্থাপত্যশৈলীর এই বাড়ি সহজে বহন করা যায়। বেশ টেকসই ও নিরাপদও। বাঁশ, টিন ও হালকা উপকরণ দিয়ে বাড়িগুলো তৈরি করা হয়। মজবুত খুঁটির ওপর স্থাপিত হওয়ায় পানির উচ্চতা বাড়লেও বাড়ি নিরাপদ থাকে।
সবচেয়ে বড় সুবিধা—বাড়িটি সহজে খুলে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া যায়। তাই নদীভাঙন বা দীর্ঘস্থায়ী বন্যার ঝুঁকি দেখা দিলে পরিবারগুলো তাদের খুদি বাড়ি গুটিয়ে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করতে পারে।
পঞ্চাশোর্ধ্ব রুকেয়া বেগম একটি খুদি বাড়ি পেয়েছেন। বাড়িটি এক কক্ষ, দ্বিতল। ঘরের মধ্যে বাঁশ দিয়ে সিঁড়ি বানানো। ওই সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতীয় তলায় ওঠা যায়। ঘরের দ্বিতীয় তলায় তিনি পেঁয়াজ রাখছিলেন। তাঁর পাশেই মুগরব আলী শেখের বাড়ি। একই ধরনের ২৩টি বাড়ি আছে সেখানে।
রুকেয়া বেগম বলেন, ‘বন্যার সমুই (সময়) আমগরে খুব সুবিধা হইছে। এহন আর সব ছুইয়্যা (রেখে) বান্দে (বাঁধ) যাইতে হই না। এহন ঘরের দুই তলায় থাহি (থাকি)। ওর উপরেই পাকশাক (রান্না) করি। আমগরে এই ঘর পাইয়্যা খুব উপকার হইছে।’
আজগর আলী নামের একজন বলেন, ‘ঘরটা দেওয়াতে বন্যার সময় আমরা ওপরের তালায় (তলা) থাকবার পারি। আগে বন্যার সময় খুব কষ্ট করছি। পানির মধ্য থাইক্যা (থেকে) আরেক খানে যাইয়্যা থাহন (থাকার) লাগছে। আমরা এহন খুব শান্তিতে আছি। ঘর পাওয়ার পর একবার বন্যা আইছিল। তহন (তখন) এই ঘরের উপরের তালায় আছিলাম।’
চরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তিন বছর আগে ওই ১৮টি খুদি বাড়ি তৈরি করে চরের ১৮টি পরিবারকে দেওয়া হয়। এ বছর আরও ৫টি দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় লোকজনের চাওয়া, এই খুদি বাড়ি যেন চরটির সব পরিবারকে দেওয়া হয়।