সাক্ষাৎকার: স্থপতি মেরিনা তাবাশ্যুম

‘খুদি বাড়িতে’ একটা বাচ্চা ভালোভাবে থাকতে পারছে, এটা ভিন্ন রকম অনুভূতি

এ বছর দ্বিতীয়বারের মতো আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার পেয়েছেন স্থপতি মেরিনা তাবাশ্যুম। তাঁর প্রকল্পের নাম ‘খুদি বাড়ি’। এ নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে তাঁর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তপতী বর্মন।

প্রথম আলো:

অভিনন্দন। দ্বিতীয়বারের মতো আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার পেলেন। কেমন লাগছে?

মেরিনা তাবাশ্যুম: বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের কেউ কিছু অর্জন করলে সেটা আসলে দেশের সবার অর্জন। একা তো কেউ কিছু করতে পারেন না। একা হয়তো লাইন টানা যায়, কিন্তু একটা স্থাপত্য দৃশ্যমান হয়ে ওঠে অনেকের শ্রমে-ভাবনায়।

প্রথম আলো:

‘খুদি বাড়ি’র ভাবনা কীভাবে মাথায় এল?

মেরিনা তাবাশ্যুম: ২০১৮ বা ’১৯ সালের দিকে আমরা চাঁদপুরে মেঘনা নদীর চরের দিকে গিয়েছিলাম। হাইমচর উপজেলার চর ভৈরবীতে। চরের মানুষ কীভাবে থাকেন, তাঁদের লড়াইয়ের কথাগুলো শুনেছিলাম। পরে করোনার সময় ২০২০ সালে বন্যা ও ভাঙনকবলিত চরের মানুষের জন্য খুদি বাড়ির নকশা করি। ২০২১ সালে বাড়ি বানানোর কাজ শুরু হয়। প্রথম কাজ ছিল বরিশালের চর হিজলায়।

বাংলাদেশের খ্যাতিমান স্থপতি মেরিনা তাবাশ্যুম উদ্ভাবিত বিশেষ স্থাপত্যশৈলীর ‘খুদি বাড়ি’
ছবি: মেরিনা তাবাশ্যুম আর্কিটেক্টসের সৌজন্যে

প্রথম আলো :

খুদি বাড়ি নিয়ে বিস্তারিত যদি বলেন...

মেরিনা তাবাশ্যুম: আমরা চেয়েছি এমন বাড়ি বানাতে, যেখানে বন্যা হলে মানুষ ওপরের তলায় গিয়ে থাকতে পারবেন। ভাঙন দেখা দিলে সহজে বাড়িটি সরিয়ে নিতে পারবেন। মানুষ যেন খরচটা বহন করতে পারেন। হাতের কাছে পাওয়া পণ্য দিয়েই যেন বাড়িটি বানাতে পারেন। নদী দিয়ে চরে মালামাল বহন করা তো ব্যয়বহুলও। সহজে পাওয়া বাঁশ তাই এই স্থাপনার প্রধান উপকরণ। একমাত্র খরচের বিষয় যেটা, সেটা হলো স্টিলের যে জয়েন্টগুলো লাগে। আমরা এ পর্যন্ত যতগুলো ঘর বানিয়েছি, আমাদের একটা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান (ফাউন্ডেশন ফর আর্কিটেকচার, কমিউনিটি, ইকুইটি-ফেস) আছে, এই স্টিলের জয়েন্টগুলো তারাই দেয়। আমরা চাই ঘরগুলো যেন মজবুত থাকে। এটা বাদে বাকি খরচ মানুষ নিজেরাই দেন।

কারিগরি দিকটা আমরা তাঁদের বলি। একসঙ্গে বসি। কীভাবে বানাতে হবে, জিনিসটা সেটা শেখানো হয়। তারপর তাঁরা নিজেরাই বানান। আমরা চাই মানুষ নিজে শিখুন, যাতে ঘরটা যখন গুটিয়ে অন্য কোথাও নিতে হবে, সেটা যেন তাঁরা নিজেরাই করতে পারেন।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

এ ধরনের বাড়ি বানাতে কেমন খরচ লাগে?

মেরিনা তাবাশ্যুম: আমরা যখন শুরু করেছিলাম, তখন অনেক কম খরচে হতো। ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকায় হয়ে যেত। এখন স্টিলের দাম বেড়ে গেছে, মালামাল বহনের খরচ বেড়েছে। সব মিলিয়ে এখন ৪৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়।

প্রথম আলো:

কত দিনে এই বাড়ি বানানো যায়?

