শুরুই হয়নি ৪০০ প্রকল্পের কাজ, আছে রাজনৈতিক চাপ

সুনামগঞ্জের শালদিঘা হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধফাইল ছবি

সুনামগঞ্জে হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের নির্ধারিত সময়ের এক মাস অতিবাহিত হলেও এখনো ৪০০ প্রকল্পের কাজই শুরু হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৭৩৩টি প্রকল্পের মধ্যে ৩২৪টিতে কাজ চলছে। বাঁধ নির্মাণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা কাজের অগ্রগতি ১০ শতাংশ দাবি করলেও ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের নেতারা সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন।

সংগঠনটির নেতারা বলছেন, কাজে ঢিলেমি ও অনিয়মের কারণে এখনো ৮০ ভাগ প্রকল্পের কাজই শুরু হয়নি। তবে প্রশাসন ও পাউবো কর্মকর্তারা বলছেন, সংসদ নির্বাচন, হাওর থেকে পানি ধীরে নামা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনে রাজনৈতিক চাপ ও নানা অভিযোগ থাকায় কাজে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।

রোববার দুপুরে সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণসংক্রান্ত জেলা কমিটির সভায় এমন আলোচনা ও ক্ষোভ প্রকাশের ঘটনা ঘটে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে ওই সভা হয়। জেলা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরীর সভাপতিত্বে বাঁধ নির্মাণের সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরে সূচনা বক্তব্য দেন সদস্যসচিব ও সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী কমিটির সদস্যদের বক্তব্য, ক্ষোভ শুনে দুই দিনের মধ্যে সব পিআইসি গঠন ও প্রকল্পের কাজ শুরুর নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘কাজে গতি বাড়াতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে তদারকি বাড়াতে হবে।’ সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজের সময়সীমা ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় আছে মাত্র ৪৪ দিন।

সূচনা বক্তব্যে প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান, রোববার পর্যন্ত ১২টি উপজেলায় ৭৩৩টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। পিইসি গঠন হয়েছে ৭০৭টিতে। কাজ চলছে ৩২৪টি প্রকল্পে। বাঁধগুলোর মধ্যে ১৬৪টি ক্লোজার (ঝুঁকিপূর্ণ স্থান) আছে। এর মধ্যে ৫৪টি ক্লোজারে কাজ শুরু হয়েছে। এবার বাঁধের কাজে প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ১২৫ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন

বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি জানিয়ে মামুন হাওলাদার বলেন, সদর উপজেলায় ২৮টি প্রকল্পের মধ্যে ১৭টিতে কাজ শুরু হয়েছে। বিশ্বম্ভরপুরে ৩১টির মধ্যে ১৪টি, জামালগঞ্জে ৪৪টির মধ্যে ১৪টি, তাহিরপুরে ৮২টির মধ্যে ৫০টি, ধর্মপাশায় ৯৬টির মধ্যে ৫৫টি, মধ্যনগরে ৩২টির মধ্যে ২০টি, শান্তিগঞ্জে ৬৬টির মধ্যে ২৬টি, জগন্নাথপুরে ৩১টির মধ্যে ১৫টি, দিরাইয়ে ১১০টির ৩০টি, শাল্লায় ১৩১টির ৩৫টি, দোয়ারাবাজারে ৫১টির মধ্যে ৩৩টি ও ছাতক উপজেলায় ৩১টির মধ্যে ১৫টি প্রকল্পে কাজ চলছে। কাজের অগ্রগতি সর্বোচ্চ ধর্মপাশায় ১৩ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন শাল্লায় ২ শতাংশ। একইভাবে প্রকল্প বেশি হলেও দিরাইয়ে কাজের অগ্রগতি কম।

সভায় উপস্থিত ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পাউবোর হিসাবের সঙ্গে মাঠের কোনো মিল নেই। এবার কাজে গতি নেই। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা যাবে না। তিনি বলেন, বিভিন্ন উপজেলায় অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। অনিয়মের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

