উপকূলে ভাসমান ভেলায় সামুদ্রিক শৈবালের চাষ, কম ঝুঁকিতে বেশি লাভ

কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল উপকূলে লোনা পানিতে বাঁশের ভেলায় চলছে পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাদ্য উপাদান শৈবালের চাষ
ছবি: প্রথম আলো

একসময় লবণ মাঠের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল ইউনিয়নের যুবক মো. আনোয়ার। এখন ইউনিয়নের পশ্চিম প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের বাঁকখালী চ্যানেলে ১৮টি ভেলায় সামুদ্রিক শৈবালের চাষ করেছেন তিনি। মায়ের গয়না বিক্রির ২০ হাজার টাকা আর ঋণের ৭০ হাজার টাকা নিয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে শৈবাল চাষ শুরু করেন। মাত্র দুই মাস পেরোতেই প্রায় ৬০ হাজার টাকার শৈবাল বিক্রি করেছেন আনোয়ার। আগামী এপ্রিলের মধ্যেই আরও অন্তত আড়াই লাখ টাকার শৈবাল বিক্রির আশা তাঁর।

আনোয়ারের মতো শৈবাল চাষ করে ভাগ্যবদলের চেষ্টায় রয়েছেন কক্সবাজারের সাড়ে তিন শতাধিক নারী-পুরুষ। জেলা শহরের নুনছড়ি, চৌফলদণ্ডী খাল, টেকনাফের সেন্ট মার্টিন, উখিয়ার সোনারপাড়া সমুদ্র উপকূল, রেজুখালসহ বিভিন্ন এলাকায় এসব সামুদ্রিক শৈবালের চাষ করছেন তাঁরা।

শৈবালচাষি ও গবেষকেরা জানান, স্থানীয় হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বাসাবাড়িতে শৈবাল দিয়ে মজাদার স্যুপসহ পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবার তৈরি করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে খাদ্যপণ্য, ওষুধ, প্রসাধনী, সার, বায়োফুয়েল তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে সামুদ্রিক শৈবাল। তাই বিশ্বজুড়েই সামুদ্রিক শৈবালের চাহিদা রয়েছে।

আরও পড়ুন

কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের সামুদ্রিক শৈবালবিষয়ক প্রকল্পের পরিচালক মো. মহিদুল ইসলাম বলেন, ২০১৮ সালে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে পরীক্ষামূলকভাবে সামুদ্রিক শৈবালের চাষ শুরু হয়। চাষে সফলতা পাওয়ার পর বাণিজ্যিক চাষে মানুষকে উৎসাহিত করতে সরকারের কাছে একটি প্রস্তাবনা পাঠান তাঁরা। অনেকে এরই মধ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে চাষ শুরু করেছেন। চাষিদের কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র থেকে কারিগরি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ শৈবাল চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশে সামুদ্রিক শৈবালের চাষ বাড়ানো গেলে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানো সম্ভব।
শফিকুর রহমান, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র

শৈবালচাষি মো. আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, লবণ মাঠে কাজ করার সময় দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় করতেন তিনি। মৌসুম শেষে কাজ পাওয়া যেত না। তাই ভাগ্যবদলের আশায় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে শৈবাল চাষের প্রশিক্ষণ নেন। কিন্তু চাষের খরচ জোগানোর মতো টাকা তাঁর ছিল না। তাই প্রথমে মায়ের গয়না বিক্রি করে ২০ হাজার টাকা পান। পরে একটি উন্নয়ন সংস্থা থেকে ৭০ হাজার টাকা ঋণ নেন তিনি। ৯০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে গত বছরের ডিসেম্বরে শুরু করেন চাষ। এখন প্রতিদিন ১২ থেকে ২০ কেজি শৈবাল বিক্রি করছেন। প্রতি কেজি শৈবাল বিক্রি হয় ১২০ থেকে ২০০ টাকায়। আগামী এপ্রিলের মধ্যেই অন্তত আড়াই লাখ টাকার শৈবাল বিক্রি করতে পারবেন তিনি।

আনোয়ারকে শৈবাল চাষে সহযোগিতা করেন তাঁর মা খুরশিদা বেগম। তিনি বলেন, আয়রোজগার কম হওয়ায় এত দিন ছেলেকে নিয়ে অনেক কষ্টে  জীবন যাপন করছেন তিনি। এখন শৈবাল চাষের কারণে তাঁদের ভাগ্যের কিছুটা বদল হয়েছে।

আরও পড়ুন

আনোয়ারের ১৮টি ভেলার পাশে আরও প্রায় ৯০টি ভেলায় করা হয়েছে সামুদ্রিক শৈবালের চাষ। এর মধ্যে পাঁচটি ভেলা ইয়াছমিন আকতার নামের এক নারীর। তিনি বলেন, গত নভেম্বর মাসে তিনি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আশা থেকে শৈবাল চাষের বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। তাঁর সঙ্গে আরও অন্তত ৪৫ জন নারী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ডিসেম্বর থেকে চাষ শুরু করেন তিনি। ইয়াছমিন আকতারের অভিমত, শৈবাল চাষে ঝুঁকি কম, লাভ বেশি। চাষের পর পরিচর্যা একেবারেই করতে হয় না।

লোনা পানিতে উৎপাদিত সামুদ্রিক শৈবাল বিক্রির জন্য রোদে শুকানো হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কক্সবাজার সদরের খুরুশকুলে
ছবি: প্রথম আলো

একই ধরনের তথ্য দেন স্থানীয় শৈবালচাষি খালেদা বেগম, রেজিয়া বেগম ও আবদুল করিম। চাষিরা জানান, প্রথমে বাঁশ বেঁধে ভেলা তৈরি করেন তাঁরা। পরে প্লাস্টিকের বয়া সংযুক্ত করা হয়, যাতে ভেলাটি ভাসমান থাকে। এরপর শৈবাল চারা এনে সেখানে লাগানো হয়। লবণাক্ত পানিতে কোনো ধরনের পরিচর্যা ছাড়াই শৈবাল বাড়তে থাকে।

শৈবাল চাষে যুক্ত ব্যক্তিদের অনেকেই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শফিকুর রহমানের কাছে। তিনি জানান, সামুদ্রিক শৈবাল খুবই পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবার। এটি প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন উপায়ে খাওয়া যায়। খাদ্য হিসেবে দেশে সামুদ্রিক শৈবালের পরিচিতি বাড়ানো গেলে কর্মসংস্থানও বাড়বে।

শফিকুর রহমান বলেন, কক্সবাজারে বর্তমানে ৩৭০ জন ব্যক্তি সামুদ্রিক শৈবালের চাষ করছেন। প্রশিক্ষণ দিয়ে কক্সবাজারের অন্তত ৫০ হাজার মানুষকে শৈবাল চাষে সম্পৃক্ত করা সম্ভব। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ শৈবাল চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশে সামুদ্রিক শৈবালের চাষ বাড়ানো গেলে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানো সম্ভব।

কক্সবাজারে প্রায় ১০৬ জন নারী-পুরুষকে সামুদ্রিক শৈবাল চাষের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আশা। প্রতিষ্ঠানটির আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক মো. মতিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত বর্ষাকাল ছাড়া বছরের অন্য সময়গুলোতে শৈবাল চাষ করা হচ্ছে। আশায় প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রত্যেক চাষির চলতি মৌসুমে শৈবাল বিক্রি করে অন্তত দেড় লাখ টাকা করে আয় হবে।