মেরিনা তাবাশ্যুম: এই বাড়ি বানাতে বেশি দিন লাগে না। বাড়ির কাঠামো বানানো থেকে শুরু করে পুরো কাজ শেষ করতে সর্বোচ্চ তিন থেকে চার দিন লাগে। দুর্যোগের মুখে খুলে নিতে দুই থেকে তিন ঘণ্টার বেশি লাগে না। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে এক থেকে দুই দিনের মধ্যে নতুন করে বাড়ি আবার সেট করতে পারেন।

‘খুদি বাড়ি’র নকশা করার জন্য আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার-২০২৫ পেয়েছেন মেরিনা তাবাশ্যুম
আগা খান
আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

আপনারা বাংলাদেশের কোথায় কোথায় এমন বাড়ি করেছেন?

মেরিনা তাবাশ্যুম: আমরা যেসব জেলায় ফোকাস করেছিলাম, যেখানে বন্যা ও নদীভাঙন হয়। জামালপুর, কুড়িগ্রামে বন্যা ও ভাঙন হয় অনেক। এসব জেলার কয়েকটা চরে কাজ করেছি। সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে হাওরের মাঝখানে এ রকম বেশ কয়েকটা জায়গায় করেছি। বরিশালের চর হিজলায় তো শুরুই করলাম। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আছে।

আমরা এগুলো পরে পর্যবেক্ষণও করি। মানুষ কীভাবে বাড়িগুলো ব্যবহার করছেন। তাঁদের জীবনের এর কোনো প্রভাব পড়ছে কি না। আমরা দেখলাম, অনেক প্রভাব আছে। মানুষের মধ্যে চাহিদাও আছে অনেক। চরে গেলে মানুষ এমন বাড়ির জন্য আমাদের কাছে অনুরোধ করেন। সবাইকে তো দিতে পারি না। যাঁদের বেশি দরকার, কমিউনিটির লোকজনই সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁদের নাম প্রস্তাব করেন। আমরা তাঁদের সহযোগিতা করি।

প্রথম আলো:

বন্যার সময় মানুষ এই বাড়িতেই থাকতে পারেন?

মেরিনা তাবাশ্যুম: এখানেই থাকতে পারেন। কোথাও সরে যেতে হয় না। শুধু শুকনা খাবার নিয়ে ওপরের তলায় চলে যান। তারপর যে কয়দিন বন্যার পানি থাকে, সে কয়দিন ওপরের তলাতেই থাকেন। নিচের বেড়াগুলো খুলে দেন, যাতে পানিটা চলে যেতে পারে। যখন ভাঙনের বিষয় আসে, তখন ঘরটা খুলে শুধু অন্য জায়গায় সরিয়ে নেন।

আমরা আরেকটা কাজ করছি রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে। সেখানে বেশ কিছু কমিউনিটি স্পেস তৈরি করেছি নারীদের জন্য। চরের প্রকল্প এলাকায়ও এমন কমিউনিটি স্পেস তৈরি করেছি। নারীরা সেখানে যান, প্রয়োজনীয় যোগাযোগ করেন পরস্পরের সঙ্গে।

আরও পড়ুন
যমুনা নদীর দুর্গম চরে বিশেষ স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি ‘খুদি বাড়ি’। গতকাল বিকেলে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার শিলদহ এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলো :

সামনে কী প্রকল্প নিয়ে ভাবছেন?

মেরিনা তাবাশ্যুম: শুধু ঘর বানালে তো হবে না; মানুষ যেন ঘরটা বানাতে পারেন, সেই আর্থিক সক্ষমতার দিকেও নজর দিতে হবে। আমরা চেষ্টা করছি নারীদের যা দক্ষতা আছে, সেটাকে কীভাবে আয়মুখী করা যায়। তাঁরা যেন একসঙ্গে টাকা জমান, ছোটখাটো একটা সমবায় সমিতির মতো করেন, পণ্য বিক্রি করতে পারেন—এমন বিষয়ে কাজের ভাবনা আছে।

প্রথম আলো :

এটা কি শুধু নারীদের জন্য? নারীরাই করবেন?

মেরিনা তাবাশ্যুম: নারীর হয়তোবা কোনো একটা হাতের কাজের দক্ষতা আছে। কিন্তু তাঁকে সহযোগিতা করার কেউ নেই কিংবা পণ্য বিক্রি কোথায় করবেন, জানেন না। আমাদের ইচ্ছা গ্রামে বা চরে এমন কমিউনিটি স্পেস বানানো, যেখানে নারীরা এই সুবিধাগুলো পাবেন। সেখান থেকে আয় করতে পারবেন।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

নতুন স্থপতিদের জন্য কোনো পরামর্শ আছে?

মেরিনা তাবাশ্যুম: মানুষের জন্য করলে মানুষ খুশি হয়। একটা বাচ্চা ভালোভাবে থাকতে পারছে, এটা ভিন্ন রকম অনুভূতি! তরুণ স্থপতিদের মধ্যে যাঁরা ভাবছেন কী করবেন, বিদেশে চলে যাবেন কি না; তাঁদের বলি দেশের দিকে তাকাতে। অনেক কিছু করার আছে।

আরও পড়ুন