কমিটির সদস্য জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আমজাদ বলেন, ‘সুনামগঞ্জের মানুষ একটিমাত্র বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ফসলের খোঁজ নেন। তাই কাজে যেন কোনো অবহেলা না হয়। এটি হলে আমরা সহ্য করব না।’ তাহিরপুর উপজেলায় বেশ কয়েকটি প্রকল্প একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন কমিটির সদস্য গণমাধ্যমকর্মী পঙ্কজ কান্তি দে।

আরও পড়ুন

সভায় পিআইসি গঠনে রাজনৈতিক চাপের কথা উল্লেখ করেন তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সালমা পারভীন। তিনি বলেন, ‘এটি যেমন আছে, তেমনি পিআইসি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অভিযোগেরও শেষ নেই। কেউ কেউ আছে নিজে কাজ না পেলে অনিয়মের অভিযোগ তোলে। তবে আমরা যাচাই-বাছাই করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।’

দিরাই উপজেলার দায়িত্বে থাকা পাউবোর শাখা কর্মকর্তা আবদুল মোনায়েম বলেন, নির্বাচনের কারণে কাজে বিলম্ব হয়েছে। এখন দ্রুত কাজ করবেন তাঁরা। তাহিরপুরের শাখা কর্মকর্তা মনির হোসেন বলেন, পিআইসি নিয়ে দলাদলি আছে। এ জন্য নানা কথা শুনতে হচ্ছে। অনেকেই প্রকল্প নিতে চাপ দিয়ে থাকেন। জামালগঞ্জের শাখা কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, কোনো কোনো হাওরে এখনো পানি থাকায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। তবে বৃহস্পতিবারের মধ্যে সব প্রকল্পে কাজ শুরু করবেন বলে জানান।

সভায় অন্যান্যের মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের সুনামগঞ্জের উপপরিচালক দেওয়ান মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী (পওর বিভাগ-২) মো. শামসুদ্দোহা, সদরের ইউএনও মৌসুমী মান্নান, শান্তিগঞ্জের ইউএনও সুকান্ত সাহা, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান, জেলা কৃষক লীগের সদস্যসচিব বিন্দু তালুকদার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সুনামগঞ্জে হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণসংক্রান্ত জেলা কমিটির সভা। রোববার দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে
ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন

পাউবো সূত্র জানায়, সুনামগঞ্জের ছোট–বড় ৯৫টি হাওরে প্রতিবছর সোয়া ২ লাখ হেক্টরের মতো জমিতে বোরো আবাদ হয়। এসব হাওরে ১ হাজার ৭১৮ কিলোমিটারের মতো বেড়িবাঁধ আছে। পাউবো ৪০টি হাওরে কাজ করে। একসময় ঠিকাদারদের মাধ্যমে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ করা হতো। ২০১৭ সালে ব্যাপক ফসলহানির পর বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। পরে পাউবো নতুন নীতিমালা নিয়ে বাঁধের নির্মাণকাজ থেকে ঠিকাদারদের বাদ দেয়।

কাজে সরাসরি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে যুক্ত করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়ন ও তদারকিতে জেলা প্রশাসককে সভাপতি ও সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীকে সদস্যসচিব করে জেলা কমিটি এবং প্রতিটি উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি ও পাউবোর উপজেলা পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাকে সদস্যসচিব করে উপজেলা কমিটি গঠন করা হয়। মূলত উপজেলা কমিটি প্রকল্প নির্ধারণ ও পিআইসি গঠন করে জেলা কমিটিতে পাঠায়। পরে জেলা কমিটি চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য প্রকৃত কৃষক ও স্থানীয় সুবিধাভোগীদের নিয়ে পাঁচ থেকে সাত সদস্যের একটি পিআইসি থাকে। একটি পিআইসি সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকার কাজ করতে পারে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন