রোহিঙ্গাদের বাড়ি ফেরার ‘গো হোম’ প্রচারণা শুরু, দ্রুত চার দফা বাস্তবায়নের দাবি

কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গাদের ‘গো হোম’ প্রচারণা উপলক্ষে সমাবেশ। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরেছবি: প্রথম আলো

‘হুন, মা বইনল বেগ্গুন, মন দিয়র হুন। সময় আইস্যে নিজর দেশত ফিরি যাইবার। চল, নিজর ইচ্ছাত আঁরা ফিরি যাইগই (শোন, মা বোনেরা, মন দিয়ে শোনো। সময় এসেছে নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার। চলো নিজের ইচ্ছাতে আমরা ফিরে যাই)।’

জনপ্রিয় এই রোহিঙ্গা গানের সুরে কয়েক শ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ‘গো হোম’ প্রচারণার মানববন্ধন করেন। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে কক্সবাজার শহর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে উখিয়ার কুতুপালং (ক্যাম্প-১ পশ্চিম) রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে এ মানববন্ধন করা হয়। মানববন্ধনে চারটি দাবি উত্থাপন করেন তাঁরা।

সকাল ১০টা থেকে উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের পাশাপাশি মধুরছড়া, জুমশিয়া, বালুখালী, তানজিমারখোলা, ময়নারঘোনা, টেকনাফের উনচিপ্রাং, শালবাগান, জাদিমুরাসহ অন্যান্য আশ্রয়শিবিরেও মানববন্ধন কর্মসূচি ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। কুতুপালং ও লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের দুটি সমাবেশে কয়েক হাজার করে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ অংশ নেন। প্রচারণা ঘিরে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেন না ঘটে, সে জন্য আগেভাগে কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যরা।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রত্যাবাসন সম্পর্কে সাধারণ রোহিঙ্গাদের বোঝাতে আশ্রয়শিবিরগুলোতে ‘গো হোম’ প্রচারণা পরিচালনার অনুমতি চেয়েছেন রোহিঙ্গা নেতারা। আজ এক দিনের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে। উখিয়া ও টেকনাফের সব কটি আশ্রয়শিবিরে গো হোম ক্যাম্পেইন চলছে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলার খবর পাওয়া যায়নি।

কুতুপালংয়ে মানববন্ধনে রোহিঙ্গা নেতা কামাল উদ্দিন বলেন, ‘২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার–নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। নানা সংকটের মুখেও বাংলাদেশ ৮ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। এ জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ছয় বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। এখন আমরা নিজ দেশে ফিরতে চাই। কিন্তু প্রত্যাবাসন কার্যক্রম টেকসই হতে হবে।’

মানববন্ধনে রোহিঙ্গা নেতা চারটি দাবি উত্থাপন করেন। এগুলো হলো রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নাগরিকত্ব দিতে হবে। রাখাইন রাজ্যে ফেলে আসা জন্মভিটাতে তাঁদের পুনর্বাসন করতে হবে। স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ দিতে হবে। রোহিঙ্গাদের লুণ্ঠিত সম্পদ, জায়গা-জমি ফেরত দিতে হবে।

সমবেত রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন কয়েকটি আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা নেতারা। এ সময় দুজন রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ ছয় বছর আগে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গুলিতে স্বামী ও ভাই নিহত হওয়ার ঘটনা তুলে ধরে বলেন, ‘ওই বর্বর নিপীড়নের ঘটনার বিচার যেমন চাই, তেমনি জন্মভূমিতেও ফিরতে চাই। সেই পরিবেশ মিয়ানমার সরকারকে তৈরি করে দিতে হবে।’

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। কিন্তু এ পর্যন্ত গত ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।
পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, গত ২৫ মে মিয়ানমারের ১৪ সদস্যের প্রতিনিধিদল টেকনাফের শালবাগান আশ্রয়শিবিরে এসে প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে ২৮০ জন রোহিঙ্গা পরিবার প্রধানের সঙ্গে টানা তিন ঘণ্টা বৈঠক করেন। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দেশটির মিনিস্ট্রি অব সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্সের আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ। বৈঠকে রোহিঙ্গা নেতাদের বলা হয়, রোহিঙ্গারা রাখাইনে পৌঁছার পর প্রথমে এনভিসি ( ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন সার্টিফিকেট) কার্ড দেওয়া হবে। পরবর্তী সময়ে নাগরিক হিসাবে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করা হবে। তখন রাখাইনে স্বাধীনভাবে চলাফেরা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ চাকরির সুযোগ-সুবিধা পাবে রোহিঙ্গারা। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যের যে ১৫টি গ্রামে রাখা হবে, সেখানে ভিলেজ টাউন প্রকল্পে কী কী সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে, তা–ও ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়।

তবে রোহিঙ্গা নেতারা নাগরিকত্ব প্রদান, রাখাইনে ফেলে আসা জন্মভিটাতে পুনর্বাসন, স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ দাবি করে বলেন, এগুলো ছাড়া কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশের আশ্রয়শিবির থেকে রাখাইনে ফিরতে রাজি হবেন না।

আরআরআরসি কার্যালয় সূত্রমতে, চীনের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ থেকে যে ৮ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে থেকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে ১ হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল। অবশিষ্ট ৪২৯ জন রোহিঙ্গার বিষয়ে মিয়ানমারের আপত্তি ছিল। বাংলাদেশ সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল গত মার্চ মাসে টেকনাফে এসে ৪২৯ জন রোহিঙ্গার পাশাপাশি তাঁদের পরিবারে জন্ম নেওয়া আরও ৫১ জন শিশুর তথ্য সংগ্রহ করেন। রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জনের জন্য তাঁদের ২০ জনের প্রতিনিধিদলকে গত ৫ মে রাখাইনের পরিস্থিতি দেখানো হয়।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন